অর্থনীতি কি রাজনীতির কাছে পরাজিত হবে?
১ জানুয়ারি ২০১৮বাংলাদেশে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের প্রতি বরাবরের চেয়ে এবারের আগ্রহ অনেক বেশি৷ এটা রাজনৈতিক দল ও দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে যেমন, তেমনই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যেও৷ কারণ ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচন ছিল একতরফা৷ ঐ নির্বাচনে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং তাদের জেটের শরিকরা অংশ নেয়নি৷ ফলে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগীরা একতরফাভাবে নির্বাচনে জয় পায়৷ এমনকি ১৫৪ আসনে কোনো নির্বাচনেরই প্রয়োজন হয়নি, প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন৷
বিএনপি নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে নির্বাচন বয়কট করে৷ কিন্তু তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সেই দাবি না মেনে সংবিধান এবং সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার কথা বলে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে৷ সেই নির্বাচন বর্জনই নয়, নির্বাচন ঠেকাতে বিএনপি ও তার সহযোগী জামায়াত দেশে ব্যাপক সহিংসতা চালায়৷ অভিযোগ অন্তত এমনটাই৷
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে এখনো দূরত্ব প্রবল৷ কিন্তু একটি সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিয়ে কোনো মতবিরোধ নেই৷ আওয়ামী লীগ বলছে, নির্বাচন হবে সংবিধান অনুয়ায়ী বর্তমান সরকারের অধীনে৷ আর বিএনপির দাবি, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন৷
কিন্তু এই দাবি নিয়ে যত দূরত্বই থাকুক না কেন, নির্বাচনটা এখন দুই বড় দলের জন্যই প্রয়োজন৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. শান্তনু মজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘২০১৪ সালের মতো নির্বাচন বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও চায় না৷ কারণ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে আগামী নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করতে হলে আগামী নির্বাচন হতে হবে অংশগ্রহণমূলক৷ তাই সবদলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের চাপ আছে ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকেই৷ এছাড়া বিএনপি এবার নিজে থেকেই নির্বাচনের বাইরে থাকবে না দলের স্বার্থে৷ কারণ বিএনপি যে ধরনের দল, তাতে দীর্ঘদিন সংসদ বা ক্ষমতার বাইরে থাকলে তাদের অস্তিত্বই নড়বড়ে হয়ে পরতে পারে৷''
তাই তিনি বলেন, ‘‘২০১৮ সাল নির্বাচনের বছর৷ দেশের রাজনীতিতে নির্বাচন প্রাধান্য বিস্তার করবে৷ দুই দলই চাইবে তাদের অবস্থান সংহত করতে৷ দুই দলই চাইবে দর কষাকষির মাধ্যমে নির্বাচনে সুবিধা নিতে৷ দুই দলই চাইবে ক্ষমতা৷ তবে এই দ্বন্দ্ব উত্তাপ ছড়ালেও অতীতের মতো সহিংস হবে বলে মনে হয় না৷ কারণ নির্বাচন না হলে তা দু'পক্ষের জন্যই ক্ষতিকর হতে পারে৷''
এই রাজনীতির সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রয়েছে অর্থনীতিরও৷ রাজনীতির আকাশে মেঘ থাকলে তা অর্থনীতিকেও মেঘাচ্ছন্ন করে৷ তাছাড়া গণতান্ত্রিক চর্চা অর্থনীতিকেও বেগবান করে৷
এবার মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে বাংলাদেশ৷ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএস-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ সালে জিডিপিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ, যেখানে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ দশমিক ২৷ অর্থাৎ এ বছর ২০১৫-১৬ সালের তুলনায় ০ দশমিক ১৭ ভাগ বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে৷ ফলে জিডিপির আকার বেড়ে হয়েছে ২৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার৷ বাংলাদেশের মানুষের এখন মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৬১০ মার্কিন ডলার৷ বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ২৮ হাজার ৮০০ টাকা৷
কৃষি খাতে ২ দশমিক ৯০ শতাংশ, শিল্প খাতে ১০ দশমিক ২২ শতাংশ এবং সেবা খাতে ৬ দশমিক ৬৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে৷ অথচ এবার বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে ৯ লাখ টন ধান উৎপাদন কম হয়৷
শিল্পখাতে প্রবৃদ্ধি কমেছে৷ ২০১৫-১৬ সালে এই খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ০৯ ভাগ৷ এবার প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ২২ ভাগ৷ সরকারি বিনিয়োগ বেড়েছে শতকরা ০ দশমিক ৭৫ ভাগ৷ তবে এডিপি বাস্তবায়নের হার কমেছে৷
কিন্তু সেবাখাতে প্রবৃদ্ধি আগের বছরের তুলনায় এ বছর বেশি হয়েছে৷ সংখ্যার বিচারে ৬ দশমিক ৫৯ ভাগ, ২০১৫-১৬ সালে যা ছিল ৬ দশমিক ২৫ ভাগ৷
জিডিপিতে এখন কৃষির অবদান ১৪ দশমিক ৭৪ ভাগ আর সেবাখাতের অবদান ৫২ দশমিক ৫৮ ভাগ৷ ফলে সেবাখাত এখন বাংলাদেশের জিডিপির নির্ণায়কের ভূমিকায় চলে গেছে৷
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম৷ সম্প্রতি বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন মাপকাঠি প্রকাশের পাশাপাশি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে একটি তথ্যচিত্রও তৈরি করেছে তারা৷ তাতে বাংলাদেশকে ‘নতুন এশিয়ান টাইগার' হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে৷
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের তথ্যচিত্রে বলা হয়েছে, গত ১০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রতিবছরই গড়ে ছয় শতাংশ করে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে৷ এ প্রবৃদ্ধির অধিকাংশই টেক্সটাইল শিল্প থেকে এসেছে৷ বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক থেকে৷ ইউরোপের বাজারে চীনের ‘লো এন্ড' শিল্প খাতের ৬৬ শতাংশ এখন বাংলাদেশ নিয়ে নিয়েছে৷ বাংলাদেশের সম্ভাবনা রয়েছে ম্যানুফ্যাকচারিং ও ইলেক্ট্রনিক্স শিল্পেও৷
বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নতি করলেও কিছু বাধা দূর করতে পারলে বাংলাদেশের আরও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সম্ভব৷ এর মধ্যে রয়েছে বিনিয়োগের পরিবেশ ও অবকাঠামো উন্নয়ন৷ বলা হয়েছে, বর্তমানে বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে ৪০০ দিন সময় লাগে৷ দেশের ২০ শতাংশ এলাকায় স্থিতিশীল বিদ্যুৎ সংযোগ নেই৷ এছাড়া উচ্চমাত্রায় দুর্নীতির কারণেও ব্যবসা-বাণিজ্য করা কঠিন৷ কিছু প্রতিবন্ধকতার পরও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা অত্যন্ত ভালো৷ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহ ক্রমে বাড়ছে৷ এ সবকিছুই হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতির দ্রুত বিকাশমান গতির কারণে৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান সম্প্রতি তাঁর এক নিবন্ধে বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি প্রকৃতি তুলে ধরেছেন৷ তিনি বলছেন, ১৯৯০ সালে শীর্ষ অর্থনীতির আকারের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৫০৷ ২০১৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশ ৩১তম স্থানে চলে আসে৷ অর্থনীতির পূর্বাভাষে বলা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ পৃথিবীতে ২৮তম বৃহত্তম অর্থনীতি এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ২৩তম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে৷
সপ্তম পঞ্চবার্ষিকি পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২০ সালের মধ্যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করার কথা৷ সরকারি নানা পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৩০ সাল নাগাদ প্রবৃদ্ধির হার ৯-১০ শতাংশ হওয়ার কথা৷ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) আলোকে ২০৩০ সালের মধ্যে অনেক কঠিন অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত লক্ষ্য অর্জনের কর্মসূচি রয়েছে৷
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা বিআইডিএস-এর অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শতকরা ৭ ভাগের ওপর প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি আমরা গত দু'বছরে৷ তাতে বাহ্যিকভাবে আমাদের মনে হবে অর্থনেতিক সূচকগুলো ভালোভবেই কাজ করছে৷ কিন্তু আমরা যদি কৃষি উৎপাদন দেখি তাহলে দেখব যে, ২০১৭ সালে কৃষিপণ্যের, বিশেষ করে চালের দাম আমরা নিয়ন্ত্রণে রাখত পারিনি৷ চালের যে দাম বেড়েছে, তা কিন্তু আর কমেনি৷ হাওড়ের বন্যা সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ধানের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ আমি মনে করি, ২০১৮ সালে চালের দাম অর্থনীতির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে৷ রপ্তানি বাণিজ্যেও চ্যালেঞ্জ থাকবে৷ এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের তৈরি পোষাক শিল্পে যে উন্নয়ন ঘটেছে বিশ্বব্যাপী তার প্রচার প্রচারণা দরকার৷''
তিনি বলেন, ‘‘আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার একটা চেষ্টা এখন দেখা যাচ্ছে৷ ব্যাংকগুলোর আর্থিক দুর্নীতি বন্ধের একটা তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়৷ খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনার কথা বলা হচ্ছে৷ এগুলো যেন বাস্তবেই হয়৷ আর রোহিঙ্গার চাপ অর্থনীতিতেও পড়বে৷ তবে এর ইতিবাচক দিক আছে৷ সেটা আর্থিক সহায়তার বিষয় নয়৷ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরো সম্প্রসারিত করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এতে৷''
তবে ড. নাজনীন মনে করেন, ‘‘রাজনীতির ওপর নির্ভর করছে অর্থনীতি৷ ২০১৮ নির্বাচনের বছর৷ আমাদের দেখতে হবে রাজনীতির কাছে যেন অর্থনীতি পরাজিত না হয়৷ তা যদি না হয়, তাহলে আমাদের অর্থনীতির সামনের দিনগুলো সম্ভাবনাময়৷''
ড. শান্তনু মজুমদার মনে করেন, ‘‘এবার সহিংসতা নয়, দুই প্রধান রাজনৈতিক দলই নির্বাচন চায়, নির্বাচনে থাকতে চায়৷ তাই নির্বাচন বাধাগ্রস্ত হয় তেমন কিছু তারা করবে না৷ তারা চেষ্টা করবে ক্ষমতা ধরে রাখতে বা ক্ষমতায় যেতে৷ আর সেটা নিয়েই হয়ত রাজনীতি ২০১৮ সালে আরো মুখর হবে৷''
এ বিষয়ে আপনার কোনো মন্তব্য থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷