স্বাধীনতা ও ঐক্যের প্রতীক: বার্লিনের ব্রান্ডেনবুর্গ তোরণ
ব্রান্ডেনবুর্গ তোরণকে বার্লিনের প্রখ্যাততম প্রতীক বললেও বেশি বলা হয় না৷ শত শত পর্যটক প্রতিদিন এই স্মৃতিসৌধটির ছবি তোলেন৷ তাঁরা কি জানেন, ব্রান্ডেনবুর্গ তোরণ অতীতের কতশত ঐতিহাসিক ঘটনার স্মৃতি বহণ করছে?
জার্মান পুনরেকত্রীকরণের প্রতীক
ঊনবিংশ শতাব্দীতে বার্লিন নগরীর শুল্ক প্রাকারে যে ১৮টি তোরণ ছিল, তার মধ্যে একমাত্র ব্রান্ডেনবুর্গ তোরণই ইতিহাসের তরঙ্গাভিঘাতে ধ্বংস হয়নি৷ ৮৫ ফুট উঁচু বেলেপাথরের এই সৌধটির এমন একটি নিজস্বতা আছে, যা প্রথম দর্শনেই মনে দাগ কাটে৷
গ্রিক স্থাপত্যের অনুকরণে?
সাবেক তোরণটির ১৭৬৪ সালের ছবি৷ পরে সম্রাট দ্বিতীয় ফিডরিশ ভিলহেল্মের নির্দেশে ব্রান্ডেনবুর্গ তোরণ নির্মাণ করেন স্থপতি কার্ল গটহার্ড লাংহান্স, যিনি নাকি এথেন্সের আক্রেপোলিস দেখে বার্লিনের এই নিওক্ল্যাসিক্যাল সৌধটি সৃষ্টির প্রেরণা পেয়েছিলেন৷ ব্রান্ডেনবুর্গ তোরণ উদ্বোধন করা হয় ১৭৯১ সালের ৬ই জুন তারিখে৷
‘কোয়াড্রিগা’
ব্রান্ডেনবুর্গ তোরণের উপরে স্থাপিত ভাস্কর্যটির স্রষ্টা ইওহান গটফ্রিড শাডোভ৷ মূর্তিটি বসানো হয় ১৭৯৩ সালে: চার ঘোড়ায় টানা দু’ চাকার রথ চালাচ্ছেন গ্রিক শান্তির দেবী আইরিন৷ মনে রাখা দরকার, ব্রান্ডেনবুর্গ তোরণ যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন ইউরোপ জুড়ে ফরাসি বিপ্লবের হাওয়া; কাজেই তোরণটির নাম ছিল ‘ফ্রিডেন্সটোর’ বা ‘শান্তির দ্বার’৷
‘কোয়াড্রিগা’ গেল প্যারিসে
১৮০৬ সালে নেপোলিয়নের বিজয়ী সৈন্যরা ব্রান্ডেনবুর্গ তোরণের ভিতর দিয়ে কুচকাওয়াজ করে যায় – আরো বড় কথা, তারা রথারোহী শান্তির দেবীর মূর্তিটি যুদ্ধজয়ের পুরস্কার হিসেবে প্যারিসে নিয়ে যায়, যেখানে ‘কোয়াড্রিগা’ প্রদর্শিত হওয়ার কথা ছিল৷ কিন্তু প্যারিসে ‘কোয়াড্রিগা’ শেষমেষ বাক্সবন্দিই থেকে যায়৷
‘কোয়াড্রিগা’-র প্রত্যাবর্তন
নেপোলিয়নের পরাজয়ের পর ‘কোয়াড্রিগা’ আবার বার্লিনে ফেরে ১৮১৪ সালে, জার্মান জেনারেল অ্যার্ন্স্ট ফন ফুয়েলের কল্যাণে৷ এরপর থেকে সম্রাট ও রাজা-রাজড়াদের মতো ফন ফুয়েলের পরিবারও ব্রান্ডেনবুর্গ তোরণের মাঝখানের পথটি দিয়ে যাবার অধিকার পান – নয়তো সাধারণ নাগরিকদের শুধুমাত্র বাইরের পথগুলো দিয়ে যাবার অনুমতি ছিল৷
নাৎসি অপপ্রচার
১৯৩৩ সালের জানুয়ারি মাসে হিটলারের ক্ষমতাদখল উদযাপন উপলক্ষ্যে নাৎসিরা ব্রান্ডেনবুর্গ তোরণের ভিতর দিয়ে মশাল হাতে মার্চপাস্টের আয়োজন করে৷ হিটলার, তথা নাৎসিরা কল্পনায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জেতার পর ‘জার্মানিয়া’ নামের যে ‘বিশ্ব রাজধানী’ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিল, তার কেন্দ্রবিন্দু হবার কথা ছিল এই ব্রান্ডেনবুর্গ তোরণের৷
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রান্ডেনবুর্গ তোরণ বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় – তবুও খাড়া থাকে৷ ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৫৭ সাল অবধি তোরণের মাথায় সোভিয়েত পতাকা ওড়ে, কেননা ব্রান্ডেনবুর্গ তোরণের এলাকাটি সোভিয়েত জোনের অঙ্গ ছিল৷ ১৯৫৭ সালের পরে তোরণ থেকে সাবেক পূর্ব জার্মানির পতাকা ওড়ে৷ যুদ্ধের পর ‘কোয়াড্রিগা’র বিশেষ বাকি ছিল না; পড়ে ছিল শুধু একটি ঘোড়ার মাথা, যা আজও ম্যার্কিশেজ মিউজিয়াম নামের একটি সংগ্রহশালায় রাখা আছে৷
দুই জার্মানির চেষ্টায় ‘কোয়াড্রিগা’-র পুনর্জন্ম
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীনই ‘কোয়াড্রিগা’র একটি চীনেমাটির ছাঁচ নেওয়া হয়েছিল – ১৯৪২ সালে৷ যুদ্ধের পর সব বিতর্ক সত্ত্বেও পশ্চিম আর পূর্ব বার্লিন কর্তৃপক্ষ ব্রান্ডেনবুর্গ তোরণটি নতুন করে সারিয়ে তোলার ব্যাপারে একমত হন৷ সেই সূত্রেই তোরণের মাথায় ‘কোয়াড্রিগা’ তার আপন জায়গায় ফিরে যায়৷ সেটা ছিল ১৯৫৭ সাল৷ এর কিছু পরেই পূর্ব বার্লিন সরকার ‘কোয়াড্রিগা’ থেকে আয়রন ক্রস ও প্রুশিয়ার ঈগলটি অপসারণ করেন৷
বার্লিন প্রাকার
১৯৬১ সালের ১৩ই আগস্ট বার্লিন প্রাকার নির্মিত হওয়ার পর ব্রান্ডেনবুর্গ তোরণ পশ্চিম বার্লিনের এলাকার ঠিক বাইরে পড়ে; কাজেই পশ্চিম বার্লিন থেকে ব্রান্ডেনবুর্গ তোরণে যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়৷ এমনকি পুবদিকেও একটা ছোট প্রাকার তৈরি করে পূর্ব বার্লিনবাসীদের তোরণে আসার পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়৷ ছবিতে সে আমলের একটি ফলক: ‘‘সাবধান! আপনি পশ্চিম বার্লিন ছেড়ে যাচ্ছেন৷’’
‘মিস্টার গর্বাচভ, এই দেয়ালটা ভেঙে ফেলুন!’
১৯৮৭ সালের ১২ই জুন তারিখে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান যখন ব্রান্ডেনবুর্গ তোরণের সামনে একটি জনসমাবেশে এই কথাগুলি বলেন, তখন মাইকের কল্যাণে পুবের বাসিন্দারাও তা শুনতে পেয়েছিলেন৷ ইতিহাস বলে, মিস্টার গর্বাচভও সে আহ্বান শুনতে পেয়েছিলেন...৷
পুনরেকত্রীকরণের প্রতীক
১৯৮৯ সালের ৯ই নভেম্বর তারিখে যখন বার্লিন প্রাকারের পতন ঘটে, তখন হাজার হাজার মানুষ সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তটি উদযাপন করার জন্য ব্রান্ডেনবুর্গ তোরণের সামনে সমবেত হন৷ ব্রান্ডেনবুর্গ তোরণ হয়ে ওঠে স্বাধীনতা ও একতার প্রতীক৷ সেবছরের ডিসেম্বর মাসেও ব্রান্ডেনবুর্গ তোরণ সীমান্ত পারাপারের একটি কেন্দ্র ছিল৷ ব্রান্ডেনবুর্গ তোরণ পুরোপুরি নতুন করে সাজানো হয় ২০০০ সালে৷