সুষ্ঠু নির্বাচনে শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারই ‘যথেষ্ট নয়’
২৬ অক্টোবর ২০২৪এরইমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য যে ১০টি কমিশন গঠন করেছে তার মধ্যে সংবিধান, বিচার বিভাগ ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য তিনটি কমিশন আছে৷ আদালত যদি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার পক্ষে রায় দেয় তাহলে তার প্রক্রিয়া কী হবে?
বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশে একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার থাকা দরকার৷ কারণ ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পর এটা প্রমাণ হয়েছে যে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হয় না৷ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যে নির্বাচন হয়েছে তার গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি৷ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায় দিলেও সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তুলে দেয়া হয় পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে৷ উচ্চ আদালতে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলেও রিট হয়েছে এবং আদালত রুল দিয়েছেন৷
প্রথমে সুশাসনের জন্য নাগরিক এই রিভিউ আবেদন করলেও পরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল(বিএনপি) ও জামায়াতে ইসলামী ও আবেদনের পক্ষভুক্ত হয়৷ ১৭ নভেম্বর আপিল বিভাগ তিনটি রিভিউ আবেদনই এক সঙ্গে শুনবেন৷
আইনজীবীদের মতামত
আইনজীবীরা বলছেন সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে হাইকোর্টের যে রায় তা মানা সরকারের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল না৷ এছাড়া ওই রায়ে অন্তত আরো দুইটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার কথা ছিল৷ কিন্তু তখনকার আওয়ামী লীগ সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে ফিরে যায়৷ এই প্রক্রিয়ায় গত তিনটি নির্বাচন করে ক্ষমতায় থেকেছে আওয়ামী লীগ৷
বিএনপি নেতা ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘‘আসলে আওয়ামী লীগ নিজেদের স্বার্থেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছিল৷ তবে শুধু ওই ব্যবস্থা এখন ফিরিয়ে আনাই যথেষ্ঠ নয়৷ এর সঙ্গে যদি আরো সংস্কার করা প্রয়োজন তাও করতে হবে৷ ওয়ান ইলেভেনের সময় যে অন্তর্বর্তী সরকার ছিল তারা তো আসলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল না৷ এইরকম যাতে আর না হয় তাও দেখতে হবে৷’’
তার জানান, ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের বিরুদ্ধে এখন যে তিন পক্ষের রিভিউ তা পুরো শুনানি হতে কিছুটা সময় লাগবে৷ কারণ রিভিউ আপিল বিভাগ গ্রহণ করলে আবার পূর্ণাঙ্গ আপিল করতে হবে৷ তিনি বলেন, ‘‘আমার মতে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করে দিলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরে আসবে৷ এটা নিয়ে যে রিট হয়েছে তার ওপর রুলও জারি করা হয়েছে৷’’
তার মতে বাংলাদেশে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা থাকা জরুরি৷ ওই সরকার যদি নিরপেক্ষ না হয় তাহলে নির্বাচন কমিশনের করণীয় কিছু থাকে না৷
আরেকজন আইনজীবী ব্যারিস্টার ওমর ফারুক উচ্চ আদালতের মাধ্যমে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা ফিরে আসার ব্যাপারে আশাবাদী৷
নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন আইন সংস্কারের উপরও জোর দেন৷ বলেন, ‘‘সংসদ সদস্যদের ফ্লোর ক্রসিং-এর বিরুদ্ধে সংবিধানের সাত অনুচ্ছেদ বাতিল করতে হবে৷ আর প্রার্থীদের যোগ্যতার বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে৷ একই সঙ্গে নির্বাচনি সভা-সমাবেশ হতে হবে নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে৷ তাহলে কালো টাকার দৌরাত্ম কমবে৷ আশা করি সংস্কার কমিশনে যারা কাজ করছেন তারা এগুলো দেখবেন,'' বলেন তিনি৷
সংস্কার কমিশন যা ভাবছে
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. জাহেদ উর রহমানের মতে আওয়ামী লীগের শাসনামলে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে প্রতারণা করা হয়েছে৷ সংক্ষিপ্ত রায়ে ছিলো দুইটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার কথা থাকলেও পূর্ণাঙ্গ রায়ে সেটা পরিবর্তন করা হয়৷ তিনি বলেন, ‘‘এটা ছিল একটা অসৎ রায়৷’’
নির্বাচনি ব্যবস্থা নিয়ে কমিশনের ভাবনা বিষয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমরা মনে করি আমাদের দেশের অভিজ্ঞতা হলো নির্বাচন কমিশন যতই স্বাধীন হোক না কেন দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়৷ তাই নির্বাচনের সময় নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারও থাকতে হবে৷ শুধু জাতীয় নির্বাচন নয়, সব নির্বাচনে এটা কীভাবে করা যায় আমরা সেটা নিয়ে কাজ করছি৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘সামনের নির্বাচনে যদি আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ পায় দেখবেন তারাও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চাইবে৷’’
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রেক্ষাপট
১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানে এরশাদ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারে অধীনে সাধারন নির্বাচন হলেও সংবিধানে তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান যুক্ত করা হয়নি৷ ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের চাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান এনে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী সংসদে পাস করে বিএনপি সরকার৷ আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে আবার ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ১৯৯৮ সালে তিনজন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন৷ বিএনপি সরকারের সময়ে ২০০৪ সালের ৪ অগাস্ট সেই রিট খারিজ হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল থাকে৷ হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৫ সালে আপিল করেন রিটকারীরা৷ ২০০৬ সালে রাজনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে জরুরি অবস্থা জারির পর গঠিত সেনা সমর্থিত তত্ত্ববধায়ক সরকার দুই বছর ক্ষমতায় থাকে৷ যদিও সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ ছিলো তিন মাস৷
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে ২০১০ সালের ১ মার্চ আপিল বিভাগে ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার শুনানি শুরু হয়৷ শুনানিতে আপিল আবেদনকারী এবং রাষ্ট্রপক্ষ ছাড়াও অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে শীর্ষস্থানীয় আট জন আইনজীবী বক্তব্য দেন৷ তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দেন৷ এমনকি তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও এর পক্ষে মত দেন৷
ওই আপিল মঞ্জুর করে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ ২০১১ সালের ১০ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন৷ তখন প্রধান বিচারপতি ছিলেন এবিএম খায়রুল হক৷ তবে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হওয়ার আগেই ২০১১ সালের ৩০ জুন আওয়ামী লীগ সরকার জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাশ করে এবং রাষ্ট্রপতি ৩ জুলাই তাতে অনুমোদন দেন৷ ওই সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়৷
ওই একই সংশোধনীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়া হয়৷ এছাড়া জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০ করা হয়৷ সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা পুনর্বহাল করা হয়৷ রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি সংযোজন করা হয়৷
রিভিউ আবেদন ও রিট
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত আগস্টে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল চেয়ে একটি রিট আবেদন করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচজন৷ ওই রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে রুল জারি করে হাইকোর্ট৷ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী কেন অবৈধ হবে না, তা জানতে চাওয়া হয় ওই রুলে৷ আর ওই আগস্ট মাসেই ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আপিল বিভাগে রিভিউ আবেদন করেন সুশাসনের সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচজন৷ এরপর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একই আর্জি জানিয়ে আরেকটি আবেদন করেন৷ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকেও আবেদন করা হয়৷