হজযাত্রীদের মাথায় এবার খরচের আরো বিশাল বোঝা
২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩‘হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশে' (হাব)-এর সভাপতি এম শাহাদাত হোসাইন তসলিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "বিমানের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে এই খরচ বেড়েছে। বিমান এবার ভাড়া বাড়িয়েছে ৭০ হাজার টাকা। কেন তারা এই ভাড়া বাড়িয়েছে তার কোনো উত্তর আমাদের কাছে নেই। আমরা আগেই বলেছি, একটা কমিটির মাধ্যমেই এই ভাড়াটা নির্ধারণ করা হোক। কারণ, বিমান একটা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেবে আর আমাদের সবাইকে সেটা মেনে নিতে হবে, এটা কেমন কথা? আমি তো মনে করি, হজ ফ্লাইটে তাদের খরচ অনেক কম। মার্কেটিং লাগে না। শতভাগ যাত্রী নিয়ে ফ্লাইটগুলো যায়। অথচ নিয়মিত ফ্লাইটে যাত্রী থাকে ৭০ থেকে ৮০ ভাগ। এসব মিলিয়ে খরচ বাড়ার বড় কারণ বিমানের ভাড়া বৃদ্ধি। এছাড়া গত বছর যেখানে রিয়ালের বিনিময়-মূল্য ছিল ২১ টাকা, এবার সেটা ৩০ টাকা ছুঁইছুঁই। এটাও একটা কারণ।”
বিমানভাড়া কিভাবে নির্ধারিত হয়? কেনই বা এত ভাড়া বাড়লো? জবাবে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান বলেন, "আমরা তিন দিন বিমান মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছি। তারপরই এক লাখ ৯৭ হাজার ৭৯৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিমান ভাড়া কেন বেড়েছে, তা আপনাদের বিবেচনা করা উচিত। বর্তমান বৈশ্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিমান ভাড়া বেড়েছে। বর্তমান সময় আমাদের অনুকূলে না থাকার কারণে বিমান ভাড়া বাড়াতে হয়েছে।”
এবার যারা হাব সদস্য কোনো এজেন্সির ব্যবস্থাপনায় হজে যেতে চান, তাদের খরচ পড়বে ৬ লাখ ৭২ হাজার ৬১৮ টাকা। তবে কোরবানির খরচ হাবের এই প্যাকেজের মধ্যে ধরা হয়নি। কোরবানি বাবদ অর্থ প্রত্যেক হজযাত্রীকে আলাদাভাবে সঙ্গে নিতে হবে। গতবছর বেসরকারিভাবে হজের খরচ পড়েছিল ৫ লাখ ২২ হাজার ৭৪৪ টাকা। সেই হিসাবে এ বছর খরচ বাড়ছে প্রায় দেড় লাখ টাকা। বেসরকারি হজ প্যাকেজে বিমান ভাড়া ধরা হয়েছে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৭৯৭ টাকা। মক্কা ও মদিনায় বাড়ি ভাড়া ২ লাখ ৪ হাজার ৪৪৪ টাকা। পরিবহণ ভাড়া ৩৫ হাজার ১৬২ টাকা ধরা হয়েছে। খাওয়ার খরচ হিসেবে ৩৫ হাজার টাকার পাশাপাশি ১ লাখ ৬০ হাজার ৬৩০ টাকা দিতে হবে ‘সার্ভিস চার্জ' হিসেবে। ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে বেসরকারি হজ যাত্রীদের নিবন্ধন শুরু হবে। হজযাত্রীদেরকে নিজ উদ্যোগে পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে হবে।
প্রতি বছর হজব্রত পালনে ইচ্ছুক বিপুল পরিমাণ মানুষকে হজে পাঠায় আল মদিনা ট্রভেলস অ্যান্ড হজ কাফেলা। প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম মালিক মুফতি মো. খোরশেদ আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "তিন কারণে এবার হজের খরচ বেড়েছে। প্রথমত, রিয়ালের মূল্য বেড়েছে। দ্বিতীয়ত, বিমানের ভাড়া বেড়েছে। আর তৃতীয়ত, সার্ভিস চার্জ। ২০১৯ সালেও সার্ভিস চার্জ ছিল ৫০ হাজার টাকার মতো। এবার সেটা হয়েছে দুই লাখ টাকার কাছাকাছি। এটাও একটা কারণ। আর চলতি বছর তো সৌদি আরব সরকার হজযাত্রীদের খরচ৩০ শতাংশ কমিয়েছে বলে যেটা বলা হচ্ছে, সেটাও ঠিক না। এটা শুধু অভ্যন্তরীণ হাজীদের জন্য। আন্তর্জাতিক হাজীদের জন্য এটা প্রযোজ্য নয়। ফলে আমরা এই সুবিধা পাবো না। আমাদের সব খরচ দিয়েই হাজীদের পাঠাতে হবে।”
সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী এবার প্রত্যেক হজযাত্রীর ব্যয়হবে ৬ লাখ ৮৩ হাজার ১৮ টাকা। গত বছরের তুলনায় খরচ সর্বোচ্চ এক লাখ ৬১ হাজার ৮৬৮ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ধর্মবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মো. ফরিদুল হক খান সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, "গত বছর সরকারিভাবে হজে যেতে প্যাকেজ-১ এ ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৩৪০ টাকা এবং প্যাকেজ-২ এ ৫ লাখ ২১ হাজার ১৫০ টাকা খরচ হয়। এবার নানা বিষয় পর্যালোনা করে আমরা একটি হজ প্যাকেজ ঘোষণা করেছি। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ২৭ জুন পবিত্র হজ অনুষ্ঠিত হবে। চলতি বছর হজ পালনে এক লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন হজযাত্রী বাংলাদেশ থেকে হজে যেতে পারবেন। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ১৫ হাজার, বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় এক লাখ ১২ হাজার ১৯৮ জন হজযাত্রী পবিত্র হজ পালন করতে পারবেন।” প্রতিমন্ত্রী বলেন, কোনো অব্যবস্থাপনা যাতে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখা হচ্ছে।”
ডলার সংকটের কারণে এবার হজ যাত্রীদের কোনো সমস্যা হবে কিনা জানতে চাইলে ‘হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশে'র (হাব) সভাপতি এম শাহাদাত হোসাইন তসলিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমার মনে হয় সমস্যা হবে না। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করেছি। প্রয়োজনে রিভার্ভ থেকে ডলার দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। হাজীদের বাড়িভাড়া করতে যে ডলারের প্রয়োজন হবে বাংলাদেশ ব্যাংক সেটা দেবে বলেই আমার বিশ্বাস।”
সৌদি আরব যে ৩০ শতাংশ খরচ কমালো সেটাতে কেন প্রভাব পড়েনি? এ প্রসঙ্গে এম শাহাদাত হোসাইন তসলিম বলেন, "হজ পালনের খরচ ৩০ শতাংশ যে সৌদি সরকার কমিয়েছে সেটা সৌদি আরবের ডোমেস্টিক হজযাত্রীদের জন্য প্রযোজ্য। বাংলাদেশের কিংবা অন্যান্য দেশের হজযাত্রীদের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য নয়।”
এবার হজে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা জাকিরুল ইসলাম। ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, "নতুন করে হজের খরচ বৃদ্ধিতে চরম সংকটে পড়েছি। আমি তো গত বছরই বুকিং দিয়ে রেখেছি। টাকাও জোগাড় করে রেখেছি। আপনারা তো জানেন হজের টাকা ঋণ করে নেওয়া যায় না। কারও কাছ থেকে চেয়েও নেওয়া যায় না। নিজের উপার্জনের টাকায় হজে যেতে হয়। ফলে এখন এই অতিরিক্ত টাকা জোগাড় করতে আমার একটা সঞ্চয়পত্র ভাঙাতে হবে। স্ত্রীকে নিয়ে যাব, ফলে আমার বেশি লাগবে তিন লাখ টাকার মতো। এতে আমি আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হবো। তারপরও নিয়োত যেহেতু করেছি, হজে যাব, খরচ যত বেশিই হোক না কেন যেতে হবে। স্ত্রীকে নিয়ে যেন সুস্থ্যভাবে হজব্রত পালন করে দেশে ফিরতে পারি সকলের কাছে সেই দোয়াই চাই।”
প্রসঙ্গত, এ বছর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে সৌদি আরবে গমনকারী শতভাগ হজযাত্রীর প্রি-অ্যারাইভাল ইমিগ্রেশন ‘রুট টু মক্কা চুক্তি' অনুযায়ী ওই বিমানবন্দরেই অনুষ্ঠিত হবে। আগের মতো তিনটি বিমান সংস্থা (বিমান বাংলাদেশ, সৌদিয়া এয়ারলাইন্স ও নাস এয়ার) এবারও হজযাত্রীদের পরিবহণ করবে।