সোনামসজিদ চত্বরে অযত্নে শুয়ে আছেন বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর
২৩ মার্চ ২০১১বরিশালে ছেলেবেলা
মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের জন্ম বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ এলাকায়৷ তাঁর ছোটবেলা কেটেছে বরিশালেই৷ ১৯৬৬ সালে ব্রজমোহন কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন তিনি৷ মাষ্টারদা সূর্য সেনের জীবনীগ্রন্থ, ক্ষুদিরামের ফাঁসি, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা, চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন এবং প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের জীবনী সহ বহু গ্রন্থ জাহাঙ্গীর পড়েছেন ছাত্র জীবনেই৷ বাংলার স্বাধীনতা নিয়ে তাঁর বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ পায় সেসময়৷
ফিরে আসা
১৯৬৭ সালে এই সাহসী তরুণ যোগ দেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে৷ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তিনি ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাকোরামে৷ পূর্ব পাকিস্তানে তখন গণহত্যা চালাচ্ছে পশ্চিমিরা৷ এই খবর শুনে আর শান্ত থাকতে পারেননি জাহাঙ্গীর৷ ফিরে আসেন নিজের জন্মভূমিতে, যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে৷
কেমন ছিলেন জাহাঙ্গীর?
বাংলাদেশ সরকার এর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ১২ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী জাহাঙ্গীর এর নেতৃত্বে চাঁপাইনবাবগঞ্জ আক্রমণ করে৷ এসময় তাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পান অপর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ এনামুল হক৷ তাঁর কাছে জানতে চাই, জাহাঙ্গীর কেমন ছিলেন? এনামুল বলেন, অত্যন্ত ভালো মানুষ৷ একজন সেনা অফিসার, যিনি পাকিস্তানকে থেকে চলে এসেছিলেন দেশমাতাকে মুক্ত করার জন্য৷ তিনি ছিলেন দরদী একজন মানুষ৷ তার সহযোদ্ধাদের কেউ যখন আহত হয়েছেন বা মৃত্যু বরন করেছেন, তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েছেন৷ মানুষ হিসেবে অত্যন্ত ভালো ছিলেন তিনি৷
চাঁপাইনবাবগঞ্চে অভিযান
১৪ই ডিসেম্বর ভোররাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জকে দখলের চূড়ান্ত অপারেশন শুরু করেন জাহাঙ্গীর৷ তিনি জানতেন, এই অভিযান অনেক ঝুঁকিপূর্ণ৷ তবুও মাত্র ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে তিনি অভিযান শুরু করেন৷
গুণিজন ডটকম এর তথ্য অনুযায়ী, রেহাইচর এলাকা দিয়ে জাহাঙ্গীররা মহানন্দা নদী পায়ে হেঁটে পাড়ি দিলেন৷ উত্তর দিক দিয়ে আক্রমণের সূচনা করা হলো৷ অতর্কিত হামলা করে বেয়নটের মাধ্যমে শত্রু খতম করতে করতে তাঁরা এগোতে লাগলেন দক্ষিণ দিকে৷ ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর এমনভাবে আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিলেন যাতে উত্তর থেকে শত্রু নিধন করার সময় শত্রুরা দক্ষিণ দিক থেকে গুলি করতে না পারে৷ সম্মুখ ও হাতাহাতি যুদ্ধ ক্রমেই তীব্র আকার ধারণ করতে থাকে৷ আর মাত্র কয়েকটা বাঙ্কারের পাকসেনা বাকি৷ তখনই দেখা দিল সমস্যা৷ হঠাৎ একটা গুলি এসে বিঁধ'ল ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের কপালে৷ সেদিন সকালে পাকিস্তানী বাহিনীর এই স্নাইপার বুলেটের আঘাতে শহীদ হন জাহাঙ্গীর৷
মরদেহ উদ্ধার
এই মুক্তিসেনার মরদেহ উদ্ধার করেন তাঁর সহযোদ্ধারা৷ সেই দলে ছিলেন এনামুল হকও৷ তিনি বলেন, ১৫ তারিখ সকালে আমরা ওনার মরদেহ উদ্ধার করে সোনামসজিদে পাঠিয়ে দেই৷ তাঁর অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়৷
এনামুল হক জানান, সোনামসজিদ চত্বরে জাহাঙ্গীর এর সমাধিটি পড়ে আছে অযত্ন অবহেলায়৷ সরকার বিভিন্ন সময় এটিকে সংস্কারের উদ্যোগ নিলেও তা বাস্তব রূপ পায় না৷ তাঁর কথায়, বিজয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবস আসলে সরকার তড়িঘড়ি করে কিছু কাজ করতে চায়৷ কিন্তু স্থায়ী একটা যে ইমারত ওখানে করা, সেই কাজটা এখনো করে নাই৷ আমরা আশা করছি যে, বর্তমান সরকার এটা করবেন৷
স্বাধীন বাংলাদেশ
বাংলার সবুজের কোলে লাল সূর্য এঁকে দিয়ে গেছেন জাহাঙ্গীররা, স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ৷ কিন্তু সেই স্বাধীন বাংলাদেশ কি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরেছে? স্বাধীনতার চল্লিশ বছর এনামুলের জবাব, আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি, বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরতে পেরেছে৷ কিন্তু যে উদ্দেশ্যে যুদ্ধটা ছিল মানে মানুষের মুক্তি, অর্থনীতির মুক্তি এবং অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফোটানো কিংবা প্রতিটি ঘরে স্বাধীনতা স্বাদ পৌঁছে দেওয়া -- এগুলো এখনো সম্ভব হয়নি৷
উল্লেখ্য, বরিশালে জাহাঙ্গীরের পরিবারের দান করা জায়গার ওপর সরকারি খরচে নির্মাণ করা হয়েছে বীরশ্রষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগার৷ এছাড়া, সেখানকার একটি ইউনিয়নেরও নামকরণ করা হয়েছে ‘মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর'৷
প্রতিবেদন: আরাফাতুল ইসলাম
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন