হতাশায় শেষ পাকিস্তানের বিশ্বকাপ মিশন
১১ নভেম্বর ২০২৩পাকিস্তানের ১৯৯২ বিশ্বকাপ জয়টা রুপকথাই ছিল৷ যার নেতৃত্বে এই সাফল্য সেই অদম্য অধিনায়ক ইমরান খানের চরিত্র ‘লার্জার দেন লাইফ'৷
ইমরান খানের চরিত্রের ছিঁটেফোটা নেই বাবর আজমের মধ্যে৷ তবে তিনিও প্রেরণা খুঁজছিলেন ১৯৯২ বিশ্বকাপ থেকে৷ মঞ্চটা প্রস্তুত ছিল৷ উদ্দীপ্ত ছিলেন সতীর্থরা৷ কিন্তু রুপকথা তো আর রোজ হয় না৷ ফেভারিট হয়ে আসা পাকিস্তান তাই বিদায় নিল সেমিফাইনালের আগে৷
নিউজিল্যান্ডের নেট রান রেট টপকে শেষ চারের টিকিটের জন্য ইংল্যান্ডের ৩৩৭ রানের চ্যালেঞ্জ ৪০ বলে পেরিয়ে যেতে হত পাকিস্তানকে! প্রতি বলে ছক্কা মারলেও যা অসম্ভব৷ পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত অলআউট হয়েছে ২৪৪ রানে৷ ডেভিড উইলির উইকেট ৩টি৷ ৯ ম্যাচে ৮ পয়েন্ট নিয়ে পাঁচে থেকে বিশ্বকাপ অভিযান শেষ হল পাকিস্তানের৷ আর ৬ পয়েন্ট পাওয়া ইংল্যান্ড সেরা আটে থেকে নিশ্চিত করল চ্যাম্পিয়নস ট্রফি৷
সেমিফাইনালের লাইন আপ নিশ্চিত হয়ে যায় ৬.৪ ওভারে পাকিস্তানের ২ উইকেটে ৩০ রানের পরই৷ শীর্ষে থাকা ভারত ১৫ নভেম্বর মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে খেলবে চার নম্বর দল নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে৷ পরদিন কলকাতার ইডেনে দ্বিতীয়স্থানে থাকা সাউথ আফ্রিকার প্রতিদ্বন্দ্বী অস্ট্রেলিয়া৷
পাকিস্তান '৯২ ফেরাতে না পারলেও ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংস শেষে ঠিকই ফিরে এসেছিল সেই বিশ্বকাপের স্মৃতি৷ সেবার সেমিফাইনালে বৃষ্টি আইনে ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই ৭ বলে ২২ থেকে ১ বলে ২২ রানের লক্ষ্য পেয়েছিল সাউথ আফ্রিকা (স্কোরে এটা দেখালেও আসলে ১ বলে ২১)! সেটা যেমন অসম্ভব ছিল তেমনি ৩১ বছর পর পাকিস্তানের ৪০ বলে ৩৩৮ রানের লক্ষ্যটাও অচিন্তনীয়৷ উল্টো এই রান পাহাড়ে চাপাই পড়েছে বাবর আজমের দল৷
এবারের বিশ্বকাপটা প্রতিবাদের মঞ্চ হিসাবে বেছে নিতে চেয়েছিলেন বাবর আজমরা৷ কারণ ভারতে আসার আগে ক্রিকেটারদের বেতন হয়নি চার মাস! চড়ছিল ক্ষোভের পারদ৷ খেলোয়াড়রা হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন বিশ্বকাপে জার্সি থেকে স্পনসরের লোগো খুলে ফেলার৷
একেবারে শেষ বেলায় প্রধান নির্বাচক ইনজামাম উল হকের মধ্যস্থতায় বাবরদের অনেক দাবি মেনে নেয় পিসিবি৷ ব্যবসায়িক স্বার্থের সংঘাতে সেই ইনজামাম উল হককে নিয়ে সমালোচনা হচ্ছিল পাকিস্তানি মিডিয়ায়৷ বিশ্বকাপ চলার সময়ই পদত্যাগ করেন তিনি৷
এমন একের পর এক বিতর্ক বিশ্বকাপজুড়ে ছিল পাকিস্তানের সঙ্গী৷ টানা চার ম্যাচ হেরে প্রশ্নের মুখে পড়েছিল বাবর আজমের নেতৃত্ব৷ গুঞ্জণ ওঠে বিশ্বকাপের মাঝেই তাঁর অধিনায়কত্ব হারানোর৷ তৈরি হয় দমবন্ধ পরিস্থিতির৷
অথচ বিশ্বকাপের কিছুদিন আগেও ওয়ানডে র্যাংকিংয়ে শীর্ষে ছিল পাকিস্তান৷ আট ম্যাচ পর্যন্ত বাবর ছিলেন র্যাংকিংয়ের শীর্ষ ব্যাটসম্যান আর শাহীন শাহ আফ্রিদি সেরা বোলার৷ তবু টুর্নামেন্ট জড়ে কটাক্ষ, টিপ্পনী, সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে তাঁদের৷ পাকিস্তান নিজেদের ব্র্যান্ডের ক্রিকেটটা খেলতে না পারাতেই এমন সমালোচনা৷ বিশ্বকাপের ব্যর্থ অভিযানের পর তাই নিশ্চিতভাবে ঝড় উঠতে চলেছে দেশটির ক্রিকেটে৷
আজ ইডেনে টসের পরই যেন শেষ হয়ে যায় ম্যাচের আকর্ষণ! জস বাটলারের দল শাহীন শাহ আফ্রিদি, হারিস রউফদের সামলে ৯ উইকেটে ৩৩৭ রান করার পরই কার্যত ছিটকে পড়ে পাকিস্তান।
কারণ সেমিফাইনালে যেতে বাবর আজমদের রানটা তাড়া করতে হতো ৬.৪ ওভারে বা ৪০ বলে! এটা শুধুই কাগজে কলমের অংক, বাস্তবে যেন কোনো পর্বতের অজেয় চূড়া৷ ২০১৯ বিশ্বকাপের মত এবারও তাই সেমিফাইনালের আগে ছিটকে গেল পাকিস্তান৷ ফেভারিট হয়ে আসা কোনো দলের জন্য যা হৃদয় ভাঙার আরেকটা উপাখ্যান৷
২০১৯ বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের সমান ১১ পয়েন্ট ছিল পাকিস্তানের৷ সেমিফাইনালে পৌঁছাতে শেষ ম্যাচে বাংলাদেশকে হারাতে হতো ৩১৬ রানে৷ লর্ডসে গুরুত্বপূর্ণ সেই ম্যাচে তারা করেছিল ৩১৫৷ ৯৪ রানে জিতলেও তাই সেমিফাইনাল খেলা হয়নি৷
আজ ইংল্যান্ডের ৩৩৭ রানের জবাবে ডেভিড উইলির প্রথম ওভারেই ০ রানে এলবিডাব্লিউ আব্দুল্লাহ শফিক৷ নিজের পরের ওভারে ফখর জামানকেও (১) ফেরান উইলি৷ বাবর আজম প্রত্যাশা অনুযায়ি খেলতে পারেননি বিশ্বকাপজুড়ে৷ শেষ ম্যাচেও ৩৮ করে গাস অ্যাটকিনসনের বলে শর্ট মিডউইকেটে ক্যাচ দেন আদিল রশিদকে৷ এবারের বিশ্বকাপে কেবল ৩২০ রানই করেছেন বাবর, সর্বোচ্চ ৭৪ আফগানিস্তানের বিপক্ষে৷
বাবরের চেয়ে কিছুটা ভালো বিশ্বকাপ কেটেছে মোহাম্মদ রিজওয়ানের৷ একটি সেঞ্চুরিসহ ৬৫.৮৩ গড়ে তাঁর রান ৩৯৫৷ আজ ৫১ বলে ৩৬ করে তিনি বোল্ড হন মঈন আলীর বলে৷ সউদ শাকিল ২৯ করে বোল্ড আদিল রশিদের বলে৷ চরম বিপর্যয়েও কিছুটা প্রতিরোধ গড়েন সালমান৷ তবে ইনিংসটা বড় করতে না পেরে ফেরেন ৫১ রানে৷
সালমানের পর শাহীন শাহ আফ্রিদি ২৫ করে ফেরার পর শেষ উইকেটে হারিস রউফ আর মোহাম্মদ ওয়াসিম গড়েন ৫৩ রানের জুটি৷ পাকিস্তানের স্কোরটা তাতে পৌঁছে ২৪৪-এ৷
আজ নিউজিল্যান্ডের নেট রান রেট ছাড়িয়ে যেতে শুরুতে ব্যাট করলে পাকিস্তানকে জিততে হত ২৮৭ রানের ব্যবধানে৷ সেক্ষেত্রে বাবররা শুরুতে ব্যাট করে ৩০০ করলে ইংল্যান্ডকে অলআউট করতে হত ১৩ রানে৷ সেটা প্রায় অসম্ভব বলে পাকিস্তানি কিংবদন্তি ওয়াসিম আকরাম মজা করে বলেছিলেন, ‘‘ব্যাটিংয়ের পর ইংলিশদের ড্রেসিংরুমে তালা দিয়ে রেখে পুরো দলকে টাইমড আউট করলেই সেমিফাইনাল খেলা সম্ভব পাকিস্তানের!''
ইডেনে টস জিতে ব্যাট করতে নেমে দুই ইংলিশ ওপেনার ডেভিড মালান ও জনি বেয়ারস্টো উদ্বোধনী উইকেটে গড়েন ৮২ রানের জুটি৷ দুজনেরই শেষ ওয়ানডে হতে পারে আজকের ম্যাচটা৷ মালানের সেটা দুঃস্বপ্নের হতে পারত ১ রানে শাহীন শাহ আফ্রিদি তার ক্যাচ না ছাড়লে৷
প্রথম ৩ ওভারে আড়ষ্টতা থাকলেও ধীরে ধীরে আক্রমণের ধার বাড়াতে থাকে ইংল্যান্ড৷ প্রথম ১০ ওভারে বর্তমান চ্যাম্পিয়নরা করেছিল বিনা উইকেটে ৭২, যা এই বিশ্বকাপে তাদের তৃতীয় সর্বোচ্চ৷
উদ্বোধনী জুটিটা ভাঙেন ইফতিখার আহমেদ৷ তার বলে রিভার্স সুইপ করতে যেয়ে মোহাম্মদ রিজওয়ানকে ক্যাচ দেন ডেভিড মালান (৩৯ বলে ৩১ রান)৷ অপর ওপেনার জনি বেয়ারস্টো ফিফটি করলেও ফেরেন ৬১ বলে ৫৯ রানে৷ হারিস রউফের বলে সালমানকে ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন তিনি৷
গত বিশ্বকাপে দুটি সেঞ্চুরিসহ ৫৩২ রান করে ইংল্যান্ডের শিরোপা জয়ের অন্যতম নায়ক ছিলেন বেয়ারস্টো৷ অথচ এবার তাঁর বিশ্বকাপ শেষ হল দুটি ফিফটিসহ ২১৫ রানে৷
আসলে ইংল্যান্ডের এবারের বিশ্বকাপ ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবিই এই ওপেনার৷ তারকায় ঠাসা বর্তমান চ্যাম্পিয়নরা ভারত এসেছিল শিরোপা ধরে রাখার অভিযানে৷ জস বাটলার, জনি বেয়ারস্টো, জো রুট, মার্ক উড, আদিল রশিদরা সেরাটা খেলতে না পারায় একটা সময় পয়েন্ট টেবিলের তলানিতে চলে যায় তারা৷
শঙ্কা জাগে ২০২৫ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফির টিকিট পাওয়া নিয়েও৷ তবে আজ চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে জায়গা নিশ্চিত করেছে তারা৷ ৩৩৭ রান ৩০.৪ ওভারে পাকিস্তান তাড়া করলেই কেবল নেট রান রেট বাংলাদেশের নিচে নামত তাদের৷ সেই ম্যাচে পাকিস্তানকে হারিয়ে সেরা আটে থেকে বিশ্বকাপ শেষ করল ইংল্যান্ড৷
নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করা বেন স্টোকসের ব্যাট হেসেছে আজও৷ ৭৬ বলে ১১ বাউন্ডারি ২ ছক্কায় সর্বোচ্চ ৮৪ করেছেন তিনি৷ তৃতীয় উইকেটে জো রুটকে নিয়ে ১৩২ রানের জুটি গড়েন স্টোকস৷ দুজনকেই ফেরান শাহীন শাহ আফ্রিদি৷
রিভার্স সুইংগিং ইয়র্কারে স্টোকসকে বোল্ড করেছিলেন আফ্রিদি৷ পরের ওভারে তার স্লোয়ারে ৭২ বলে ৬০ করা জো রুট ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে ক্যাচ দেন শাদাব খানকে৷ বিশ্বকাপ ইতিহাসে রুটের রান এখন ১০৩৪, যা ইংল্যান্ডের সর্বোচ্চ৷ ইংলিশদের মধ্যে গ্রাহাম গুচের ৮৯৭, বেন স্টোকসের ৭৬৯, জনি বেয়ারস্টোর ৭৪৭ আর ইয়ান বেলের বিশ্বকাপ রান ৭১৮৷
শেষ দিকে জস বাটলারের ১৮ বলে ২৭ আর হ্যারি ব্রুকের ১৭ বলে ৩০-এ স্কোরটা পৌঁছে ৩৩৭ রানে৷ হারিস রউফ ৩টি ও শাহীন শাহ আফ্রিদি নিয়েছেন ২ উইকেট৷ ৯ ম্যাচে ১৮ উইকেট নিয়ে বিশ্বকাপটা শেষ করলেন আফ্রিদি৷
পাকিস্তানিদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৬ উইকেট হারিস রউফের৷ ৯ ম্যাচে এই পেসারের খরচ ৫৩৩ রান৷ বিশ্বকাপের এক আসরে এত বেশি রান দেননি আর কোনো বোলার৷ পাকিস্তানের মত রউফও নিশ্চিতভাবে ভুলে যেতে চাইবেন এবারের বিশ্বকাপটা৷
সংক্ষিপ্ত স্কোর
ইংল্যান্ড ৫০ ওভারে ৩৩৭/৯ (স্টোকস ৮৪, রুট ৬০, বেয়ারস্টো ৫৯; রউফ ৩/৬৪, আফ্রিদি ২/৭২)
পাকিস্তান ৪৩.৩ ওভারে ২৪৪/১০ (সালমান ৫১, বাবর ৩৮, রিজওয়ান ৩৬ ; উইলি ৩/৫৬, রশিদ ২/৫৫)
ফল : ইংল্যান্ড ৯৩ রানে জয়ী
ম্যাচসেরা : ডেভিড উইলি