1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

অ্যামেরিকার ‘চাপের’ সমান্তরালে শেখ হাসিনার ‘রাজনীতি’

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
১১ এপ্রিল ২০২৩

ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন৷ সেই বৈঠকের কয়েক ঘণ্টা আগেই সংসদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কড়া সমালোচনা করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷

https://p.dw.com/p/4PvKR
Bangladesch Premierministerin Sheikh Hasina
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ (ফাইল ফটো)৷ছবি: PID Bangladesh government

কোন বক্তব্যের প্রভাব কোথায়, কতটা পড়তে পারে?

ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি জে ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন৷ সেই বৈঠকের কয়েক ঘণ্টা আগেই সংসদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কড়া সমালোচনা করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ কোন বক্তব্যের প্রভাব কোথায়, কতটা পড়তে পারে?

ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া, অর্থাৎ বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রণে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের সঙ্গে কার্যত সুরই মিলিয়েছেন৷ তিনি বলেছেন, ‘‘এটা বাংলাদেশেরও চাওয়া৷ বাংলাদেশ একটি মডেল নির্বাচনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চায়৷’’

সংসদে যুক্তরষ্ট্রের কড়া সমালোচনায় প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার সংসদে বলেছেন, ‘‘অ্যামেরিকায় যখন প্রথমবার যাই, সেখানকার আন্ডার সেক্রেটারির সঙ্গে আমার মিটিং হয়েছিল৷ বলেছিলাম আমি একটি মনুমেন্ট দেখে এসেছি, সেখানে লেখা আছে- গভর্নমেন্ট অব দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল৷ আমি এমন একটি দেশ থেকে এসেছি, সে দেশটি হচ্ছে গভর্নমেন্ট অব দ্য আর্মি, বাই দ্য আর্মি, ফর দ্য জেনারেল৷ বলেছিলাম, অ্যামেরিকা গণতন্ত্র চর্চা করে তাদের আটলান্টিকের পাড় পর্যন্ত, এটা যখন পার হয়ে যায়, তখন কি আপনাদের গণতন্ত্রের সংজ্ঞাটা বদলে যায়? কেন আপনারা একটা মিলিটারি ডিক্টেটরকে সমর্থন দিচ্ছেন? আমি এই প্রশ্নটি করেছিলাম৷’’

বর্তমানে মার্কিন অবস্থানের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘‘আজকেও আমি বলি, যে দেশটা আমাদের কথায় কথায় গণতন্ত্রের সবক দেয়আর আমাদের বিরোধী দল থেকে শুরু করে কিছু কিছু লোক তাদের কথায় খুব নাচন-কোদন করছেন, উঠবস করছেন, উৎফুল্ল হচ্ছেন৷ হ্যাঁ, তারা যে কোনো দেশের ক্ষমতা ওলটাতে পারেন, পালটাতে পারেন৷’’

প্রধানমন্ত্রী যেটা সংসদে বলেছেন সেটা রাজনৈতিক: মো. হুমায়ুন কবির

প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘‘১৫ আগস্টে যারা হত্যা করেছে, সেই খুনি রাশেদ (রাশেদ চৌধুরী) অ্যামেরিকায় আশ্রয় নিয়ে আছে৷ সেখানে যত প্রেসিডেন্ট এসেছেন, সবার কাছে আমি আবেদন করেছি, আইনগতভাবে আমরা প্রচেষ্টা চালিয়েছি, আমরা ডিপ্লোম্যাসির মাধ্যমে প্রচেষ্টা চালিয়েছি৷ প্রেসিডেন্টের কাছে আবেদন করেছি যে, এই খুনি সাজাপ্রাপ্ত আসামি, তাকে আপনারা আশ্রয় দেবেন না৷ শিশু হত্যাকারী, নারী হত্যাকারী, রাষ্ট্রপতির হত্যাকারী, মন্ত্রীর হত্যাকারী- এরা মানবতা লঙ্ঘনকারী, এদের আপনারা আশ্রয় দিয়েন না৷ ফেরত দিন৷ কই তারা তো তাকে ফেরত দিচ্ছে না৷ খুনিদের লালন-পালন করেই রেখে দিচ্ছে৷’’

শেখ হাসিনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়েও কথা বলেন৷

যুক্তরাষ্ট্রকে আশ্বস্ত করলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী

পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জে ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে বৈঠক করেন বাংলাদেশ সময় সোমবার মধ্যরাতে৷ সেখানে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘‘আমরা তাকিয়ে আছি, গোটা বিশ্ব তাকিয়ে আছে বাংলাদেশের নির্বাচনের দিকে৷  আমাদের প্রত্যাশা,  বাংলাদেশ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করে ওই অঞ্চলে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে৷’’

তিনি বলেছেন, ‘‘অ্যামেরিকা ও বাংলাদেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা করে চলেছে৷  আর্থিক সম্পর্ক, দুই দেশের মানুষের সম্পর্ক, পরিবেশ, স্বাস্থ্য, মানবাধিকারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুই দেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়েছে৷'' বংলাদেশ যেভাবে ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে তার প্রশংসাও করেছেন তিনি৷

আর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন পরে  ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে আলাপ হয়েছে৷ তারা চান এখানে একটি মডেল নির্বাচন হবে৷ আমি বলেছি, অবশ্যই, আমরাও মডেল নির্বাচন চাই৷ আমাদের রক্তে গণতন্ত্র, আমাদের রক্তে জাস্টিস৷ আমরা ৩০ লাখ প্রাণ দিয়েছি গণতন্ত্র, জাস্টিস ও সম্মান সমুন্নত রাখার জন্য৷ তবে এ বিষয়ে আপনাদের সাহায্য চাই৷ আপনারাও আমাদের সাহায্য করেন যাতে করে আমরা অবাধ, সুষ্ঠ ও স্বচ্ছ নির্বাচন করতে পারি৷’’

নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের পর্যবেক্ষককে স্বাগত জানানোর কথা দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানিয়ে মোমেন বলেন, ‘‘আমরা তোমাদের পর্যবেক্ষককে স্বাগত জানাতে চাই৷ তোমরা আসো৷ আমরা বলেছি, তোমরা যত পারো পর্যবেক্ষক পাঠাও৷ গত নির্বাচনে ২৫ হাজার পর্যবেক্ষক ছিল৷ কিন্তু পর্যবেক্ষক অবশ্যই বাংলাদেশি অরিজিন কেউ হতে পারবে না, যারা রাজনৈতিক দলের ব্যানারে পর্যবেক্ষক হতে চাইবে৷’’

নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার বিষয়ে সরকারের পরিকল্পনার কথা ব্লিঙ্কেনের কাছে তুলে ধরেছেন জানিয়ে মোমেন বলেন, ‘‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য আমরা কী করেছি, আমরা ফটো আইডি তৈরি করেছি, যাতে ভুয়া ভোট না হয়৷ আমরা বিশ্বাসযোগ্য ব্যালট বাক্স করেছি৷ আমরা একটা স্বাধীন নির্বাচন কমিশন করেছি৷’’

সংসদে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া সমালোচনা আর ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রকে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আশ্বস্ত করার মধ্যে কী বার্তা পাচ্ছেন কূটনীতিক ও বিশ্লেষকরা? আর সরকারের ভিতরের ভাবনাই বা কী?

কূটনীতিকরা বলছেন, সংসদে প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন তা দেশের মানুষের জন্য, বিরোধীদের জন্য৷ তিনি তার বক্তব্যে বুঝাতে চেয়েছেন তার শক্ত অবস্থানের কথা৷  কিন্তু বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেবচনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি রেখেই সরকার এগোবে৷ তবে সেটা হবে সরকারের নিজস্ব পদ্ধতিতে৷

বিএননপি  নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বললেও যুক্তরাষ্ট্র বা বিদেশি বন্ধুরা কিন্তু নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে কথা বলছেন না৷ তারা সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু  ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা বলছেন৷ সরকারও বর্তমান ব্যবস্থার মধ্যেই  তাদের সে বিষয়ে আশ্বস্ত করতে চাইছে৷ আর নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে সরকারের ওপর চাপও বাড়বে৷ সরকার চাইছে এই চাপের মুখে তাদের যেন দুর্বল মনে না হয়৷

সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. হুমায়ুন কবির বলেন, ‘‘আমি নিজেও একটু বিস্মিত হয়েছি যে ওয়াশিংটনে কথা বলতে গিয়েছে আবার এই সময়ে এখানে এক শক্ত কথা, তাতে লাভটা কী? ওদের সঙ্গে আমরা ধাক্কাধাক্কি করব? ধাক্কাধাক্কি করে কোনো লাভ হবে? আমার মনে হয়েছে প্রধানমন্ত্রী যেটা সংসদে বলেছেন সেটা রাজনৈতিক৷ এর উদ্দেশ্যও রাজনৈতিক৷ কূটনীতির কথা আলাদা৷ যেটা মোমেন সাহেব বলেছেন৷ আসলে ওদের সঙ্গে নিয়েইতো আমাদের চলতে হবে৷ তাদের বাদ দিয়ে তো চলতে পারবো না৷’’

তার কথা, ‘‘নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বিদেশিরা কথা বলেন না৷ তারা এটা বলবেনও না৷ তারা সুষ্ঠু এবং অংশগ্রণমূলক নির্বাচনের কথা বলেই যাবেন৷ নির্বাচনের আগে হয়তো সরকার, বিরোধী দল দুই পক্ষই ছাড় দেবে৷''

তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘সংসদে বা যেখানেই কথা হোক না কেন, যুক্তরাষ্ট্র তা নজরে রাখে৷ এটা তারা পর্যবেক্ষণ করে৷’’

আরেকজন সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক বলেন, ‘‘যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের চাপের সঙ্গে ভিতরের উদ্দেশ্যও থাকে৷ তারা গণতন্ত্র, নির্বাচনের কথা বলে, কিন্তু তাদের ব্যবসা- বাণিজ্যসহ নিজেদের স্বার্থও থাকে৷ দুইটা তারা ব্যালেন্স করে৷ আমাদের দেশের সরকার সেটা জানে৷’’

যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের চাপের সঙ্গে ভেতরের উদ্দেশ্যও থাকে: শহীদুল হক

‘‘প্রধানমন্ত্রী সংসদে যা বলেছেন তা দিয়ে তিনি বাংলাদেশের জনগণ ও বিরোধীদের কাছে তার স্ট্রং ফেস তুলে ধরেছেন৷ তবে মার্কিন পলিসি বেশ ক্লিয়ার৷ বিভিন্ন দেশের ক্রাইসিসে তাদের কী অবস্থান হয় তা-ও জানা৷ তাদের সাথে সরকারের সম্পর্কটা সেই দিক থেকে এগোনোর চেষ্টা করা হচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে,'' বলেন এই কূটনীতিক৷

‘‘তবে নির্বাচন নিয়ে যে যুক্তরাষ্ট্র কনসার্ন, সেটা স্পষ্ট৷ নির্বাচনকালীন সরকার-পদ্ধতি নিয়ে তারা কথা না বললেও সুষ্ঠু  ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে তাদের কথা থাকবেই৷ সেটা কোন পর্যায়ে যাবে তা বলার সময় এখনো আসেনি,'' বলে মনে করেন তিনি৷

আর রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনূ মজুমদার মনে করেন, ‘‘শেখ হাসিনা সংসদে যা বলেছেন সেটা শব্দগত দিক দিয়ে না দেখে স্পিরিটের জায়গা থেকে দেখতে হবে৷ দীর্ঘদিন ধরে কথিত ছোট দেশগুলোর সঙ্গে কথিত বড় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের যে ভারসাম্যহীনতা তা প্রকাশ পেয়েছে৷ তবে বাইরে কী কথা হয় তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো টেবিলে কী কথা হয়৷ রাজনীতিবিদদের বাইরের কথায় কূটনৈতিক সম্পর্কে সব সময় প্রভাব পড়ে বলে আমার মনে হয় না৷’’

তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপ কেন,আমাদের নিজেদের স্বার্থেই সামনে একটি ভালো নির্বাচন দরকার৷ সামনের দিনগুলোতে সরকারের যেমন দায়িত্ব আছে, বিরোধী দলেরও দায়িত্ব আছে৷ সরকারকে যেমন পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে, বিরোধী দলও পর্যবেক্ষণের বাইরে নেই৷’’

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য