হারিয়ে যেতে বসা যাত্রাশিল্পে আলো ফেরানোর উৎসব
আবহমান বাংলার চিরায়ত লোকসংস্কৃতি যাত্রাপালা কালের আবর্তে হারিয়ে যেতে বসেছে। তাই যাত্রাশিল্পে প্রাণ সঞ্চারের প্রয়াস থেকে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চে হয়ে গেল সপ্তাহব্যাপী উৎসব। ছবিঘরে দেখুন বিস্তারিত...
উৎসবের ৭ যাত্রাপালা
উৎসবে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে নিবন্ধিত সাতটি যাত্রাদল প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টায় ঐতিহাসিক ও সামাজিক ঘটনা অবলম্বনে একটি করে যাত্রাপালা পরিবেশন করেছে। এগুলো হলো সুরুভী অপেরার ‘নিহত গোলাপ’, নিউ শামীম নাট্য সংস্থার ‘আনারকলি’, বঙ্গবাণী অপেরার ‘মেঘে ঢাকা তারা’, নর-নারায়ণ অপেরার ‘লালন ফকির’, বন্ধু অপেরার ‘আপন দুলাল’, শারমিন অপেরার ‘ফুলন দেবী’ ও যাত্রাবন্ধু অপেরার ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’।
মঞ্চের সামনে-পেছনে
হেমন্তের হিম হিম সন্ধ্যায় প্রতিটি যাত্রাদলের পালা মঞ্চায়নের আগে একটি করে দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করা হয়েছে। মঞ্চের দুই পাশে ঢাক-ঢোল, বাঁশি, সানাই, খঞ্জনি ও ঝুনঝুনি বাদকরা সুরের মূর্ছনায় তৈরি করেন যাত্রার আবহ। পেছন থেকে মঞ্চে এসে দর্শক মন জয় করেন একের পর এক যাত্রাশিল্পী। একপাশে বসে খাতা দেখে শিল্পীদের সংলাপ মনে করিয়ে দেন প্রম্পটার। ব্যস্ত সময় কেটেছে স্বেচ্ছাসেবী, শব্দ ও আলোকসজ্জায় নিয়োজিতদের।
চার দেয়ালের বাইরে
‘যদি তুমি ভয় পাও তবে তুমি শেষ, যদি তুমি রুখে দাঁড়াও তবে তুমি বাংলাদেশ’ প্রতিপাদ্য নিয়ে ঢাকার সোহরাওয়ার্দীর উদ্যানের মুক্তমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয়েছে যাত্রা উৎসব। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নাট্যকলা ও চলচ্চিত্র বিভাগের ব্যবস্থাপনায় ১ নভেম্বর থেকে ৭ নভেম্বর সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল এই আয়োজন। উৎসব উদ্বোধন করেন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আহত রিকশাচালক ইসরাফিল মজুমদার।
‘যাত্রাপালা দেখে নৈতিকতার শিক্ষা পেয়েছি’
যাত্রা পরিবেশন করা প্রতিটি দলের স্বত্বাধিকারীর হাতে উৎসবের পোস্টার স্মারক তুলে দেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক ড. সৈয়দ জামিল আহমেদ। তিনি সবাইকে যাত্রাশিল্পীদের পাশে থাকার আহ্বান জানান। তার কথায়, ‘শৈশবে সামাজিক যাত্রাপালা দেখে আমরা নৈতিকতার শিক্ষা লাভ করেছি। সময়ের পরিক্রমায় যাত্রাশিল্পকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা হয়েছে। আমরা চাই, রাষ্ট্রীয় নীতিমালার আলোকে সারা দেশে যাত্রা হোক।’
‘যাত্রাপালা আয়োজনে বাধা দেন জেলা প্রশাসকরা’
যাত্রাশিল্পে চলমান সংকটের মূল কারণ হিসেবে প্রশাসনিক বাধাকে সামনে আনলেন শিল্পকলা একাডেমির নাট্যকলা ও চলচ্চিত্র বিভাগের পরিচালক ফয়েজ জহির। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গ্রামে এখন যাত্রা আয়োজন করতে গেলে নিরাপত্তাজনিত কারণে জেলা প্রশাসক বাধা দেন। ফলে যাত্রাশিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত দল ও শিল্পীরা দীর্ঘদিন ধরে ভীষণ সংকটের মধ্যে আছে। তাই মুক্তমঞ্চে যাত্রা উৎসব করে আমরা দেখাতে চেয়েছি, এই শিল্পে অশ্লীলতা নেই।’’
দর্শক সমাগম
উৎসবের প্রথম সন্ধ্যাসহ প্রতিদিনই দর্শকদের উপচে পড়া ভিড়ে তিল ধারণের জায়গা ছিল না মুক্তমঞ্চে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, শিশু-কিশোরসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ মুক্তমঞ্চে পাশাপাশি বসে যাত্রাপালা উপভোগ করেন। বিপুলসংখ্যক দর্শক উপস্থিতিই বলে দিয়েছে যাত্রাপালা নিয়ে এখনও দর্শকদের আগ্রহ ব্যাপক। খোলা আকাশের নিচে যাত্রা দেখতে এসে কারও কারও মনে উঁকি দিয়েছে সোনালি স্মৃতি।
‘মাইলের পর মাইল হেঁটে যাত্রা দেখতে যাওয়া হতো’
উৎসবে তৃতীয়, চতুর্থ ও সমাপনী সন্ধ্যায় যাত্রা দেখেছেন আজিমপুরের বাসিন্দা সুমনা রহমান। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘টিভিতে কিছু যাত্রা দেখেছি। সামনাসামনি এবারই প্রথম দেখলাম। ঢাকায় উন্মুক্ত মঞ্চে প্রথমবার যাত্রা হলো। আমার ভাইয়ের মুখে শুনতাম, তারা ছোটবেলায় গ্রামে মাইলের পর মাইল হেঁটে যাত্রা দেখতে যেতেন। এখন আর সেই চিত্র দেখা যায় না। কিন্তু যাত্রাকে টিকিয়ে রাখতে হলে যাত্রাশিল্পীদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে।’’
‘১৮-১৯ মাইল দূরে যাত্রা দেখাতে নিয়ে যেতেন শিক্ষক’
যাত্রা উৎসবকে খুবই ভালো একটি উদ্যোগ মনে করেন জুরাইনের ব্যবসায়ী সোহাগ তালুকদার। তিনি সমাপনীতে এসে স্মৃতি রোমন্থন করে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ছোটবেলায় গ্রামে আমার শিক্ষক বাড়ি থেকে ১৮-১৯ মাইল দূরে যাত্রা দেখাতে নিয়ে যেতেন। শিল্পকলা একাডেমি যাত্রাকে এভাবে খোলা জায়গায় নিতে পারলে সুফল মিলবে। সুস্থধারার যাত্রাপালার চর্চা ও পরিবেশনার মাধ্যমে অশ্লীলতার জুজু কেটে যাবে।’’
যাত্রাশিল্পের মুমূর্ষু অবস্থা
ঐতিহ্যবাহী যাত্রাশিল্প একসময় সারা বাংলাদেশে অনেক বেগবান ছিল। কিন্তু যাত্রার সেই সোনালি সময় আর নেই। এখন কালেভদ্রে যাত্রাদলের ডাক আসে। যাত্রাশিল্পের অবস্থা মুমূর্ষুপ্রায়। যাত্রাশিল্পীদের জীবন এখন সংকটাপন্ন। জীবিকার তাগিদে ভিন্ন পেশা বেছে নিয়েছেন তারা। কেউ কেউ পুরোপুরিভাবে অন্য কাজ বেছে নিয়ে এই পেশা থেকে ঝরে গেছেন। বন্ধ হয়ে গেছে অনেক দল। শিল্পকলা একাডেমিতে এখন নিবন্ধিত যাত্রাদলের সংখ্যা ২০৫টি।
‘যাত্রা ছিল পেশা, এখন হয়ে গেছে শখ’
‘নিহত গোলাপ’ যাত্রাপালার নির্দেশক কবির খান এখন ফার্মের ব্যবসা করেন। তবে যাত্রার ডাক পেলে অন্য শিল্পীদের মতো তিনিও ছুটে যান। কবির খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আগে যাত্রা করা ছিল আমাদের পেশা। এখন সেটা হয়ে গেছে শখ। কারণ যাত্রাশিল্প খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। এ কারণে সংসার চালাতে ভিন্ন পথ অবলম্বন ছাড়া উপায় নেই কারও। আমাদের দাবি, সারা দেশে যাত্রাপালা আগের মতো রমরমা করার উদ্যোগ যেন নেয় শিল্পকলা একাডেমি।’’
শিল্পীর পরামর্শ
উদ্বোধনী আয়োজনে বিশেষ অতিথি হিসেবে আসা বিশিষ্ট যাত্রাশিল্পী অণিমা দে ডয়চে ভেলেকে জানালেন, মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকে যাত্রাপালা করতেন তিনি। তার ভাষ্য, ‘‘আবার নতুনভাবে শুরু হোক যাত্রা। শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। তাদের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে পালা করার সুযোগ দিতে হবে। তারা যাত্রায় বাঁচুক। তাছাড়া অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়ে তোলায় যাত্রাশিল্প যুগে যুগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।’’
কেবল একটি উৎসব যথেষ্ট নয়
গ্রামীণ জনসাধারণের একমাত্র বিনোদন ছিল যাত্রাপালা। সেই ঐতিহ্য বিলুপ্ত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তাই সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, রাজধানীতে বছরে কেবল একটি উৎসবের মাধ্যমে আয়োজকরা যাত্রাশিল্পের কল্যাণ সাধন করে ফেলার তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললে সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা কম। আগের মতো গ্রামে-গঞ্জে যাত্রাকে ফেরানোর চেষ্টা করতে হবে শিল্পকলা একাডেমিকে।
‘ছয় মাস নিয়মিত যাত্রা হলে সচ্ছল হতে পারবো’
বরিশাল থেকে ঢাকায় এসেছেন যাত্রাশিল্পী পূরবী দত্ত। উৎসবটির মাধ্যমে একবছর পর আবারও যাত্রার মঞ্চে উঠলেন। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমার মা-বাবা যাত্রা করতেন। তাদের হাত ধরে মঞ্চে শিশুশিল্পী হিসেবে প্রথম উঠেছিলাম। সেই থেকে যাত্রা করে যাচ্ছি। এখন যাত্রাপালার নিভু নিভু দীপ কোনও রকম জ্বালিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে। এভাবে টিকে থাকা মুশকিল।’’
যাত্রাদলের সম্মানী
একসময় প্রতিটি দলের মহড়াকক্ষ ছিল। কিন্তু এখন শিল্পীরা একেক জন একেক জেলায় থাকেন। তাদের একত্র করে যাত্রাপালা মঞ্চায়ন করা ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার। এবারের উৎসবে যাত্রাপালা মঞ্চায়ন করা প্রতিটি দল শিল্পকলা একাডেমির কাছ থেকে সম্মানী পেয়েছে ৭০ হাজার টাকা। খরচের তুলনায় এই অঙ্ক অপ্রতুল।
যাত্রার নবযাত্রা
যাত্রা মালিকরা এবারের উৎসবকে যাত্রার নবযাত্রা হিসেবে দেখছেন। বাংলাদেশ যাত্রা উন্নয়ন মালিক সমিতির সভাপতি ও বাংলাদেশ যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সোহেল হায়দার খান জসিম আশার কথা শোনালেন। তার তথ্যানুযায়ী, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চের পর এবার যশোরের মণিরামপুরে সাত দিন যাত্রা হবে। তারপর রাজশাহী, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামে যাত্রা উৎসব হবে।
টিভিতে যাত্রাপালা
ছোট পর্দায় যাত্রাপালা নিয়ে খুব কম কাজই দেখা গেছে। মামুনুর রশীদের বাঙলা টেলিফিল্মের নিবেদনে বহু বছর আগে তৈরি হয়েছিল ধারাবাহিক নাটক ‘দি নিউ সবুজ অপেরা’। এতে একটি যাত্রাদলের গল্প তুলে ধরা হয়েছে। মামুনুর রশীদের মূল ভাবনায় এটি রচনা করেন বৃন্দাবন দাস। বিটিভিতে অতীতের মতো এখনও যাত্রাপালা দেখানো হয়। এখন দেখানো প্রতি মাসের প্রথম রবিবার দুপুর আড়াইটায়৷ মাঝে করোনার কারণে দেড় বছরেরও বেশি সময় এটি বন্ধ ছিল।