স্বপ্নদীপের মৃত্যুতে 'ঘুম ভাঙলো যাদবপুর কর্তৃপক্ষের
১৫ আগস্ট ২০২৩কর্তৃপক্ষের পাশপাশি আঙুল উঠছে ছাত্র নেতৃত্বের দিকেও। এই ঘটনা নিয়ে শাসক ও বাম শিবিরের মধ্যে চাপানউতোর শুরু হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পদক্ষেপ
১০ আগস্ট যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন হোস্টেলের তিনতলা থেকে পড়ে মারা যান প্রথম বর্ষের পড়ুয়া স্বপ্নদীপ কুণ্ডু। র্যাগিংয়ের জেরে তার এই মৃত্যু বলে অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় তোলপাড়। তাতে 'ঘুম' ভেঙেছে কর্তৃপক্ষের।
সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যান্টি র্যাগিং কমিটির বৈঠক হয়েছে ইউজিসির নিয়ম মেনে। রেজিস্ট্রার স্নেহমঞ্জু বসু জানিয়েছেন, "যারা পাশ করে গিয়েছেন, তাঁদের কেউ হোস্টেলে থাকলে তিনদিনের মধ্যে হোস্টেল ছাড়তে হবে। বুধবার কিংবা বৃহস্পতিবার হোস্টেলে গিয়ে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখা হবে।" প্রথম বর্ষের ছাত্ররা এবার থেকে অন্য হোস্টেলে থাকবেন বলে সিদ্ধান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের। সাংবাদিক বৈঠকে অংশ নিয়ে কেঁদেও ফেলেন রেজিস্ট্রার।
নজরে বহিরাগতরা
তদন্তে পুলিশের নজরে কয়েকজন বহিরাগত পড়ুয়া। যাদের একটা বড় অংশ স্বপ্নদীপের রহস্যমৃত্যুর পর হোস্টেল ছেড়ে চলে গিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট ঘটনার ভিডিও হাতে পেতে মরিয়া তদন্তকারীরা। ধৃতদের মোবাইল ফোন থেকে সূত্র মিলতে পারে বলে তারা মনে করছেন। একইসঙ্গে হোস্টেলের কর্মীদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। স্বপ্নদীপকে হেনস্থা করার সময় উপস্থিত অন্য যে ছাত্রদের নাম উঠে আসছে ধৃতদের জেরা করে, তাদের খোঁজে তল্লাশি চালাচ্ছে পুলিশ।
মুখ্যমন্ত্রীর আক্রমণ
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় বামপন্থী রাজনীতির গড় হিসেবে পরিচিত। মূলধারার বাম দলের পাশাপাশি অন্যান্য বামপন্থি ছাত্র সংগঠনও এখানে সক্রিয়। স্বপ্নদীপের মৃত্যুর জন্য বামেদের নিশানা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, "কিছু আগমার্কা সিপিএম আছে, তারা মনে করে নতুন ছেলেমেয়েরা গ্রাম বাংলা থেকে এসে ঢুকলেই তাদের উপর অত্যাচার করা ওদের অধিকার।” এ প্রসঙ্গে সরাসরি রাজনীতিতে ঢুকে পড়েন মুখ্যমন্ত্রী। বলেন, "কারা এরা? মার্কসবাদী। তৃণমূল ওদের এখনও এক নম্বর শত্রু। এটা রেড ফোর্ট। মানে ওদের জমিদারি। ওখানে পুলিশকে ঢুকতে দেয় না, সিসিটিভি লাগাতে দেয় না। র্যাগিং করে ছাত্রদের উপর যা তা।”
এর জবাবে সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেন, ‘‘যারা ছেলেটাকে মেরেছে তাদের গুরুদের মমতা জঙ্গলমহলে পাঠিয়েছিলেন সিপিএমকে খুন করার জন্য। ওই মার্কসবাদীদের উনি নিজের দলেও ঢুকিয়েছিলেন, মন্ত্রী বানিয়েছিলেন। আর এখন গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন।''
র্যাগিং রুখতে কমিটি
র্যাগিং ঠেকাতে সোমবার একগুচ্ছ নির্দেশিকা জারি করেছে উচ্চশিক্ষা দপ্তর। তৈরি করা হয়েছে জেলা ও রাজ্যভিত্তিক অ্যান্টি র্যাগিং কমিটি। সব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অ্যান্টি র্যাগিং কমিটি ও নজরদারির জন্য মনিটরিং সেল তৈরি করতে হবে। যদি কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ র্যাগিংয়ের অভিযোগ পেয়েও ব্যবস্থা না নেন, তাহলে রাজ্য স্তরের কমিটি সেই অভিযোগ খতিয়ে দেখবে। জেলাভিত্তিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নতুন পড়ুয়াদের মধ্যে ১৫ দিন অন্তর সমীক্ষা করে দেখা হবে যে, তারা র্যাগিংয়ের শিকার হচ্ছেন কি না।
তৎপর দুই কমিশন
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মৃত্যুর ঘটনায় রাজ্য ও বিশ্ববিদ্যালয়কে নোটিস পাঠিয়েছে ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। তাদের মতে, ছাত্রের মৃত্যুর পিছনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ব্যর্থতা এবং নজরদারির অভাব রয়েছে। চার সপ্তাহের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে বলেছে মানবাধিকার কমিশন।
পশ্চিমবঙ্গ শিশু অধিকার রক্ষা কমিশন জানিয়েছে, ছাত্র মৃত্যুতে পকসো-র ধারায় তদন্ত করা হবে। স্বপ্নদীপের বয়স মৃত্যুকালে ছিল ১৭ বছর ৯ মাস ৯ দিন। কমিশনের চেয়ারপার্সন সুদেষ্ণা রায় বলেন, ‘‘যা ঘটেছে তার পিছনে কর্তৃপক্ষের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় রয়েছে।''
প্রতিবাদে পথে
স্বপ্নদীপের মৃত্যু ঘিরে প্রতিবাদের ঝাঁঝ ক্রমশ তীব্র হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে নানা সংগঠন। এসএফআই নিয়ন্ত্রিত আফসু বা আর্টস ফ্যাকাল্টি স্টুডেন্টস ইউনিয়ন গোড়া থেকে লাগাতার আন্দোলনে। ক্যাম্পাসে সোমবার বিক্ষোভ দেখায় এআইএসএ। তৃণমূল ছাত্র পরিষদ সোমবার থেকে প্রতিবাদে নেমেছে। যাদবপুরে তৃণমূল প্রভাবিত কর্মী সংগঠন মিছিল করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চার নম্বর গেট থেকে দক্ষিণাপণ পর্যন্ত মিছিল হয়।
অধ্যাপকরাও সোচ্চার হয়েছেন অনাচারের বিরুদ্ধে। যাদবপুরের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রধান ইমনকল্যাণ লাহিড়ির বক্তব্য, "জনমানসে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ভাবমূর্তি আছে। সেখানে কয়েকজন গুন্ডা, বদমাশ বাস করবে, এটা কোনো ভাবে মেনে নেয়া যায় না। মানসিক ভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে কেউ নিপীড়ন চালালে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। রাজনীতি সবাই করতে পারে, কিন্তু তার উপর ভিত্তি করে অত্যাচার চালানো যায় না।"
'কলরব' কোথায়?
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় উত্তাল হয়েছিল 'হোক কলরব' আন্দোলনে। কিন্তু এবার মর্মান্তিক ঘটনার পরেও 'কলরব' শোনা যাচ্ছে না কেন, এই প্রশ্ন উঠেছে।
'হোক কলরব'-এ মুখ্য ভূমিকায় ছিল ডিএসএফ অর্থাৎ স্বাধীন সংগঠন। এর সঙ্গে অন্য স্বাধীন নেতৃত্ব যেমন এফএএস, ডাব্লুটিআই এখনও সেভাবে ময়দানে নামেনি। এই ঘটনায় এখনো পর্যন্ত যে তিনজন গ্রেপ্তার হয়েছে, তারা স্বাধীন সংগঠন করত বলেই অভিযোগ।
বছর আটেক আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী 'হোক কলরব'-এর জেরে অপসারিত হয়েছিলেন। তার মতে, "ফ্লাডলাইট, সিসিটিভি, বহিরাগতদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আমি উদ্যোগী হয়েছিলাম। কিন্তু সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য সেসব কার্যকর হয়নি। উল্টে আমাকেই সরে যেতে হয়েছে।"
ছাত্রনেতাদের নিশানা করে তিনি বলেন, "শুধু কর্তৃপক্ষ নয়, সেই সময় যে রাজনৈতিক দল ও ছাত্র নেতৃত্ব আমার উদ্যোগকে রুখে দিয়েছিল, তারাও সমান দায়ী আজকের পরিস্থিতির জন্য।"