মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ফোরকান
১৬ জুলাই ২০১৫ফোরকান আলীর আইনজীবী আব্দুস সালাম ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার মতো আর্থিক সঙ্গতি তার (ফোরকানের) নেই, তাই সরকারের কাছে সহায়তার আবেদন জানানো হবে৷''
বৃহস্পতিবার বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল-২ পটুয়াখালীর ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করে৷ একাত্তরের মুসলিম লীগ কর্মী ফোরকানের বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগের তিনটি প্রমাণিত হয়েছে৷ এই তিনটি অভিযোগ হলো, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পটুয়াখালীর মীর্জাগঞ্জের সুবিদখালী বাজারে গোলাপী রানীকে এবং কাকড়াবুনিয়ায় আলেয়া বেগমকে ধর্ষণের পর হত্যা, আলেয়া বেগমের বাবাকে হত্যা এবং দেবেন্দ্র ডাক্তারকে হত্যা৷
একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে ২০০৯ সালের ২১শে জুলাই ফোরকানের বিরুদ্ধে মির্জাগঞ্জ থানায় মামলা করেন তার আত্মীয় আবদুল হামিদ মল্লিক৷ প্রাথমিক তদন্তে ফোরকানের যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ পাওয়ার পর মামলাটি পটুয়াখালী থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়৷ গোয়েন্দা পুলিশ ২০১৪ সালের ২৫শে জুন ফোরকানকে বরিশালের রুপাতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে গ্রেপ্তার করে৷ তারপর ৩রা জুলাই ট্রাইব্যুনাল মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাকে করাগারে পাঠায়৷ গত ২রা ডিসেম্বর ট্রাইব্যানাল-২ ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেয়৷ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অন্তত আটজনকে হত্যা, চারজনকে ধর্ষণ, তিনজনকে ধর্মান্তরে বাধ্য করা, ১৩টি পরিবারকে দেশান্তরে বাধ্য করা, ৬৪টি বসতবাড়ি ও দোকানে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মোট পাঁচটি ঘটনায় অভিযুক্ত করে গত ১৮ই ডিসেম্বর ফোরকানের বিচার শুরু করা হয়৷
পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ থানার ছইলাবুনিয়া গ্রামের সাদের মল্লিক ও সোনভান বিবির ছেলে ফোরকান মল্লিক পড়ালেখা করেছেন পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত৷ তার আইনজীবী আব্দুস সালাম বৃহস্পতিবার ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘ফোরকান মল্লিকের বাবাও দরিদ্র ছিলেন৷ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ফোরকান এলকারই গনি মস্টার নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে বছরে ২০ কাঠি (১০ মন) ধানের বিনিময়ে কামলা ( কৃষি শ্রমিক) হিসেবে কাজ করতেন৷ তিনি সরাসরি কোনো হত্যা বা ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না৷ তবে মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে রাজাকার ও হানাদারদের ইনফরমার হিসেবে কাজ করতেন৷''
আব্দুস সালাম আরো জানান, ‘‘মুক্তিযুদ্ধের পর ফোরকান ঢাকায় এসে প্রথমে দোকানে এবং পরে একটি গার্মেন্টস-এ কাজ করেন৷ সেই আয়ে তিনি তার এলাকায় একখন্ড জমি কিনে আত্মীয় হামিদ মল্লিকের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন৷ হামিদ মল্লিকই তার বিরুদ্ধে মামলা করে৷''
আইনজীবী আব্দুস সালামের দাবি, ‘‘আত্মীয়তার কারণে তিনি ফোরকান মল্লিকের মামলার আইনজীবী হয়েছেন৷ কিন্তু এই মামলা পরিচালনা করে তিনি কোনো টাকা পাননি৷ বরং তার টাকা খরচ হয়েছে৷ মামমলার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার মতো আর্থিক সঙ্গতি ফোরকান মল্লিকের নেই৷ তাই আপিলের জন্য সরকারের কাছে আর্থিক অথবা আইনগত সহায়তা চাওয়া হবে৷''
ফোরকান মল্লিকের স্ত্রী জাবেদা বেগম গ্রামেই থাকেন৷ দুই ছেলে জহির মল্লিক এবং তাহির মল্লিক ঢাকায় দোকানে কাজ করেন৷ তাঁরা বিয়ে-থা করেছেন৷ বাবাকে দেখার মতো আর্থিক সঙ্গতি তাদেরও নেই বলে আব্দুস সালাম জানান৷
তবে মামলার বাদী হামিদ মল্লিক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ফোরকান মল্লিক আমার দূর সম্পর্কের চাচা৷ আমি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে আমাদের বংশকে কলঙ্কমুক্ত এবং যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য তার বিরুদ্ধে মামলা করেছি৷ জমিজমা নিয়ে তার সঙ্গে আমার কোনো বিরোধ নেই৷''
তিনি আরো জানান, মুক্তিযুদ্ধের পর ২৬ বছর ফোরকান মল্লিক ঢাকায় ছিলেন৷ একাত্তরের লুটপাটের টাকায় তিনি ঢাকায় বাড়ি এবং জমিও কিনেছিলেন৷ তার ছেলে জহির মল্লিক একটি অস্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর ওই বাড়ি এবং জমি বিক্রি করে ছেলেকে মুক্ত করেন এবং সে কারণে আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন৷
এদিকে পটুয়াখালীর সাংবাদিক মুজাহিদুল ইসলাম প্রিন্স বলেছেন, ‘‘ঢাকায় থাকলেও ফোরকান মল্লিক মাঝে মধ্যে এলাকায় যেতেন৷ জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে স্বাধীনতাবিরোধীরা আবার রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হতে শুরু করলে ১৯৭৭ সালে ফোরকানও স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন৷ তবে সামাজিক অবস্থানের কারণে তিনি তেমন সুবিধা করতে পারেননি৷''
ফোরকানের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ সত্য দাবি করে মুজাহিদুল ইসলাম প্রিন্স বলেন, ‘‘তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ প্রমাণিত৷ তিনি একাত্তরে যুদ্ধাপরাধে যুক্ত হয়েছিলেন তার প্রমাণ এলকায় রয়েছে৷ তবে তিনি ছিলেন নিম্নবিত্ত পরিবারের এবং পরেও সুবিধা করতে পারেননি৷''
প্রিন্স আরো জানিয়েছেন, ১৯৭২ সালে রাজাকারদের যে তালিকা তৈরি করা হয়েছিল তাতে ফোরকান মল্লিকের নাম আছে৷ তবে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে পটুয়াখালীর সাব সেক্টর কমান্ডার আলতাফ হায়দারের কাছ থেকে তিনি কোনো যুদ্ধাপরাধে জড়িত নন এই মর্মে একটি প্রত্যয়ন পত্র নিয়েছিলেন৷