সড়কে নৈরাজ্য থেকে উত্তরণের উপায়
২৮ মে ২০১৮আসলে রাস্তায় প্রকৃত অর্থে কোনো ‘এনফোর্সমেন্ট' ব্যবস্থা নেই বাংলাদেশে৷ এতে দিন দিন চালকরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে৷ সাম্প্রতিক সময়ে তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব হোসেনের নিহত হওয়ার ঘটনায় সারাদেশ কেঁদে উঠলেও, প্রতিদিন বাংলাদেশের সড়ক-মহাসড়কে ঝড়ছে কমপক্ষে ৬৪টি তাজা প্রাণ৷ প্রতিদিন আহত ও পঙ্গুত্বের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে ১৫০-এরও বেশি মানুষ৷ নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত প্রায় ৫০ লাখ যানবাহনের ৬০ শতাংশ, অথাৎ ৩০ লাখ যানবাহনের চলাচলের যোগ্যতা/ফিটনেস, পারমিট বা নিবন্ধন নেই, বা ভুয়া নাম্বারে চলছে এইসব যানবাহন৷ এখানে পুলিশকে ম্যানেজ করে বৈধ গাড়ির চেয়ে অবৈধ গাড়ির চালানো অনেক সহজ৷ বিআরটিএ ও পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে তথাকথিত সনাতন পদ্ধতিতে জরিমানা আদায়ে মগ্ন৷
ট্রাফিক পুলিশের টিআই, পিআই, সাজের্ন্ট, কনস্টেবলরা পরিবহণে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে চাঁদাবাজি, টোকেনবাজি, জরিমানা আদায় ও আত্মসাতের মহোৎসবে মেতে উঠেছেন৷ প্রকৃত মালিক ও শ্রমিক সংগঠন গুলোকে কোণঠাসা করে সরকারের লেজুরভিক্তিক গুটি কয়েক সংগঠন এই সেক্টরের মালিক-শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণের পরিবর্তে চাঁদাবাজি, পারমিট বাণিজ্য, কর্তৃত্ব জাহির ও ক্ষমতা প্রদর্শনে মগ্ন রয়েছে৷ রাজনৈতিক ঠিকাদাররা সরকারের কোর্ট গায়ে দিয়ে সরকারের আপন লোক সেজে সড়কে শত শত কোটি টাকার কাজ ভাগিয়ে নিয়ে যেনতেনভাবে কাজ করে বিল নিয়ে লাপাত্তা হচ্ছে৷ অথবা রাস্তা কেটে মাসের পর মাস ফেলে রেখে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করছে৷ এহেন পরিস্থিতিতে সড়কে নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানি আজ চরম আকার ধারণ করেছে৷
রাজধানীসহ সারা দেশের গণপরিবহণে নৈরাজ্য চলছে, বাসে-বাসে রেষারেষি করে বেপরোয়া চলাচল, পাল্লাপাল্লির কারণে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন যাত্রীরা৷ যত্রতত্র বাস থামানো, রাস্তার মাঝপথে গতি কমিয়ে চলন্ত বাসে যাত্রী উঠানামা করানো, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন, রাস্তার মোড়ে বাস থামিয়ে যাত্রী উঠানো নামানো, যাত্রী ধরার জন্য বাসে বাসে ভয়ংকর প্রতিযোগিতা, অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলা ঢাকার গণপরিবহণের নিত্যদিনের চিত্র৷
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, রাজধানীতে ৮৭ শতাংশ বাস-মিনিবাস ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করে বেপরোয়া চলাচল করে৷ ফলে এ সব বাসে দুর্ঘটনায় কারো হাত, কারো পা, কারো মাথা, বা কারো জীবন চলে যাচ্ছে৷ বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সড়ক দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ সেলের তথ্য মতে, সারা দেশে জানুয়ারি ২০১৮ থেকে ৩০ এপ্রিল ২০১৮ পর্যন্ত ১,৮৭১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২,১২৩ জনের প্রাণহানি ও ৫,৫৫৮ জন আহত হয়েছে৷ এখানে পঙ্গু হয়েছে ২৯৭ জন৷
আমরা এ সব দুর্ঘটনাকে দুর্ঘটনা নয়, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলতে চাই৷ কেননা আমাদের সড়কে সমস্ত অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলা জিইয়ে রেখে নৈরাজ্যকর পরিবেশে যাতায়াত করতে বাধ্য করা হচ্ছে৷ বর্তমানে বাংলাদেশে নিবন্ধিত ৩১ লাখ যানবাহনের সাথে পাল্লা দিয়ে অনিবন্ধিত, ভুয়া নম্বরধারী ও অযান্ত্রিক যান মিলে প্রায় ৫০ লক্ষ যানবাহন রাস্তায় চলছে, যার ৭২ শতাংশ ফিটনেস অযোগ্য৷ অন্যদিকে সারাদেশে ৭০ লক্ষ চালকের মধ্যে বিআরটিএ লাইসেন্স আছে মাত্র ১৬ লক্ষ চালকের হাতে৷ এছাড়াও রাজনৈতিক ঠিকাদারের দৌরাত্ম্যের কারণে সারাদেশে সড়ক-মহাসড়কে বেহাল দশা তৈরি হয়েছে৷ যাত্রী হিসেবে আমাদেরও সচেতনতার অভাব রয়েছে৷ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আইন প্রয়োগের চেয়ে দু'হাতে পকেট ভরতে ব্যস্ত৷
ঢাকা মহানগরীতে পরিবহণ পরিচালনা ও রুট পারমিট ইস্যুর দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা মেট্রো আঞ্চলিক পরিবহণ কমিটি বা মেট্রো আরটিসি৷ এই কমিটিতে পেশাদার কোনো লোকজন নেই, নেই কোনো যাত্রী সাধারণের প্রতিনিধি৷ প্রভাবশালী মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের কয়েক জন নেতা কার্যত এই কমিটি পরিচালনা করে৷ তাদের কাছে সরকারের লোকজন অসহায়৷ তারা ঢাকা মহানগরীর পরিবহণ পরিচালনায় ভালো-মন্ধ দেখার কথা৷ পরিবহণে এহেন নৈরাজ্য ও হয়রানি থামাতে এই কমিটির কার্যত কোনো ভূমিকা নেই৷ নগরীর প্রতিটি বাস-মিনিবাসের ব্যবসা মূলত চালকরা নিয়ন্ত্রণ করছে৷ দৈনিক চুক্তিভিত্তিক ইজারায় প্রত্যেক মালিক তার বাসটি চালকের হাতে তুলে দিয়েছে৷ ফলে চালকরা যাত্রী ধরার জন্য ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন৷ এই পরিস্থিতিতে বাস চালাতে গিয়ে বাসের নীচে কে পড়লো বা কার হাত বা পা গেল, তা দেখার সময় নেই চালকদের৷
যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, আমাদের সড়ক পরিবহণ ব্যবস্থা পরিচালনায় যোগ্য ও পেশাদারিত্বসম্পন্ন লোকজনের দারুণ অভাব রয়েছে৷ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো পেশাদারিত্বের পরিবর্তে আমলাতান্ত্রিক জঞ্জালে আবদ্ধ৷ এতে করে এই সেক্টরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা বা শৃঙ্খলা ফেরাতে কোনো আশার আলো দেখা যাচ্ছে না৷
পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে যাত্রী অধিকার প্রতিষ্ঠায় কর্মরত সংগঠন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি মনে করে:
১. নগরীতে বাসে-বাসে প্রতিযোগিতা বন্ধে কোম্পানিভিত্তিক একই রংয়ের বাস সার্ভিস চালু করা উচিত৷
২. উন্নত বিশ্বের আদলে আমলাতন্ত্রের বাইরে এসে পেশাদারিত্বসম্পন্ন গণপরিবহণ সার্ভিস অথরিটির নামে একটি টিম গঠন করা৷ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত এই টিম নগরজুড়ে গণপরিবহণ ব্যবস্থার সমস্যা ও সম্ভাবনা চিহ্নিত করে প্রতিদিনের সমস্যা প্রতিদিন সমাধান করে এই ব্যবস্থাকে একটি শৃঙ্খলায় নিয়ে আসবে ও সড়কের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করবে৷ এছাড়া তারা গণপরিবহণের মান, যাত্রী সেবার মান, বাস টার্মিনালের পরিবেশ, যাত্রী ও গণপরিবহণ সংক্রান্ত যে কোনো সমস্যা তাৎক্ষণিক সমাধান করবে৷ ট্রাফিক পুলিশ, বিআরটিএ ও অন্যান্য সেবাদান প্রতিষ্ঠানসমূহ এই টিমের নির্দেশনা মানতে বাধ্য থাকবে৷
৩. ট্রাফিক বিভাগের কার্যক্রম জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে
৪. চালকের হাতে দৈনিক জমা ভিত্তিক বাস ইজারা দেওয়া বন্ধ করতে হবে
৫. বিআরটিএ-র ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার কাজটি জনবান্ধব করতে হবে৷ এই আদালত পরিচালনার মাধ্যমে পরিবহণ সেক্টরে নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানি বন্ধে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে
৬. ট্রাফিক পুলিশের মামলার জরিমানা সরাসরি ব্যাংকে জমা দেওয়ার বিধান নিশ্চিত করতে হবে
৭. সড়কে চাঁদাবাজি, টোকেন বাণিজ্য, দখলবাজি, হকার ও অন্যান্যদের ফুটপাত ও সড়ক ব্যবহার বন্ধ করতে হবে
৮. রুট পারমিট ইস্যু প্রক্রিয়ায় ঢাকা মেট্রো আরটিসিতে মালিক, শ্রমিক নেতাদের পরিবর্তে পেশাদারিত্ব ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন লোকজন নিয়ে পুনর্গঠন করতে হবে
৯. ভাড়া নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানি বন্ধে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে, এবং
১০. পরিবহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় যাত্রী সাধারণের অভাব-অভিযোগ তুলে ধরা ও মত প্রকাশের স্বার্থে যাত্রী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে৷
এ বিষয়ে আপনার কোনো মতামত থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷