‘হিন্দু পাকিস্তান' হওয়ার পথে ভারত?
৩১ জুলাই ২০১৯ইন্দোনেশিয়ার পর ভারতেই মুসলিম জনসংখ্যা সবচেয়ে বেশি৷ দেশটিতে এখন প্রায় সাড়ে ১৯ কোটি মুসলিমের বাস৷ পিউ রিসার্চ সেন্টারের করা এক গবেষণা দেখা গেছে ২০৬০ সালের মধ্যে ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা দাঁড়াবে ৩০ কোটিরও বেশি৷ অর্থাৎ মাত্র দুই জেনারেশন পরেই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ইসলাম ধর্মাবলম্বীর দেশ হবে ভারত৷
কিন্তু অন্য সব ধর্মের তুলনায় মুসলিমদের সংখ্যাবৃদ্ধির হার বেশি হলেও ভারতের সংখ্যালঘুদের মধ্যে এখন তারাই সবচেয়ে বেশি শঙ্কার মধ্যে রয়েছেন৷ ২০১৪ সালে বিজেপির নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে ভারতের মুসলিমরা একটু অস্বস্তির মধ্যেই দিন কাটাচ্ছেন৷ ২০০২ সালে গুজরাটে মুসলিমবিরোধী আন্দোলনে তার সম্পৃক্ততা এবং তার দলের কয়েক দশকের হিন্দু জাতীয়তাবাদী প্রচারণাই এর মূল কারণ৷
মোদি অবশ্য প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি ‘সব ভারতীয়র' প্রধানমন্ত্রী বলে মুসলিমদের আশ্বাস দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন৷ কিন্তু পাঁচ বছর পর দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর অবস্থাটা আসলে কী দাঁড়িয়েছে?
মোদির প্রথম শাসনামলে মুসলিমবিরোধী সহিংসতা উগ্র রূপ নিয়েছিল, এ নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই৷ গরুর মাংস খাওয়ার অভিযোগে অন্তত ৪০টি হত্যার ঘটনা ঘটেছে৷ এই ঘটনাগুলোর বেশিরভাগেরই কোনো বিচারও হয়নি৷ ফলে সংখ্যালঘুদের ‘চাইলেই নির্যাতন করা যায়', এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে৷
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানের মতো মৌলিক কিছু বিষয়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে কৌশলগতভাবে বৈষম্য তৈরি করা হয়েছে, যা গণমাধ্যমেও ঠিকমতো আসেনি৷ এই বৈষম্য সবসময়ই ছিল, কিন্তু বিজেপির অধীনে তা ভারতের মাটিতে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে৷ এর ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলিমদের মধ্যে নিজেদের অবাঞ্ছিত মনে করার এক ধরনের প্রবণতা তৈরি হয়েছে৷ বিশেষ করে উত্তর ভারতে মুসলিমরা নিজেদের ভিটেমাটিতেই আর নিরাপদ বোধ করেন না৷
পাকিস্তানকে নিজেদের ঘোর শত্রু হিসেবে উপস্থাপন করে নির্বাচনী প্রচারণা জিতেছেন মোদি৷ কিন্তু অনেক বিশ্লেষকই বলছেন, ধীরে ধীরে ভারতের সংবিধান থেকে দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর রেখে যাওয়া সেক্যুলারিজম মুছে ফেলে হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই বিজেপির মূল লক্ষ্য৷
কয়েক শতকের সহাবস্থান হুমকিতে
তবে, ভারতে যেমন অসহিষ্ণুতা বেড়ে চলেছে, এর বিপরীত দিকে সহাবস্থানের চিত্রও একেবারে কম নয়৷ যেমন ভারতের রাজস্থানে আজমির শরিফে সুফি সাধক মইনুদ্দিন চিশতির দরগায় এখনও দেখা যায় নানা ধর্মের মানুষের ভিড়৷ শুধু মুসলিম না, উপমহাদেশের নানা স্থান থেকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাও সেখানে নিয়মিতই আসেন নানা মানত নিয়ে৷ সবার জন্মস্থান ভারতে প্রচুর হিন্দু, শিখ এবং খ্রিস্টানরাও চিশতিকে একজন গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে শ্রদ্ধা করে থাকেন৷
ভারতে চলমান অসহিষ্ণুতার অনেকটাই ভুলে যাওয়া যায় আজমির শরিফে গেলে৷ প্রায় প্রতি বিকেলেই প্রার্থনাকারীরা কাওয়ালি গায়কদের চারপাশে ভিড় করে থাকেন৷ একদিকে ধুপের গন্ধ, অন্যদিকে রাতের আকাশ ভর্তি তারার মেলা৷ কাওয়ালি গায়কেরা নানা সুফি শিল্পীর লেখা গান সুর করে করে গেইতে থাকেন, এর সঙ্গে চলতে থাকে প্রার্থনা৷ নারী-পুরুষরা একসাথে বসেই যোগ দেন সে উপাসনায়৷ এর মধ্যে কে মুসলিম, কে নন, তা বুঝে ওঠা মুশকিল৷ মইনুদ্দিন চিশতির এই দরগাই ভারতীয় উপমহাদেশে কয়েক শতক ধরে চলে আসা ধর্মীয় সম্প্রীতির চিত্র৷
ভারত ও পাকিস্তানের বেশ কিছু সুফি দরগায় এই চিত্র এখনও দেখা যায়৷ দক্ষিণ এশিয়ায় এসে হিন্দু ধর্ম থেকে অনেক কিছুই নিয়েছে ইসলাম৷ এর ফলে সৃষ্টি হয়েছে নতুন এক ধরনের নমনীয় ইসলামের৷ যেমন মইনুদ্দিন চিশতির শিক্ষাগুলোর অন্যতম হচ্ছে ‘সবার জন্য ভালোবাসা, কারো জন্য ঘৃণা নয়৷'
দরগার পেছনেই শহরের ব্যস্ত গলিতে চিশতি ফাউন্ডেশনের অবস্থান৷ ফাউন্ডেশনের করা কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম আন্তসংস্কৃতি ও আন্তধর্ম সংলাপের আয়োজন করা৷ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সায়েদ সালমান চিশতি বলেন, ‘‘আজমির একটি শান্তির জায়গা এবং ভারতের জন্য একটি আশা হয়ে টিকে রয়েছে৷''
সেখানেই এক সেমিনারে সম্প্রতি আজমিরের পাঁচ লাখেরও বেশি বাসিন্দা অংশ নেন৷ ইউনাইটেড রিলিজিয়নস ইনিশিয়েটিভ নেটওয়ার্কের আমন্ত্রণে এক মুসলিম শেখ, হিন্দু পুরোহিত, শিখ ধর্মীয় নেতা এবং আরো কয়েকজন ধর্মগুরু উপস্থিত হয়েছিলেন৷ প্রার্থনার পর ভারতে ধর্মীয় সম্প্রীতি টিকিয়ে রাখার নানা উপায় নিয়ে তারা আলোচনা করেন৷ নিজের বক্তব্য শেষ করে শিখ ধর্মগুরু বলেন, ‘‘ভারতের কাছ থেকে শিখতে পারে পুরো বিশ্ব৷''
এইসবই কেবল মুখের কথা বলে মনে হতে পারে৷ কিন্তু হিন্দুত্ববাদও যেমন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে, বিপরীতে এমন সম্প্রীতির উদাহরণ ছড়িয়ে দেয়ার প্রয়োজনীয়তাও বেড়ে চলেছে৷ জনগণ, সুশীল সমাজসহ সবাই সচেতন না থাকলে যেকোনো মুহূর্তে ভারতের বহুত্ববাদ পড়তে পারে হুমকির মুখে৷
ইন্ডিয়ান টেলিগ্রাফে এক লেখায় প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও রাজনীতি বিশ্লেষক রামচন্দ্র গুহ বলেছেন, ভারতের সংবিধানে যে বহুত্ববাদের কথা বলা হয়েছে, তা এখনও সব আশঙ্কা সত্ত্বেও অটুট রয়েছে৷ কিন্তু তিনি একই সঙ্গে সতর্কও করে দিয়েছেন, ‘‘ভারত এখনও হিন্দু পাকিস্তানে পরিণত হয়নি৷ কিন্তু অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে সেই পথে যাওয়ার সবচেয়ে বেশি আশঙ্কায় রয়েছে৷''
মারিয়ার ব্রেমার/এডিকে
© কানতারা.ডিই ২০১৯