সীমান্তে ল্যান্ডমাইন আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ
৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭বাংলাদেশের দু'টি সরকারি সূত্রের বরাত দিয়ে আল জাজিরা জানিয়েছে, মিয়ানমার বাংলাদেশ সংলগ্ন সীমান্তে ল্যান্ডমাইন পুঁতে রাখছে৷ সূত্র দু'টি জানিয়েছে, যেসব রোহিঙ্গা মুসলিম পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে তারা যেন আবার মিয়ানমারে ফিরে যেতে না পারে, সেজন্যই হয়তো মাইনগুলো পুঁতে রাখা হচ্ছে৷
সীমান্তের কাছে মাইন পুঁতে রাখার ঘটনায় বুধবার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ৷ মিয়ানমারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্টদূত অং মিন্টকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে এই প্রতিবাদ জানানো হয়৷ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অনুবিভাগের মহাপরিচালক মঞ্জুরুল করীম তাঁকে তলব করেন এবং এই ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ জানান৷ পাশাপাশি বাংলাদেশে অপ্রত্যাশিতভাবে অত্যধিক রোহিঙ্গা প্রবেশ করায় তাকে একটি অনানুষ্ঠানিক পত্র হস্তান্তর করা হয়৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহেদুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সীমান্তে ল্যান্ডমাইন পুঁতে রাখা আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ৷ কারণ, এখন তো কোনো যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে না৷ আসলে মিয়ানমার আন্তর্জাতিক আইন বা যুদ্ধকালীন আইন কোনোটারই তোয়াক্কা করছে না৷ তারা তাদের ইচ্ছেমতো কাজ করছে৷ আমাদের পররাষ্ট্র দফতরের উচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগ আকর্ষণ করা৷ যদিও তারা উত্তর কোরিয়া নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে৷ ভারত ও চীনের কাছ থেকে এ ব্যাপারে আমরা কোনো সহযোগিতা পাবো না৷ আমি শুনেছি, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী প্রধান যুদ্ধাপরাধী৷ অতীতেও তিনি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অভিযান চালিয়েছেন৷ ইউরোপের কয়েক জায়গায় বক্তৃতা দিয়ে তিনি বলেছেন, বাঙালি নিধন এখন তার অন্যতম উদ্দেশ্য৷ এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কার্যকরভাবে পদক্ষেপ নেয়া উচিত৷’’
রয়টার্সের এক রিপোর্টেও ল্যান্ডমাইন পুঁতে রাখার কথা উল্লেখ করা হয়েছে৷ রয়টার্সের কাছে এসব তথ্য জানালেও সংবেদনশীলতার কারণে নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করেননি তথ্যদাতারা৷ মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে দ্বিতীয়বারের মতো অভিযান শুরু করার পর থেকে এখন পর্যন্ত ৪শ' রোহিঙ্গা মুসলিম নিহত হয়েছে৷ এছাড়া প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে৷ একটি সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছে, সীমান্তের পিলারের মাঝখানে কাঁটাতারের বেড়ায় নিজেদের এলাকায় ল্যান্ডমাইন পুঁতে রেখেছে মিয়ানমার৷ মূলত বিভিন্ন প্রমাণ এবং গুপ্তচরদের কাছ থেকেই মাইন পুঁতে রাখার খবর তারা পেয়েছে৷ মনজুরুল হাসান খান নামে এক বাংলাদেশি সীমান্তরক্ষী রয়টার্সকে বলেছেন, মঙ্গলবার মিয়ানমারের কাছ থেকে দু'টি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে৷ সোমবারও দু'টি বিস্ফোরণ হয়েছে৷ তবে সীমান্তে বিস্ফোরণের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি মিয়ানমারের সেনাবাহিনী৷ এগুলো মাইনের বিস্ফোরণ বলে ধারণা করা হচ্ছে৷’’
এর আগেও মিয়ানমার সীমান্তে জিরো লাইনের আশেপাশে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর পুঁতে রাখা মাইনের কারণে বিজিবি সেখানে যেতে পারতো না৷ পুঁতে রাখা এসব মাইন ও ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) বিস্ফোরণে নিহত ও আহতের ঘটনা পরিহার করতে মিয়ানমার পুলিশ ফোর্স (এমপিএফ) ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-র মধ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে উভয় পক্ষ সম্মত হয়৷ গত এপ্রিলে ঢাকায় অনুষ্ঠিত অতিরিক্ত মহাপরিচালক (বিজিবি) ও এমপিএফ-এর মধ্যে ৫ দিনব্যাপী সীমান্ত সম্মেলন শেষে এক যৌথ ব্রিফিংয়ে বিজিবির অতিরিক্ত মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আনিসুর রহমান এ কথা জানিয়েছিলেন৷
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সীমান্তে ল্যান্ড মাইন পুঁতে রাখা আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ৷ এখন তো তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো যুদ্ধ চলছে না৷ তাহলে তারা কেন মাইন পুঁতে রাখবে? এর জন্য বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী প্রতিবাদ জানানো উচিত৷’’ বাংলাদেশ যে প্রতিবাদ করছে সেটা আরো জোরালো হওয়া উচিত কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূতকে ডেকে প্রতিবাদ করছে৷ পাশাপাশি তাঁর হাতে একটি চিঠিও ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে৷ এটাই তো হওয়া উচিত৷ এর বাইরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বিষয়টি উপস্থাপন করে তাদের উপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে৷’’
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘকে ড. ইউনূসের খোলা চিঠি
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের সমস্যা নিরসনে জরুরি হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের কাছে খোলা চিঠি লিখেছেন ড.মুহাম্মদ ইউনূস৷ মঙ্গলবার ইউনূস সেন্টার থেকে গণমাধ্যমের কাছে এই চিঠি পাঠানো হয়৷ নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি ও সদস্যদের উদ্দেশে চিঠিতে বলা হয়, মিয়ানমারের রাখাইন এলাকায় মানবিক ট্রাজেডি ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে৷ এ ব্যাপারে অবিলম্বে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন৷
বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যের বরাত দিয়ে চিঠিতে বলা হয়, রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর আক্রমণে শত শত রোহিঙ্গা জনগণ নিহত হচ্ছে৷ লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে৷ বহু গ্রাম সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, নারীরা ধর্ষিত হচ্ছে, বেসামরিক মানুষকে নির্বিচারে আটক করা হচ্ছে এবং শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে৷ আতঙ্কের বিষয়, মানবিক সাহায্য সংস্থাগুলোকে ওই এলাকায় প্রায় একেবারেই প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না৷ যার ফলে দারিদ্র্যপীড়িত ওই এলাকায় মানবিক সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করছে৷ চিঠিতে আরো বলা হয়, গত ১২ দিনে এক লাখ বিশ হাজারেরও বেশি মানুষ বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে৷ মৃত্যুর মুখে নারী, পুরুষ ও শিশুদের এই ব্যাপক বাস্তুচ্যুতি ও অভিবাসন থেকে সৃষ্ট পরিস্থিতি প্রতিদিন আরো খারাপ হচ্ছে৷
ড. মুহাম্মদ ইউনূস চিঠিতে জাতিসংঘের উদ্দেশে বলেন, ‘‘গত বছরের শেষে পরিস্থিতির বেশ অবনতি ঘটলে বেশ কয়েকজন নোবেল লরিয়েট ও বিশ্বের বিশিষ্ট নাগরিকসহ আমি এ বিষয়ে জরুরি হস্তেক্ষেপের আহ্বান জানিয়ে আপনাদের নিকট যৌথভাবে অনুরোধ জানিয়েছিলাম৷ আপনাদের হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও পরিস্থিতির কোনও উন্নতি হয়নি৷ এবার পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতির প্রেক্ষিতে নিরীহ নাগরিকদের ওপর অত্যাচার বন্ধ এবং রাখাইন এলাকায় স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আমি আপনাদের নিকট আবারও অনুরোধ জানাচ্ছি৷’’
প্রিয় পাঠক, আপনি কিছু বলতে চাইলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে...