1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সুইস ব্যাংকের আমানতকারীরা কার ‘ভাশুর’?

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
১১ আগস্ট ২০২২

বাংলাদেশি নাগরিকদের সুইস ব্যাংকে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ নিয়ে ব্যাপক কথা হলেও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের তথ্য চাওয়া হয়নি।

https://p.dw.com/p/4FQFf
সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে অর্থ রাখা বাংলাদেশি নাগরিকদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য চাওয়া হয়েছিল কি না, বৃহস্পতিবার তা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট
সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে অর্থ রাখা বাংলাদেশি নাগরিকদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য চাওয়া হয়েছিল কি না, বৃহস্পতিবার তা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্টছবি: Reuters/R. Sprich

বাংলাদেশে নিযুক্ত সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নাথালি স্যুয়ার্ড এই তথ্য জানিয়েছেন।বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের জুনে সংসদে বলেছিলেন,“সুইস ব্যাংকে কে কত টাকা পাচার করেছেন, তার তালিকা হচ্ছে।”
আর বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বৃহস্পতিবার দাবি করেছে সুইস ব্যাংকের কাছে তথ্য চেয়ে যোগাযোগের রেকর্ড আছে বাংলাদেশ ব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছে। তারা তথ্যও দিয়েছে। কিন্তু সেই তথ্য আইনগত ব্যবস্থা নিতে ব্যবহার করা যায় না। এজন্য দুই দেশের সরকারের মধ্যে চুক্তি দরকার। সেই চুক্তি নেই।

সুইস রাষ্ট্রদূত বুধবার ঢাকায় সাংবাদিকদের এক অনুষ্ঠানে প্রশ্নের জবাবে বলেন,“সুইজারল্যান্ডের ব্যাংক থেকে তথ্য পেতে বাংলাদেশ সরকারকে কোন কোন চুক্তি বা সমঝোতা করতে হবে এবং তথ্য পাওয়ার জন্য কী করতে হবে সে বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারকে জানানো হয়েছে।” তিনি আরো বলেন,“সুইস ব্যাংক প্রতিবছর তাদের বার্ষিক তথ্য প্রকাশ করে থাকে, সেখানে বাংলাদেশিরা কত অর্থ জমা রাখে সেই পরিমাণও থাকে। কিন্তু সুইস ব্যাংকে জমা রাখা অর্থ অবৈধ উপায়ে বা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ কিনা তা আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব না। সুইস ব্যাংকের বিশ্বব্যাপী খ্যাতি আছে। সুইস ব্যাংক থেকে প্রতি বছর সুইজারল্যান্ডের জিডিপিতে ১০ শতাংশ যোগ হয়।”

সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের কত অর্থ?
২০২১ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের মোট অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ। যা বাংলাদেশি মূদ্রায় আট হাজার ২৭৬ কোটি টাকা( এক ফ্রাঁ= ৯৫ টাকা)। ২০২০ সালে এর পরিমাণ ছিলো ৫৬ কোটি ২৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ  বা পাঁচ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে  দুই হাজার ৯২৮ কোটি টাকা। এক বছরে এটা শতকরা ৫৫ ভাগ বেড়েছে। এটা এপর্যন্ত এক  বছরে সর্বোচ্চ। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) বার্ষিক প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।

বাংলাদেশে নিযুক্ত সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নাথালি স্যুয়ার্ড
বাংলাদেশে নিযুক্ত সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নাথালি স্যুয়ার্ডছবি: bdnews24.com

সুইস ব্যাংকে ২০০২ সালে বাংলাদেশিদের আমানত ছিলো মাত্র তিন কোটি ১০ লাখ ফ্রাঁ। দুই দশকে তা বেড়েছে প্রায় ৩০ গুণ।

সুইস ব্যাংকে কাদের টাকা জানার চেষ্টা আছে?
২০১৪ সালের ২৮ জুন জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “সুইস ব্যাংকে কে কত টাকা পাচার করেছেন, তার তালিকা হচ্ছে। দেশের টাকা আমরা দেশে ফিরিয়ে আনবোই। সরকার বিদেশে পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে। অতীতেও দেশের সম্পদ লুটপাট করে বিদেশে পাচার করা টাকা আমরা ফিরিয়ে এনেছি।”

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উদ্যোগটি নেই: মো. নুরুল আমিন

কিন্তু ২০১৭ সালের ১১ জুলাই তখনকার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের অর্থ পাচারের তথ্যে অতিশয়োক্তি রয়েছে বলে দাবি করে বলেন,“বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ডের মধ্যে ব্যাংকের মাধ্যমে যে লেনদেন হয়, তা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, বাস্তবে এটি মোটেই অর্থ পাচার নয়। সাংবাদিকেরা ‘অত্যন্ত অন্যায়ভাবে’ বিষয়টিকে প্রচার বলছেন। তবে কিছু অর্থ পাচার হয়। সেটি অতি যৎসামান্য। এটা নজরে নেওয়ার মতোই নয়।”

আর বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২১ সালের ৭ জুন সংসদে বলেন ‘‘কারা অর্থ পাচার করে, সেই তালিকা আমার কাছে নেই। নামগুলো যদি আপনারা জানেন, আমাদের দিন।’’ সর্বশেষ গত ১০ জুন বাজেট পেশ পরবর্তী  সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য বিদায়ী গভর্নর ফজলে কবির বলেন, ‘‘বাংলাদেশ থেকে কেউ অর্থ পাচার করে সুইস ব্যাংকে টাকা জমা করেছে, এমন কোনো তথ্য আমরা পাইনি।’’
অবশ্য বাংলাদেশে এরশাদ সরকারের পতনের পর সুইস ব্যাংকে তার টাকা ফেরত আনার একটি উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো।  এই কাজে ফায়ার ফক্স নামে  একটি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্বও দেয়া হয়। কিন্তু সেই টাকা ফেরতের কোনো খবর আর পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে সিংগাপুর থেকে টাকা ফেরত আনার উদাহরণ আছে।

টাকা ফেরত আনা সম্ভব?
২০১৪ সাল থেকে  কোন দেশের নাগরিকদের কত অর্থ আছে সুইস ব্যাংকে আছে তার পরিমাণ প্রকাশ করছে। ২০১৪ সালে  কমন রিপোর্টিং ষ্ট্যান্ডার্ড (সিআরএস) গড়ে তোলে ১০০টি দেশ। যার আওতায় সদস্য দেশগুলো তার নাগরিকদের সব তথ্য সুইস ব্যাংক থেকে পায়। আর অটোমেটিক এক্সচেঞ্জ অব ইনফরমেশন (এইওআই) নামে ব্যবস্থা থেকে তথ্য পাওয়ার আরেকটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয় ২০১৭ সাল থেকে। এই কাঠামোর আওতায় নিজ দেশে কর ফাঁকি দিয়ে সুইস ব্যাংকে অর্থ জমা রাখলে তার তথ্য দিতে বাধ্য থাকে সুইস ব্যাংকগুলো। এই কাঠামোতে ১২১ দেশ থাকলে বাংলাদেশ নেই। ২০১৭ সাল থেকে তারা তথ্য দিচ্ছে। ভারত, পাকিস্তান ও এমনকি মালদ্বীপও ওই প্রক্রিয়ায় স্বাক্ষর করলেও বাংলাদেশ করেনি।

সুইস ব্যাংক ২০২১ সালে ৯৬টি দেশের ৩৩ লাখ গ্রাহকের তালিকা সংশ্লিষ্ট দেশকে দিয়েছে। তারমধ্যে ভারতও আছে। ২০২০ সালে ৮৬টি দেশের ২১ লাখ এবং ২০১৯ সালে ৭৫টি দেশকে তালিকা দেয়।  কিন্তু বাংলাদেশ কখনো  তালিকা পায়নি।

বাংলাদেশ ২০১৪ সালে একটি উদ্যোগ নেয়। ওই বছর বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) সুইজারল্যান্ডের ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে সমঝোতা চুক্তি করার জন্য চিঠি দেয়। আর ২০১৩ সালে বিএফআইইউ এডমন্ট গ্রুপের সদস্যপদ পায়। এগমন্ট গ্রুপ হলো সব দেশের ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটগুলোর একটি জোট। এই ফোরাম অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন নিয়ে কাজ করে।

বিএফআইইউ-এর সাবেক প্রধান আবু হেনা রাজি হাসান জানান,“সুইস ব্যাংকের সাথে বিএফআইইউ যোগাযোগ রাখে। তারা কিছু তথ্যও দেয়। তবে সেটা গোপন রাখতে হয়। আইনগতভাবে ব্যবহার করতে হলে তাদের অনুমতি লাগে। ক্রিমিনাল ম্যাটার হলে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসট্যান্স-এর আওতায় করা করা যায়।”

তবে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তথ্য পেতে হলে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি থাকতে হয়।  সেই চুক্তি বাংলাদেশের সাথে নেই বলে জানান তিনি।
যমুনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্যাংকার মো. নুরুল আমিন  বলেন,“বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উদ্যোগটি নেই। আর অটোমেটিক এক্সচেঞ্জ অব ইনফরমেশনের আওতায় ১২১টি দেশ তথ্য পায়। আমরা কেন পাই না? এর কারণ আমরা তার সাথে যুক্ত নই। আমরা যুক্ত হলে পোতাম। এটা একটা অ্যাপের মাধ্যমে কাজ করে। অটোমেটিক তথ্য পাওয়া যায়। ভারত তো পাচ্ছে।”

তার কথা,“আসলে আমরা চাই না পাচার হওয়া অর্থের খোঁজ জানতে। তাই পাইনা। এর জন্য অনেক দেশ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চুক্তি করেছে, আমরা করিনি।”

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানও মনে করেন শুধু সুইস ব্যাংক কেন বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার জন্য আইনি উদ্যোগ তেমন নেই। তার কথা,“কমন রিপোর্টিং ষ্ট্যান্ডার্ড (সিআরএস)  চুক্তিতে বাংলাদেশ সই করলে এই তথ্য পাওয়া সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশ তা করছে না। এটা সই করলে বাংলাদেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাতে সংস্কার করতে হবে। এখানে যে ব্যাপক কর ফাঁকি দেয়া হয় তা বন্ধ হবে। এটা দেশের জন্য মঙ্গল।”

এদিকে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে অর্থ রাখা বাংলাদেশি নাগরিকদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য চাওয়া হয়েছিল কি না, বৃহস্পতিবার তা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট।  
বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ তথ্য জানতে চেয়ে রুল দেন। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদকের আইনজীবীকে আগামী রোববার জানাতে বলা হয়েছে।