সড়কে শৃঙ্খলায় দরকার কোম্পানি গঠন
২৪ মার্চ ২০১৯এক সপ্তাহ আগেই ঢাকায় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) এর মেধাবী ছাত্র আবরার আহমেদ চৌধুরীর মৃত্যুর রেশ কাটতে না কাটতেই ঘটল ওয়াসিমের ঘটনা৷ প্রতিটি দুর্ঘটনার পরই শিক্ষার্থী-সাধারণ মানুষ নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করছেন, মিলছে আশ্বাসও৷ কিন্তু চালক-শ্রমিকদের মধ্যে কোন পরিবর্তন আসছে না৷
সড়কে শৃঙ্খলায় এই মুহুর্তে আসলে কী করা দরকার? কী করলে সড়কে ফিরবে শৃঙ্খলা? এমন প্রশ্নের জবাবে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটে (এআরআই) দীর্ঘদিন কাজ করা অধ্যাপক শামসুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কিছু কাজ আসলে তৈরি হয়ে আছে৷ অ্যাডভান্স লজিস্টিক গ্রুপ অনেক গবেষণা করে সরকারের কাছে কিন্তু প্রস্তাবনা দিয়ে রেখেছে৷ এগুলো বাস্তবায়ন করলেই হয়৷ সেটা রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘এছাড়া প্রথমত, চালক ও শ্রমিকদের নিয়োগপত্র দিতে হবে৷ মালিকরা চালকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বাসটি তাকে দিয়ে দিচ্ছে৷ ফলে ওই চালক তার মালিকের জমার বাইরে নিজের কিছু রাখার জন্য যাত্রী নেওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছে৷ যখনই এই প্রতিযোগিতা শুরু হয় তখন চালকের নজর রাস্তায় থাকে না, যাত্রীদের দিকে থাকে৷ এতে তো দুর্ঘটনা ঘটবেই৷''
তিনি বলেন, এক রুটে একটি কোম্পানির বাস থাকলে প্রতিযোগিতা হয় না৷ ‘‘প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক গুলশানে ঢাকার চাকা প্রবর্তন করে দেখিয়ে দিয়েছেন এক রুটে একটি গাড়ি থাকলে সেখানে প্রতিযোগিতা হয় না,'' ডয়চে ভেলেকে বলেন তিনি৷ ‘‘গুলশানের ওই প্রকল্পকে আমরা মডেল ধরে প্রথমে রাজধানীতে কোম্পানি ভিত্তিতে বাস চালাচল শুরু করতে পারি৷ এরপর সারাদেশে৷ এতে করে দুর্ঘটনা অনেক কমে যাবে, মানুষও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে৷''
বুয়েটের এআরআই'র গবেষণা থেকে জানা গেছে, ২০১৬ সালের মার্চ থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৬৬টি দুর্ঘটনায় ৬৯৯ জন নিহত এবং এক হাজার ২২৭ জন আহত হয়েছেন৷ এর মধ্যে ৩৫৪টি দুর্ঘটনাই বাসের কারণে ঘটেছে৷
এছাড়া ১৩০টি মোটরসাইকেল, ১১৩টি ট্রাক, ৭৩টি পিকআপ এবং ৫৬টি ব্যক্তিগত গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে৷ এর মধ্যে ২০১৬ সালের মার্চ থেকে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত শুধুমাত্র রাজধানী ঢাকায় ১২৩টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৩৭ জন, আহত হয়েছেন ৩৩৭ জন৷ ২০১৭ সালে ঢাকায় ২৬৩টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৭৬ জন৷ ৩৫৮ জন আহত হন। ২০১৮ সালে ঢাকায় ২৮০টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৮৬ জন নিহত হন৷ আহত হয়েছিলেন ৫৩২ জন৷ এ বছর ১৩৪টি দুর্ঘটনার কারণ ছিল বাস৷
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মীর রেজাউল আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘রাজধানীতে এমনিতেই রাস্তা অনেক কম৷ তার উপর উন্নয়নমূলক কাজ চলার কারণে বিশেষ করে মেট্রোরেলের কারণে রাস্তার মাঝখানে ১১ ফুট জায়গা ছেড়ে দিয়ে হয়েছে৷ ফলে সংকুচিত হচ্ছে রাস্তা৷ তারপরও আমরা রাজধানী সচল রেখেছি৷''
কিন্তু সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে এখনই কি করণীয়? জানতে চাইলে মীর রেজাউল বলেন, ‘‘আমি বলব, ঢাকার রাস্তা থেকে যানবাহন কমাতে হবে, মানুষ কমাতে হবে, এগুলো আর সম্ভব নয়, তাই আমাদের প্রথমত চালকদের মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে৷ যদিও তাদের মোটিভেট করতে আমরা নানা ধরনের কাজ করছি৷ সর্বশেষ বৃহস্পতিবার মহানগর নাট্যমঞ্চে এক হাজারের মতো বাস শ্রমিককে নিয়ে মোটিভেশনাল প্রোগ্রাম করেছি৷ এই কাজ প্রতিদিনই চলছে৷ পাশাপাশি পথচারীদের মধ্যে আইন মেনে চলার প্রবণতা তৈরি করতে হবে৷ কারণ আমাদের দেশের অশিক্ষিত মানুষই কিন্তু বিদেশে গিয়ে শৃঙ্খলা মেনে চলেন৷ তাহলে এখানে কেন সম্ভব নয়? ফুটপাথ হাঁটার জন্য উন্মুক্ত করতে হবে৷ যে কোন জায়গায় হুট করে রাস্তা পার হওয়ার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে৷ আসলে সবাই যদি আইন মানেন তাহলে তো পরিস্থিতি অনেকখানি এমনি বদলে যাবে৷''
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক রাজধানী ৬টি কোম্পানীর মাধ্যমে ফ্র্যাঞ্চাইজি ভিত্তিতে বাস চলাচলের উদ্যোগ নিয়েছিলেন৷ এতে চালকদের প্রতিযোগিতার প্রবণতা অনেক কমে যাবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা৷ তাতে দুর্ঘটনাও কমবে৷ আনিসুল হকের মৃত্যুর পর এই উদ্যোগটি এখন কোন পর্যায়ে? জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘‘অনেকদিন ধরেই এই উদ্যোগটা বন্ধ ছিল৷ এখন আমরা ওই পরিকল্পনাটা আবার বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছি৷ গত বুধবার এটা নিয়ে একটা বৈঠকও হয়েছে৷ এখন আমরা এটা বাস্তবায়ন করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছি৷''
তবে কোম্পানি করে বাস চালালে পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে মনে করেন না ঢাকা জেলা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি নুরুল আমিন৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘এক হাতে তো তালি বাজে না, উভয় পক্ষের দোষ আছে৷ আপনি শুধু শ্রমিককে দোষ দিলে ঠিক হবে না৷ শ্রমিকদের দোষ তো আছেই৷ আমরা এখন তাদের শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে পারিনি৷ তবে এখনও যত্রতত্র মানুষ রাস্তা পার হচ্ছে, মোবাইল কানে দিয়ে দৌঁড় দিচ্ছে, চালক কি করবে? ২০০১-২০০৬ সালে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী নাজমুল হুদা বিশ্বব্যাংকের টাকা নিয়ে কোম্পানি করেছিলেন৷ এখন সেই কোম্পানিগুলো শাখা প্রশাখা বিস্তৃত করে বহু সংগঠন হয়েছে৷ ফলে কারো উপর কারো নিয়ন্ত্রণ নেই৷ এতে আমি তো বলব, দুর্ঘটনা বেড়েছে৷ আবার মালিকরা ব্যাংক থেকে লোন করে বাস নামাচ্ছেন৷ শ্রমিক তিনিই ঠিক করছেন৷ শ্রমিক সংগঠনগুলো জানেই না, কোন পরিবহনে কোন শ্রমিক কাজ করছেন? ফলে তাদের জবাবদিহিতার মধ্যে আনা যাচ্ছে না৷''
তবে অদক্ষ চালকদের মধ্যে যাত্রী নেওয়ার প্রতিযোগিতা ঢাকায় দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ৷ দুই দিন আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘‘ঢাকার নানা কোম্পানির নামে চলাচলকারী বাসগুলো বিভিন্ন মালিকের৷ এজন্য তারা প্রতিযোগিতা করে৷ তারা একটি কোম্পানির নাম নিয়ে চলে৷ দৈনিক চুক্তিতে চলাচলের কারণে এগুলো প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়, যে কারণে দুর্ঘটনা বেশি হয়৷ ঢাকা শহরে বেশিরভাগ চালকই পাকা লাইসেন্সধারী না, অনভিজ্ঞ৷ তারা লেগুনা, পিকআপসহ হালকা যানবাহনের চালক৷ ভারী লাইসেন্সধারী চালকরা ঢাকায় গাড়ি চালাতে আসে না৷ ফলে দক্ষ চালকের অভাবে মালিকরা তাদের (অদক্ষ) হাতে গাড়ি তুলে দিচ্ছে৷ ফলে দুর্ঘটনা ঘটছে৷''
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ কি? জানতে চাইলে এই পরিবহন নেতা বলেন, ‘‘আমরাও তো চেষ্টা করে পারছি না৷ এখনও ২০ ভাগের বেশি গাড়ি চালকের অভাবে প্রতিদিন রাস্তায় নামানো যাচ্ছে না৷ ফলে বাধ্য হয়েই আমরা এত টাকার গাড়ি অদক্ষ চালকদের হাতে তুলে দিচ্ছি৷ কোন মালিক কি চাইবেন তার এত টাকার গাড়ি কাউকে চাপা দিক, আর জনতা সেই গাড়ি ভাঙচুর বা আগুন দিক? কেউ চান না৷ আপনার মতো আমিও চাই সব মানুষ নিরাপদে ঘরে ফিরুক৷''
কী করলে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে? লিখুন নীচের ঘরে৷