সৌন্দর্যের কি কোনো সংজ্ঞা আছে?
১ নভেম্বর ২০১৪কথাটা উঠল, কেননা ভিকটোরিয়া'স সিক্রেট-এর সর্বাধুনিক পোস্টার ক্যাম্পেইনে অন্তর্বাস পরিহিত তন্বী মডেলরা ছাড়াও একটা লিজেন্ড দেখা যাচ্ছে: দ্য পার্ফেক্ট ‘বডি'৷ খেয়াল রাখবেন, শুধু ‘বডি' কথাটাই কোটেশন-মার্কে, কেননা পুরো রেঞ্জটার নামই ‘বডি'; সাথে ‘দ্য পার্ফেক্ট' বিশেষণটি যোগ করে প্রলোভন আর প্ররোচনা, দুই-ই বাড়ানো হয়েছে৷
আসলে তো একটা অ্যাডভার্টাইজিং পিলার-এর গায়ে সাঁটা পোস্টারে তিনজন অন্তর্বাস পরিহিতা রমণী খুশি-খুশি মুখ করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন৷ মহিলাদের আন্ডারওয়্যারের বিজ্ঞাপন পশ্চিমি দুনিয়ায় নতুন নয়, এবং এই বিশেষ দ্রষ্টব্যটিকে বিশেষ রগরগে মনে হওয়ারও কোনো কারণ নেই৷ তা সত্ত্বেও পোস্টারটি নিয়ে ঝড় বয়ে গেছে৷ চার হাজার মানুষ অনলাইনে একটি ভার্চুয়াল পিটিশনে স্বাক্ষর করে দাবি করেছেন যে, ভিক্টোরিয়া'স সিক্রেট-কে ক্ষমা চাইতে হবে, কেননা এই ধরনের বিজ্ঞাপন তরুণী মহিলাদের আত্মমর্যাদার হানি করে; মহিলারা ভাবেন, তাঁদের পার্ফেক্ট বডি নেই বলে তাঁরা আকর্ষণীয় নন; অপরদিকে পুরুষরাও শেখেন মহিলাদের একটা বিশেষ (শারীরিক বা দৈহিক) দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে এবং তদনুরূপ অমর্যাদা করতে৷
আমার বয়স হয়েছে৷ পারিবারিক পরিস্থিতি এই যে, আমি আছি, গিন্নি আছেন, আছেন আমার দুই মেয়ে.... মেয়েরা অবশ্য বহুদিন আগেই বাড়ি ছেড়েছে৷ সারা জীবন এই তিন মহিলার খিদমত খেটে পুরুষ হিসেবে আমার যেটুকু জ্ঞান হয়েছে, সেটা হলো এই যে, মহিলারা অন্যের জন্য সুন্দরও হতে চান না অথবা সাজগোজও করেন না৷ যে পুরুষরা ভাবেন ঐ সব সাজগোজ তাদের জন্য, তারা হলেন অতি – ঐ যে বললাম, পুরুষ৷
ঠিক একই ভাবে: মহিলারা সাধারণত গরমকাল এবং সমুদ্রসৈকতে বিকিনি পরার সিজন আসার বহু আগে থেকেই খুব ভালোভাবে জানেন, শরীরের কোন অক্ষাংশে ক'ইঞ্চি বাড়ানো কি কমানো দরকার – যা-তে স্ট্র্যান্ডে হাঁটতে গিয়ে অন্যান্য মহিলাদের সপ্রশংস কিংবা স-হিংস দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়৷ পুরুষ বলে একটা জীবও যে কাছে-ধারে থাকে না, এমন নয়৷ কিন্তু পুরুষরা সৌন্দর্যের আবার বোঝে কি? ওরা তো চায় ঐ – বাকিটা সতীনাথ ভাদুড়ির প্রখ্যাত ছোটগল্পে পড়ে নেবেন৷
নারীসৌন্দর্য যদি সেই রূপকথার অরণ্য হয়, তাহলে পুরুষরা চন্দনকাঠের বন অবধি গিয়েই আটকে থাকেন৷ তার পরেও যে অনেক রুপোর খনি, সোনার খনি আছে, বেচারা পুরুষ সে অবধি পৌঁছালে তো: আগে থেকেই নোলা দিয়ে জল ঝরে সে এক কাণ্ড! কাজেই মহিলারা ‘আমায় কেমন দেখাচ্ছে', ‘আমি এ' রাজ্যের সেরা সুন্দরি কিনা', এ সব প্রশ্ন সাধারণত নিজের আয়নাকেই করে থাকেন, বর কিংবা প্রেমিককে নয়৷ রূপকথাতেও তাই: ‘স্নোহোয়াইট'-কে মনে আছে তো?
তাই ভিক্টোরিয়া'স সিক্রেট কোম্পানি তাদের সব ফ্লোর শো থেকে বিজ্ঞাপনে ভান করে, যেন (১) এই সব পরিচ্ছদ পরিধান করলে নাকি বর অথবা বয়ফ্রেন্ডের মুণ্ডু ঘুরে যাবে; (২) যে মহিলা সেই সব অমূল্য বস্তু পরিধান করছেন, তাদের রূপ দেখে (মহিলা) বন্ধুবান্ধবরা হিংসেয় লাল-নীল-সবুজ হয়ে যাবেন৷ আসলে কিন্তু মহিলারা ঠিকই ধরেছেন: ভিক্টোরিয়া'স সিক্রেট শুধু নয়, বিশ্বের গোটা অ্যাডভার্টাইজিং ইনডাস্ট্রি, সেই সঙ্গে পপ সংগীতের জগৎ, পর্নোগ্রাফিকেই বা বাদ দিই কি করে – সব শেয়ালের এক রা৷ সবাই মিলে এক কাল্পনিক মহিলার কাল্পনিক রূপসুধা পান করাচ্ছে ছেলে-বুড়ো-কিশোরী-তরুণী-প্রবীণা, সকলকে৷
এক মিটার পঁচাশি সেন্টিমিটার উচ্চতার, এই ধরুন ৪৫ কিলো ওজনের এক সুন্দরী, হঠাৎ বাতাসের ঝাপটা এলে যার উড়ে যাওয়ার সম্ভবনাই বেশি, সেই সুন্দরী যদি অন্তর্বাস পরে পোস্টার সেজে পিলারে চড়ে বসেন, তাহলেই যে পৃথিবীর সব ঠান্ডা মাথার, চালাক-চতুর মহিলারা ‘ওমা আমাকে কি খারাপ দেখতে, ওমা আমার বিয়ে হবে না' বলে হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে শুরু করবেন – অতদূর বোকা আমি, কিংবা আমার গিন্নি, কিংবা আমার দুই মেয়ের কেউই নন৷
ব্যাপারটা কি জানেন? মহিলাদের আত্মবিশ্বাস যেমন অভিজাত অন্তর্বাস থেকে আসে না, তেমনি কোনো ঠুনকো বিজ্ঞাপনের পিতৃদেবের ক্ষমতা নেই, সে' আত্মবিশ্বাস কেড়ে নেওয়ার৷