‘সীমান্ত দিয়ে গরু আসায় প্রান্তিক কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন’
১৬ জুন ২০২৪ডয়চে ভেলে: মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী বলেছেন, কোরবানিতে চাহিদার চেয়ে বেশি পশু আছে। তারপরও কোরবানির সময় গরুর দাম কেন বেড়ে যায়, আবার হঠাৎ করে কমেও যায়?
মো. ইমরান হোসেন: আমাদের কাছে আসলে সঠিক তথ্য নাই৷ ২০১৯ সালে কোরবানি হয়েছে এক কোটি ১৫ লাখ গবাদি পশু৷ ২০২০ সালে হয়েছে ৮৯ লাখ, ২০২১ সালে ৯৫ লাখ, ২০২২ সালে ৯৯ লাখ আর ২০২৩ সালে হয়েছে এক কোটি ৩৯ হাজার ৷ কত কোরবানি হবে এটা কখনোই নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়৷ মন্ত্রী যে সংখ্যা বলেছেন সেটাও অনুমাননির্ভর, সে কারণেই দামের ব্যাপারটা ওরকম হয়৷
তাহলে হিসাবটা করে কীভাবে?
আগের বছরের তুলনায় ছয়-সাত শতাংশ বাড়বে- সেইভাবে হিসাব করে বলা হয়৷ এবার সার্বিক পরিস্থিতি ভালো আছে৷ সামনে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন৷ রাজনৈতিক অবস্থাও ভালো আছে৷ তাই ওনারা ভাবছেন এবার গতবারের তুলনায় সাত-আট শতাংশ বাড়তে পারে৷
দেশে তো মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাচ্ছে৷ তাহলে আগে যারা কোরবানি দিয়েছেন তাদের সবাই কি এবারও দিতে পারবেন?
মনে হয় পারবেন, কারণ, আমরা গত বছরের চেয়ে গরুর দাম কমিয়ে দিয়েছি৷ আমরা ৪০০ কেজি ওজনের গরু লাইভ ওজনে গত বছর ৫২৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছি৷ এবার সেটা ৫০০ টাকা কেজি৷ আমরাই লাইভ ওজনে প্রথম গরু বিক্রি শুরু করি৷
ভারতীয় গরু বন্ধ হওয়ার পর এই কোরবানিকেন্দ্রিক বা সারা বছরের গরুর ব্যবসা, লালন পালনে কত মানুষ যুক্ত হয়েছেন?
বাংলাদেদেশ ব্যাংকের হিসাবে এই কোরবানির ঈদের সময়ই সবচেয়ে বেশি ৭৫ হাজার কোটি টাকার ট্রানজেকশন হয়৷ এর মধ্যে গরু, ছাগল বেচাকেনায় ৬০ হাজার কোটি টাকা৷ এছাড়া লাইভস্টক হচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি৷ যার বাড়িতে ১০টির বেশি গরু আছে, তাদের আমরা অর্গ্যানাইজড ফার্মার বলি৷ এরকম আছে সাড়ে তিন লাখ৷ অর্গ্যানাইজড ডেইরি ফার্মার আছে আরো সাড়ে তিন লাখ৷ প্রান্তিক ফার্মার, যাদের দুই-পাঁটচা গরু আছে, এরকম আছে ১১ লাখ৷ মোট ১৮ লাখ খামার, যার সাথে সরাসরি এক কোটি লোক জড়িত৷
মহিষ, উট ও দুম্বার চাহিদা কেমন ?
১০ বছর আগে ঢাকায় একটা-দুইটা দুম্বা কোরবানিতে বিক্রি হতো৷ এখন কমপক্ষে দেড়শ'-দুইশ' দুম্বা বিক্রি হয়৷ আগে উট বিক্রি হতো একটা-দুইটা, এখন ২০-২৫টা বিক্রি হয়৷ আগে কেউ মহিষ কোরবানি দিতে চাইতো না, নাক সিঁটকাতো, এখন কিন্তু অনেকে শখ করেও মহিষ কোরবানি দেয়৷ আরেকটি আছে ভুট্টি গরু৷ ছোট আকারের বামন গরু৷ এর চাহিদাও বাড়ছে৷
কোন ধরনের গরুর চাহিদা বেশি?
চাহিদা সবচেয়ে বেশি আমাদের প্রান্তিক কৃষকরা যে গরুটা উৎপাদন করে, সেটার৷ প্রতি বছর দেশে এক কোটি গরুর চাহিদা আছে৷ এর মধ্যে ৯০ শতাংশ গরুই প্রান্তিক কৃষকদের৷ এক লাখ থেকে এক লাখ ২০ হাজার টাকা এগুলোর দাম৷ এগুলো দেশীয় নানা জাতের গরু৷
বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় জাতের গরু কোনগুলো?
আমরা ঢালাওভাবে বলি শাহীওয়াল৷ তবে এরমধ্যেও নানা জাত আছে৷ এগুলো দেশীয় জাত৷
অ্যামেরিকার ব্রাহামা জাতের বড় আকারের গরু কবে থেকে বাংলাদেশে আসছে?
২০১৪ সালে সরকারই ব্রাহামা জাতের গরুর জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেয়৷ মোদী সরকার ওই বছর বাংলাদেশে ভারতীয় গরু বন্ধ করে দেয়ার পর গরুর মাংসের দাম বেড়ে যায়৷ তখন ওই প্রকল্প শুরু করা হয়৷ উদ্দেশ্য ছিল যে গরুতে অনেক মাংস পাওয়া যায় সেই গরু বাড়ানো, যাতে কম দামে গরুর মাংস পাওয়া যায়৷ সাতটি প্রজেক্টের পর এটা বন্ধ হয়ে যায়৷ বাংলাদেশে কম দামে গরুর মাংসের চাহিদা মেটাতে হলে এই ধরনের গরু লাগবে৷ সরকার যখন ব্রাজিল থেকে কম দামে গরুর মাংস আমদানির কথা বলেছে, আমরা তখন বাংলাদেশে ওই জাতের গরুর লালন -পালন করা কথা বলছি৷
আপনারা কি এখন ব্রাহামা, ফ্রিজিয়ানা গরু আমদানি করেন, নাকি সিমেন্ট আনেন?
এখন আর বাইরে থেকে গরু আমদানি হয় না৷ এটা খুব নিয়ন্ত্রিত৷ আগের গরু আছে৷ এখানে ব্রিডিং হয়৷ সিমেন্ট আছে৷ তবে এবার ভারতীয় গরু আসছে৷
এবার ভারতীয় গরু আসছে?
অলরেডি ভারতের সাথে বর্ডার খুলে দেয়া হয়েছে৷ সেখান থেকে গরু আসছে৷ আবার মিয়ানমার থেকেও আসছে৷ লাখ লাখ গরু আসছে৷ গত চার-পাঁচ বছরে এত পরিমাণ গরু আসেনি৷ এতে আমাদের প্রান্তিক কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন৷ তাদের গরু অবিক্রিত থাকবে৷ আবার ভারতীয় গরুর নানা রোগবালাই নিয়ে আসবে৷
আপনি ‘সাদিক অ্যাগ্রো' কবে থেকে শুরু করেন এবং এত বড় আকারে করার অনুপ্রেরণা কোথায় পেলেন?
২০০৮ সালে আমরা দুই বন্ধু মিলে এটা শুরু করি, কারণ, তখন ভেজাল দুধ, গরু কৃত্রিম উপায়ে মোটা তাজাকরন এগুলো আলোচনায় ছিল৷ আমাদের উদ্দেশ্য ছিল আমাদের বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনকে নিরাপদ দুধ ও মাংস সরবরাহ করা৷ এরপর এটা আস্তে আস্তে বড় হয়ে যায়৷ আমরা এই সেক্টরে আরো ট্রেন্ড সেট করেছি৷ এখন আমি ডেইরি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি৷ এই কারণে আমাদের মিডিয়া ফোকাস বেশি৷ তবে আমাদের চেয়েও বড় ফার্ম কিন্তু বাংলাদেশে আছে৷
আপনার খামারে শুধুই গরু, নাকি অন্য গবাদি পশুও আছে?
কোরবানি-যোগ্য যত ধরনের গবাদি পশু আপনি চিন্তা করতে পারেন, আমাদের এখানে সব আছে৷ এখানে ২০-২৫ প্রজাতির দুই হাজার ১০০ গরু আছে, পাঁচ প্রজাতির মহিষ আছে, চার প্রজাতির ৫৫টি দুম্বা আছে, ১০ প্রজাতির এক হাজার ২০০ ছাগল আছে, উট আছে ১৪টি ৷ ৩৪০টি দুধের গাই আছে৷ অমরা প্রতিদিন দুই হাজার ৮০০ কেজি দুধ উৎপাদন করি৷
অভিযোগ আছে নানা উপায়ে আপনি গরুর দাম বেশি নেন, আপনি গরুর দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন...
গত পঁচ-সাত বছরে কোরবানিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গরুটা আমার খামার থেকেই বিক্রি হয়৷ আমাদের একটা রেপুটেশন আছে৷ এখানে আসতে অনেকেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন৷ এটা হচ্ছে আমার কষ্টের ফল৷ এক কোটি টাকার গরু কিন্তু আমার কাছে একটাই আছে৷ কিন্তু এক লাখ, দেড় লাখ টাকার গরু আছে কমপক্ষে ৫০০-৬০০৷ সবাই যাতে কিনতে পারে, সেই গরুই আমার কাছে বেশি৷ আমার কাছে ১৫ লাখ টাকার খাশি একটাই৷ কিন্তু আমার কাছে ১৫ হাজার টাকা দামের খাশি আছে এক হাজার৷
আপনারা কি বাজারে বিক্রি করেন?
না, আমরা বাজারে কোনো পশু বিক্রি করি না৷ আমাদের খামার থেকে বিক্রি করি৷
উট নিয়েও কথা উঠেছে৷ উটের দাম আপনি যত নেন, তা অনেক বেশি...
আসলে সৌদি আরব, ভারতে উটের দাম কম৷ ভারতে একটি উটের দাম এক লাখ রুপি৷ বাংলাদেশ সরকার উট আমদানির অনুমতি দেয় না৷ এগুলো ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আসে৷ বর্ডার থেকে চোরাই পথে আমাদের এখানে আসে৷ ফলে দাম অনেক বেশি পড়ে যায়৷ আমি ৪০টি উট কিনেছি৷ এর মধ্যে পাঁচটি উট মারা গেছে৷ ফলে দাম বেশি পড়ে৷
আমাদের এখানে উট, দুম্বা ব্রিডিং হয় না?
না, উট হয় না৷ বাইরে থেকে আসে৷ তবে দুম্বার ব্রিডিং হয়৷ এখানে দুম্বার অনেক খামার হয়েছে৷ ভারত থেকে আর দুম্বা আনতে হয় না৷
ভেড়ার চাহিদা কেমন?
ভেড়ার চাহিদা দিন দিন বাড়ছে৷ এটা পালনের খরচও কম৷ তবে এটা ঠিকমতো পালন করা জানতে হবে৷ ভেড়ার বাংলাদেশে অনেক বড় সম্ভাবনা আছে৷
এবার এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ কত দামে গরু বিক্রি করেছেন?
এবার একজন তিন কোটি ২০ লাখ টাকায় চারটি গরু কিনেছেন৷ তার মধ্যে আমি যে গরুটির দাম এক কোটি টাকা চেয়েছিলাম, সেটাও আছে৷ আলাদাভাবে ধরলে ওই গরুটি ৯০ লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে৷ ১৫ লাখ টাকায় একটি খাশি বিক্রি করেছি৷
আপনি বংশমর্যাদাসম্পন্ন গরুর কথা বলছেন৷ তার দামও বেশি নিচ্ছেন৷ আসলে বিষয়টি কী?
বংশ মর্যাদার বিষয় হলো ওই গরুগুলোর ১১০ বছরের পূর্ব পুরুষের ইতিহাস আছে৷ তার কোথায় জন্ম, কত সালে জন্ম, বাবা কে ছিল, তার বাবা কে ছিল- এই ভাবে৷ গরুর গায়ে স্থায়ী একটা নাম্বার আছে৷ সেটা দিয়ে গুগলে সার্চ দিলেই বংশ পরিচয়সহ সব তথ্য জানা যাবে৷ এর মাংস আলাদা, কোয়ালিটি আলাদা৷ তাই দামও বেশি৷ একই টয়োটা গাড়ির বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দাম বিভিন্ন রকম, মানও আলাদা৷ বিষয়টি সেরকম৷
আপনার কি কখনো মনে হয় কোরবানিতে একটা প্রদর্শনের বিষয় চলে এসেছে৷ কত দামে কত বড় গরু কিনলাম- সেটা দেখানো৷
আসলে এক কোটি টাকায় একটি গরু কিনে তার গলায় ছুরি চালানোও কিন্তু একটা বিশাল আত্মার বিষয়৷ আমরা আশা করি আল্লাহ যেন সবার কোরবানি কবুল করেন৷ যে এক কোটি টাকায় গরু কেনে, সে ৪০ কোটি টাকার গাড়িতেও চড়ে৷ তার কাছে এক কোটি টাকা কোনো বড় টাকা নয়৷ অনেকের কাছে এক লাখ টাকা অনেক টাকা, আবার কারো কারো কাছে এক কোটি টাকা কোনো ‘বড়' টাকা নয়৷
গরুর দাম বেড়ে যাওয়ার পিছনে পথে পথে চাঁদাবাজি একটি কারণ কিনা...
পথে চাঁদাবাজি হয়৷ তবে সেটার চেয়ে আসলে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হলো হাটের খাজনা৷ আমার যশোর , কুষ্টিয়া , চুয়াডাঙ্গা, যশোর, রাজশাহীতে খামার আছে৷ গত কয়েকদিনে সেখান খেকে ২০-২৫ ট্রাক গরু এনেছি৷ প্রতি ট্রাকে ১৫-২০টা গরু থাকে৷ পথে চাঁদা দিতে হয়েছে ট্রাক প্রতি গড়ে এক হাজার ২০০ টাকা৷ একটি গরুতে পড়েছে সর্বোচ্চ ১০০ টাকা৷ কিন্তু গ্রামের যে গরুটি হাট থেকে বেপারিরা কেনেন, সেই হাটে বড় অংকের একটা খাজনা (হাসিল) দিতে হয়৷ সেই গরু আবার যখন ঢাকার হাটে বিক্রি হয়, তখন আবার খাজনা দিতে হয়৷ একটা গরুতে দুই বার খাজনা দিলে ৮-৯ হাজার টাকা চলে যায়৷ কোথায় ১০০ টাকা আর কোথায় ৮-৯ হাজার টাকা৷