সড়ক দুর্ঘটনাই বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় ‘মহামারি’
২২ অক্টোবর ২০২২বাংলাদেশ ইনিশিয়েটিভ, সেবক ও ড্রাইভার্স ট্রেনিং সেন্টারের উদ্যোগে এক গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে৷ বিশ্লেষকরা বলছেন, নিহত এবং আহতের সংখ্যা বিবেচনায় সড়ক দুর্ঘটনাই এখন সবচেয়ে বড় মহামারি৷ কিন্তু দুর্ঘটনা রোধে সংশ্লিষ্টদের তেমন নজর নেই৷ চালকদের প্রশিক্ষণের অভাব, আর অব্যস্থাপনাই মূলত এমন পরিস্থিতির জন্য দায়ী বলে মনে করেন তারা৷
গবেষক কাজী আবুল আল আতাহিয়া জানান, ২০২১ সালে পাঁচ হাজার ৩৭১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ছয় হাজার ২৮৪ জন মারা যান৷ এসব দুর্ঘটনায় আহত হন সাত হাজার ৪৬৮ জন৷ তাদের মধ্যে ৮৪ শতাংশই পঙ্গুত্বের শিকার৷ গত বছর গড়ে প্রতিদিন ১৭ জন নিহত হয়েছেন৷
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, ২০২০ সালে দেশে চার হাজার ৮৯১টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ছয় হাজার ৬৮৬জন এবং আহত হয়েছেন আট হাজার ৬০০ জন৷ ২০১৯ সালে পাঁচ হাজার ৫১৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় সাত হাজার ৮৫৫জন নিহত হয়েছেন৷ এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ১৩ হাজার ৩৩০জন৷ ২০১৮ সালে পাঁচ হাজার ৫১৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় সাত হাজার ২২১জনের মৃত্যু হয়েছে৷ আহত হয়েছেন ১৫ হাজার ৪৬৬জন৷
কতটা ভয়াবহ?
গবেষক আবুল আল আতাহিয়া বলেন, ‘‘২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনা আসার পর আমরা এর বিরুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছি৷ ফলে সেটা মোকাবিলা করা গেছে৷ গত কয়েক মাস ধরে প্রতিদিন মৃত্যুর হার পাঁচ জনের বেশি হয়নি৷ কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে তার চেয়ে প্রতিদিন চারগুণেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হলেও এটা নিয়ে আমরা তেমন উদ্বিগ্ন নই৷ যদি আমাদের একই রকম সিরিয়াসনেস থাকত তাহলে এটা কমিয়ে আনা সম্ভব হতো৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘আমি করোনার সঙ্গে তুলনা করেছি সিরিয়াসনেসের বিষয়টি বিবেচনা করে৷ তবে আমার পর্যবেক্ষণ বলছে, একক কারণ হিসেবে সড়ক দুর্ঘটনায়ই বাংলাদেশে মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি৷ আমার বিচেনায় সড়ক দুর্ঘটনাই বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় মহামারি৷’’
আহতদের ভয়াবহ দিক তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘‘আহতদের ৮৪ ভাগ পঙ্গু হয়ে যান৷ এর মানে হলো তারা আর সারা জীবন কোনো কাজ করতে পারেন না৷ তারা পরিবারের ওপর বোঝা হয়ে বেঁচে থাকেন৷ তাদের পরিবারেও নেমে আসে দুর্যোগ৷ একটি বিশাল জনগোষ্ঠী কর্মক্ষমতা হারালেও তাদের সহায়তার জন্য সরাকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই৷’’
দায় কার?
বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘‘সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে গত এক বছরে ওয়ার্ল্ড র্যাংকিং-এ বাংলাদেশের ১৮ ধাপ অবনতি হয়েছে৷ সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে কারণ হলো এর ব্যবস্থাপনায় রাজনীতি আছে কিন্তু বিজ্ঞান নেই৷ ৯৫ ভাগ রাজনীতি থাকলে বিজ্ঞান আছে শতকরা পাঁচ ভাগ৷ গত এক বছরে সড়কে ৬০ হাজার নতুন আনফিট যানবাহন নেমেছে৷ এক যুগে ৫০-৬০ লাখ অবৈধ যানবাহনের জন্ম হয়েছে৷ তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অবৈধ চালক৷’’
তিনি বলেন, ‘‘আমরা গবেষণায় দেখেছি যেসব চালকরা দুর্ঘটনায় পড়েন তাদের ২৫ ভাগ মাদকাসক্ত৷ চালকের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই৷ তাদের নির্দিষ্ট কোনো বেতন নেই৷ ফলে দক্ষ চালক আমরা পাচ্ছি না৷ তারা রেকলেস ড্রাইভিং করছেন৷ যা সড়কের মৃত্যু পরিস্থিতিকে আরো খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে৷’’
গবেষক আবুল আল আতাহিয়া বলেন ‘‘সড়ক দুর্ঘটনার নানা কারণ আছে৷ কিন্তু আমার মনে হয়েছে, চালক ও হেলপারদের প্রশিক্ষিত করতে পারলে ও তাদের গুণগত মান বাড়াতে পারলে এটা উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসবে৷ তাদের দক্ষতা এবং দায়িত্বশীল আচরণ অনেক জীবন রক্ষা করতে পারে৷’’
বাংলাদেশ রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান মনে করেন, ‘‘সড়ক দুর্ঘটনার এখন প্রধান কারণ অদক্ষ চালক এবং ফিটনেসবিহীন যানবাহন৷ আগে সড়কও অন্যতম কারণ ছিল৷ কিন্তু এখন মহানড়কগুলো প্রশস্ত হয়েছে৷ গতি বড়েছে৷’’
তার কথা, ‘‘এখানে চালকদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই৷ তারা হেলপারি করতে করতে চালক হয়৷ আবার তাদের পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা না দেয়ায় তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে ফিট থাকেন না৷ তাদের নির্দিষ্ট বেতন না থাকায় অতিরিক্ত ট্রিপ দিতে হয়৷ ফলে মহাসড়কের গতির সঙ্গে তারা পারে না৷ দুর্ঘটনা ঘটে৷ আবার তাদের যে যানবাহন দেয়া হয় তার অধিকাংশেরই ফিটসেন নাই৷’’
তিনি বলেন, ‘‘সড়ক দুর্ঘটনার জন্য প্রত্যক্ষভাবে চালকদের সর্বাধিক দায়ী করা হলেও এর পিছনে কিন্তু চরম অব্যবস্থাপনা আছে৷ এরজন্য মালিক এবং বিআরটিএ দায়ী৷ কিন্তু এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য তাদের কোনো উদ্যোগ বা ইচ্ছাও নেই৷ ফলে সড়কে মৃত্যু বাড়ছেই৷’’
আর যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘‘পরিবহণ খাত ও সড়ক একটি দুষ্ট চক্রের হাতে বন্দি৷ ফলে এখানে কোনো নিয়মনীতি, আইন কার্যকর করা যাচ্ছে না৷ এখানে অবৈধ সুবিধার জন্য কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়৷ এর সঙ্গে পুলিশ, প্রশাসন, পরিবহন মালিক, রাজনৈতিক নেতা সবাই জড়িত৷ ফলে যাত্রীরা প্রাণ হারাচ্ছে৷’’
তার কথা, ‘‘এই অসাধু চক্রের কারণেই সড়কে আনফিট এবং অবৈধ যানবাহন ও অদক্ষ চালকদের এত দৌরাত্ম৷’’