সুবিধার বইমেলা, সমস্যার বইমেলা
৩০ জানুয়ারি ২০১৭পুলিশকে যেতে হলো লাঠিচার্জের পথে৷ সেই লাঠিচার্জ দেখতে দেখতে মনটা একটু খারাপ হয়েছিল, ‘‘এভাবে পুলিশ লাঠিচার্জ করে বই কেনাটা থামিয়ে দিচ্ছে!'' কিন্তু বই কেনা থামলো কোথায়, উল্টো বরং বিপুল উদ্যমে মানুষ আরও ঝাঁপাচ্ছে৷ লাঠির বাড়ি খেয়ে মাটিতে ছিটকে পড়ছে আবার উঠে দাঁড়িয়ে বই হাতে নিয়ে লাইনে দাঁড়াচ্ছে৷ প্রিয় লেখকের অটোগ্রাফ নেবে৷ সেই লেখকের নাম? ঠিক ধরেছেন – হুমায়ূন আহমেদ!
বিষণ্ণ মনটাতে হঠাৎ একটা চিন্তা ঝিলিক দিলো৷ আচ্ছা, এই ছবি দেখলে পৃথিবীর মানুষ ভাববে এই দেশটা কী সংস্কৃতিমুখী! বই কেনার জন্য মার খায়!
যে ছবি দিয়ে পুরো দুনিয়াকে দেখানো যায় যে বাংলাদেশিরা বইয়ের জন্য পাগল সেই দেশের আসল অবস্থা কিন্তু সে রকম নয়৷ বছরের বেশিরভাগ সময় প্রকাশকরা মুখ গোমড়া করে থাকেন৷ একদিন ভর দুপুরে ঢাকার ব্যস্ত মার্কেটের বইয়ের দোকানে গিয়ে কর্মচারীদের তিনজনকেই ঘুমিয়ে থাকতে দেখেছি৷ পুরো বিষয়টা একটা চক্রের মতো৷ বইমেলায় বই বিক্রি হয় বলে বাকি সময় কেউ আর বইয়ের খোঁজখবর রাখে না৷ মানুষের কাছে বই যে শুধু বইমেলার সময় কেনার জিনিস৷ আবার মানুষ বইমেলার সময় বই কিনে বলে প্রকাশকরা বইও বের করেন শুধু বইমেলাতে৷ প্রতি বছর বইমেলা এলে এই নিয়ে একটা হাহাকার শোনা যায়৷ গণ্য-মান্য, প্রাজ্ঞ-বিজ্ঞ লোকজন সেমিনারে ঝড় ছুটিয়ে দেন, ‘‘মেলাকেন্দ্রিক প্রকাশনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে৷'' নিজেও যে একটা সময় এর সঙ্গে তাল মেলাইনি, এমন নয়৷ কিন্তু এখন ভেবে দেখলে মাঝেমধ্যে একটা বিভ্রান্তিতে পড়ে যাই৷ মনে হয়, বইমেলা একদিক থেকে চিন্তা করলে একটা সমস্যা, কিন্তু আরেক দিক থেকে চিন্তা করলে তো দারুণ সুবিধার৷
একটু ব্যাখ্যা করি৷
এখন দেশের মোট বইয়ের শতকরা ৯০ ভাগ কিংবা তারও বেশি প্রকাশিত হয় বইমেলাকে কেন্দ্র করে৷ মেলার ডেডলাইন ধরতে গিয়ে বাঁধাই, প্রুফ ইত্যাদি কাজে তাড়াহুড়ো থাকে৷ বইয়ের মান অনেক ক্ষেত্রেই থেকে যায় প্রশ্নবিদ্ধ৷ তাছাড়া একসঙ্গে কয়েক হাজার বই বের হয় বলে পাঠকদেরও খাবি খেতে হয় সঠিক বই খুঁজতে গিয়ে৷
এ সবই সমস্যার কথা৷ কিন্তু ধরা যাক, বাংলাদেশে বইমেলা বলে কিছু হয় না, তাহলে কী হতো! প্রথম কথা, বইয়ের প্রকাশ অনেক কমে যেত৷ এখন মেলা উপলক্ষ্যে যে একটা উৎসব হয়, তাতে শরিক হওয়ার জন্যও বই প্রকাশের একটা উৎসাহ তৈরি হয়৷ প্রকাশকদের ক্ষেত্রেও কথা সত্য৷ মেলা হচ্ছে, প্রকাশকদেরও বেশি বই-ভালো বই প্রকাশ করে অন্যদের হারিয়ে দেয়ার একটা তাগিদ থাকে৷ মেলা না হলে এর কিছুই বোধ হয় হতো না৷ আর প্রচার-প্রসার-উৎসব সব কিছু মিলিয়ে মেলা আমাদের সামাজিক জীবনে এমন একটা আলোড়ন তৈরি করে যে বইমেলায় যাওয়াটাকে একটা দায়িত্ব মনে করে শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা৷ বাচ্চাদের চাহিদাও আছে৷ মেলা না হলে সেই তাগিদটুকু থাকত না আর তখন যে এরা যে বছরের অন্য সময় ঘুরে ঘুরে বই কিনতেন এমন গ্যারান্টিও দেয়া যায় না৷
অন্য যেসব ক্ষেত্রে এমন মেলার ব্যবস্থা নেই, যেমন গানের সিডি, সেই ক্ষেত্রে পুরো বছরই সিডি বের হয়, কেনার সুযোগ থাকে, কিন্তু কেউ তেমন একটা কেনে না৷ এখন ই-যুগে সিডির দরকার নেই বলেই বিক্রি হয় না – অনেকে বলবেন, জানি৷ কিন্তু কেন যেন মনে হয়, সেখানেও যদি একটা মেলা থাকত, তাহলে ঠিক বইমেলার মতো একটা অবস্থা তৈরি হতো৷ ঐ একটা সময় গানটা চলত৷ নতুন কী গান বের হলো না হলো এই খোঁজ হতো৷ মিডিয়াও মনযোগ দিতো৷ বই ‘মেলাকেন্দ্রিক হয়ে গেছে' বলে যে হাহাকার হয়, তার সঙ্গে পুরো একমত তাই বোধহয় হওয়া যায় না৷
শুরুতে হুমায়ূন আহমেদের বই কেনার লাইনের কথা বলছিলাম৷ এটা কাউকে বলে দেয়ার দরকার নেই, বইমেলা নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকেই আসলে হুমায়ূনমেলা হয়ে গিয়েছিল৷ এমনই প্রভাব ছিল তাঁর যে, যাঁরা মেলায় যেতেন, তাঁদের শতকরা ৮০ ভাগের প্রথম লক্ষ্যই থাকত হুমায়ূন আহমেদের একটা বই কেনা, তারপর বাকিটা দেখা যাবে৷ তাঁর অকাল প্রয়াণের পর তাই মেলার ভাগ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল৷ মেলা তবু চলছে, বইপত্র বিক্রিও হচ্ছে, কিন্তু একটা ভাটার টান আছে৷
বছর দুয়েক আগে ফেব্রুয়ারিতে মেলায় যাওয়ার পথে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা৷ মেলায় যাচ্ছি শুনে আফসোসের মতো উচ্চারণ, ‘‘এখন আর মেলায় যাই না৷''
জানতাম হুমায়ূন আহমেদের খুব ভক্ত৷ বললাম, ‘‘হুমায়ূন আহমেদ নেই বলে...?''
‘‘হ্যাঁ৷''
‘‘কিন্তু যতদূর দেখেছি তুমি তো অন্য বইপত্রও কিনতে হুমায়ূন আহমেদের পাশাপাশি৷''
‘‘তা কিনতাম৷''
‘‘তাহলে?''
‘‘ওগুলো পরে কোনো একসময় কিনে নেব৷ মেলায় গিয়ে ঠ্যালাঠ্যালির দরকারটা কী?''
শেষ কথাটা মাথায় চেপে রইল৷ যেদিন বের হবে সেদিনই কিনতে হবে – এ রকম পাঠক বাংলাদেশে একজনই তৈরি করেছিলেন৷ হুমায়ূন আহমেদ৷ ফলে মেলায় যেতে একদল মানুষ বাধ্য ছিল৷ আর মেলায় গেলে তখন হুমায়ূন আহমেদ শেষ করে অন্য বইও কিনত৷ এখন হুমায়ূন নেই বলে মেলায় যাওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই৷ আর তাই ‘‘অন্য বই পরে কোনো একসময় কেনা যাবে'' ধরে নিয়ে অনেকেই উদাস হয়ে বসে থাকেন৷ খুব সম্ভবত সেই পরের সময়টা আর আসেই না৷ হুমায়ূনের অনুপস্থিতির শূন্যতা মেলাকে এভাবেই ভোগাচ্ছে৷
বিক্রির বাইরে আরেকটা হুমায়ূনী প্রভাবের কথা বলি৷ এটাও একটা গল্প থেকে পাওয়া শিক্ষা৷ এক প্রকাশক একবার আফসোস করে বলছিলেন, ‘‘আমাদের তথাকথিত বড় লেখকরা হুমায়ূন আহমেদের এত নিন্দা-মন্দ করে অথচ এরা জানেও না হুমায়ূন তাদের কী উপকার করছেন৷''
‘‘কীরকম উপকার?'' একটু চমকে গিয়ে জানতে চাই৷
‘‘ধরো যে বছর আমি হুমায়ূনের বই পাই নিশ্চিতভাবে অনেক লাখ টাকার ব্যবসা৷ সে বছর আমি কয়েকটা প্রবন্ধের বই, গবেষণার বইয়ের মতো চাহিদা নেই এরকম লেখকদের বইও বের করতে পারি৷ অথচ এই এরাই হুমায়ূন আহমেদকে পারলে গিলে খায়৷''
হুমায়ূনের এই প্রভাবটাও বই প্রকাশে পড়ছে৷ এখনও তার কিছু অপ্রকাশিত বই, সমগ্র ইত্যাদির টান আছে বলে খুব বড় আকারে ধাক্কাটা টের পাওয়া যাচ্ছে না৷ কয়েক বছর পর ধাক্কাটা বড় হলে কী হয় সেটা দেখার বিষয়৷''
বইমেলা এলে আরেকটা বিষয় নিয়ে ধুন্দুমার আলোচনা হয়৷ জনপ্রিয় বা বাজারি লেখক৷ বিজ্ঞাপন দিয়ে এরা বইয়ের দুনিয়া শেষ করে দিচ্ছেন – এরকম অভিযোগ৷ অনেক ক্ষেত্রেই অভিযোগটা সত্য৷ বই বিক্রির জন্য কারো কারো নির্লজ্জ তৎপরতা লজ্জা পাওয়ার মতোই, কিন্তু আমি বরং অন্য আরেকটা ব্যাপার নিয়ে কৌতূহল বোধ করি৷ সারা বছর পত্র-পত্রিকা, ম্যাগাজিনে এক ধরণের লেখকদের লেখা ছাপা হয়৷ তাঁরা ভালো লেখক, প্রতিষ্ঠিত কবি-সাহিত্যিক৷ কিন্তু বইমেলার সময় তাঁদেরকে ছাপিয়ে বিক্রির তালিকায় উঠে যান আরেক দল লেখক৷ সস্তা-বাজার-বিজ্ঞাপন-অলেখক ইত্যাদি বলে যতই নাক সিঁটকান, একটু ভেবে দেখলে এটাও কি অবাক করার ব্যাপার নয় যে যাদের গল্প-কবিতা সারা বছর লোকে পত্রিকায় দেখে, তাদের প্রতি মানুষ আগ্রহ বোধ করে না?
সারা বছর যাদের লেখা পড়ে, কয়েক দিনের বিজ্ঞাপনের তোড়ে তাদের কথা ভুলে যাবে! আরও মজার ব্যাপার এই জনপ্রিয়দের বেশিরভাগই মানুষের মন জয় করেছেন অন্য কিছু লিখে৷ পত্রিকায় কলাম কিংবা রিপোর্ট৷ জাফর ইকবাল দেশে ফেরার পর তার জনপ্রিয়তা এক লাফে আকাশ ছুঁয়েছে, যেখানে তাঁর পত্রিকার কলামের বড় একটা অবদান৷ আনিসুল হক বা সুমন্ত আসলামরা পত্রিকায় স্যাটায়ার লিখে জনপ্রিয় হয়েছেন এবং পরে সেই জনপ্রিয়তাকে তাঁরা উপন্যাস বা বই লেখার দিকে টেনে এনেছেন৷ এর অর্থ কি এটাও দাঁড়ায় না যে, যারা গল্প-উপন্যাস সারা বছর লিখেন, তাঁদের লেখা ঠিক মানুষ পর্যন্ত পৌঁছায় না?
সস্তা-বাজার-বিজ্ঞাপন এই জিগিরের পাশাপাশি বেশিরভাগ মানুষের সঙ্গে মূল ধারার সাহিত্যিকদের এই যোগাযোগের ঘাটতিটা নিয়েও বোধহয় আমাদের ভাবা উচিত৷ সাহিত্য, গল্প, কবিতা তো মানুষের জন্য৷ মানুষ থেকে দূরে সরে গিয়ে মহৎ সৃষ্টি দিয়ে কী-ই বা লাভ!
আর তাই মনে হয়, বইমেলা, বই, সাহিত্য ইত্যাদি নিয়ে কেমন যেন একটা ধাঁধাঁর চক্রে আটকে আছি আমরা৷ চক্রটা ভাঙা দরকার৷
মোস্তফা মামুন, উপ-সম্পাদক, দৈনিক কালের কণ্ঠ
বন্ধু, মোস্তফা মামুনের এই লেখাটা কেমন লাগলো? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷