‘অনুসন্ধান’ শব্দটি ভুলে যাবেন না প্লিজ
৯ নভেম্বর ২০১৬আগে ব্যাপারটি সেভাবে লক্ষ্য করিনি৷ যদিও ছবিটি আজ যেখানে আছে সেখানেই আছে বেশ অনেকদিন ধরে৷ আজ যখন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা নিয়ে লিখতে বসেছি তখনই মনে হলো যে, তাঁরা আমার দিকে তাকিয়ে আছেন৷
অনেক পাঠক হয়ত ধরতে পেরেছেন আমি সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির কথা বলছি৷ ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তাঁরা ঢাকার বাসায় খুন হন৷ সাগর ভাই একসময় ডয়চে ভেলেতে কাজ করতেন৷ তাই তাঁদের ছবি এখনও বাংলা বিভাগের রুমে রাখা আছে৷ সঙ্গে আছে শোক প্রকাশের বই৷ দেখতে দেখতে সাড়ে চার বছরের বেশি হয়ে গেলেও কেন আর কারা তাঁদের হত্যা করলো তা জানা যায়নি৷ পরিচিতজনরা প্রায়ই এ বিষয়ে জানতে চান৷ সাংবাদিক হিসেবে সত্য-মিথ্যা যেরকম খবর পাই তা তাঁদের জানাই৷ তবে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারিনা৷ তেমনি একবার শুনলাম একজন সাংবাদিক এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করতে গিয়ে অনেক দূর এগিয়েছিলেন৷ কিন্তু পরিবারের সদস্যদের ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার হুমকি পেয়ে নিরূপায় হয়ে অনুসন্ধান থেকে ফিরে আসেন তিনি৷
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচিত না হলেও শ্রেষ্ঠ অনুসন্ধানী রিপোর্টিংয়ের জন্য ২০১৪ সালে তিনজন সাংবাদিক ‘সাগর-রুনি স্মৃতিপদক' পান৷ ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) আর গ্রামীণফোন যৌথভাবে এই পদক দিয়েছে৷ খেয়াল করুন, সাংবাদিক সংগঠন ডিআরইউ-র সঙ্গে আছে শীর্ষস্থানীয় মোবাইল অপারেটর গ্রামীনফোন, যাদের সহ অন্য তিন মোবাইল অপারেটরের বিরুদ্ধে সম্প্রতি সরকার রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ এনেছে৷ এছাড়া ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম গত বছর মোবাইল কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ থাকার কথা বলেছিলেন৷ বিশেষ করে গ্রামীণফোনের ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো' আচরণ, প্যাকেজ অফার দিয়ে অতিরিক্ত টাকা কেটে নেওয়া, কাস্টমার কেয়ার সেন্টারে সেবা নিতে দুর্ভোগ, ইন্টারনেট ধীরগতিসহ গ্রাহকের বিভিন্ন অভিযোগ একে একে প্রোজেক্টরে দেখিয়ে পড়ে শুনিয়েছিলেন টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী৷ এ থেকে বোঝা যায়, এসব কোম্পানি নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করার অনেক সুযোগ রয়েছে৷ কিন্তু সেরকমটি দেখা যায় না৷ এমনকি চারটি ফোনের বিরুদ্ধে রাজস্ব ফাঁকির যে সরকারি অভিযোগ সেই খবরটি প্রকাশে গড়িমসি করেছে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো৷
ফিরে যাই সাগর-রুনি দম্পতির কথায়৷ তাঁরা দু'জনই নিজেদের সহকর্মী হওয়ায় সাংবাদিকরা অন্তত তাঁদের হত্যা রহস্য উন্মোচন করতে চেয়েছিলেন৷ কিন্তু সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের মতোই আলোচিত তনু হত্যাকাণ্ডের রহস্যের সমাধানে কোনো অনুসন্ধান চোখে পড়ছে না৷ চলতি বছরের মার্চে কুমিল্লা সেনানিবাসে তাঁকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়৷ সেনানিবাস এলাকায় ঘটনাটি ঘটার কারণে শুরুতে অনেক তথ্য ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে৷ এখনও তা চলছে৷
জুলাইতে হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার কিছু বিষয় নিয়ে সৃষ্ট ধোঁয়াশা দূর করার উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না৷ যেমন ৩ আগস্ট তাহমিদ হাসিব খানকে গ্রেপ্তার দেখানোর প্রায় দুই মাস পর গতমাসের শুরুতে অভিযোগ থেকে মুক্তি দেয়া হয়৷ একইসঙ্গে আটক দেখানো হাসনাত করিমকে এখনও কারাগারে আটক রাখা হয়েছে৷ যদিও তাঁর বিরুদ্ধে এখনও অভিযোগ দায়ের করা হয়নি৷ সামাজিক মাধ্যমে অস্ত্র হাতে তাহমিদের ছবি প্রকাশিত হয়েছে৷ ভিডিওতে হাসনাত করিমকে জঙ্গিদের সঙ্গে দেখা গেছে৷ যদিও এসবে তাঁরা অপরাধী প্রমাণিত হন না তবুও তাহমিদকে কেন ছেড়ে দেয়া হলো, আর হাসনাতকে এতদিন ধরে অভিযোগ গঠন ছাড়াই আটকে রাখা হচ্ছে, এই বিষয়গুলো জানতে চান পাঠক ও দর্শক৷ কিন্তু এক্ষেত্রে শুধু পুলিশ পরিবেশিত সংবাদ প্রকাশ আর প্রচার হতে দেখছি আমরা৷ অথচ অনুসন্ধানের মাধ্যমে সত্য বিষয়টি উপস্থাপন করতে পারেন সাংবাদিকরা৷
এভাবে একে একে অনেক ঘটনার কথা বলা যাবে যেগুলো নিয়ে অনুসন্ধান হওয়া উচিত ছিল৷ পুলিশের সাবেক এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী হত্যার পর তাঁকেই একরকম জোর করে চাকরি থেকে সরিয়ে দেয়ার পেছনে কাঁরা ছিলেন, লিমনকে ভয়ংকর ‘সন্ত্রাসী' বানানোর পেছনে কাঁরা আছেন, দিনের পর দিন ক্রসফায়ারের সাজানো গল্পের পেছনে কাঁরা – এ সব যদি সাংবাদিকরা খুঁজে বের না করেন তাহলে নাগরিকরা কোনোদিনও সেসব জানতে পারবেন না৷ অথচ রাষ্ট্রের ‘চতুর্থ স্তম্ভ' হিসেবে পরিচিত গণমাধ্যম তথা সাংবাদিকদের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে এ সব কাজ৷ তাই সাংবাদিক ভাইদের কাছে অনুরোধ, বছরে একটি করে হলেও অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন করবেন আপনারা৷ যে যে বিটে (যেমন ক্রাইম, টেলিকম, খেলাধুলা, সংস্কৃতি ইত্যাদি) কাজ করেন সে বিষয়েই যদি সবাই প্রতিবছর অন্তত একটি করে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন জমা দেন তাহলেই দেশের অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে৷ আর আপনারাও আপনাদের কাজ ঠিকমতো পালন করতে পারায় আনন্দ অনুভব করবেন৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷