1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সরকারের আছে জাদুকাঠি, মধ্যবিত্তের শুধু আশা

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি গৌতম হোড়৷
গৌতম হোড়
২৫ মার্চ ২০২২

আশঙ্কা সত্যি হলো৷ পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন শেষ হওয়ার পরে পেট্রোল-ডিজেল ও রান্নার গ্যাসের দাম বাড়লো৷ ফলে বাকি সব জিনিসের দামও বাড়ছে৷

https://p.dw.com/p/491aF
Kalkutta Indien Lockdown
কলকাতার একটি বাজার (ফাইল ছবি)ছবি: DW/S. Bandopadhyay

রুবিক কিউব অনেকেই মিলিয়ে ফেলতে পারেন, যত কঠিন ধাঁধা বা গুগলি হোক না কেন, তার জবাবও অনেকে ঠিক পেয়ে যান৷ কিন্তু ভারতে একটা ধাঁধার জবাব কিছুতেই পাওয়া যায় না৷ সেটা হলো, লোকসভা বা বিধানসভা ভোট এসে গেলে পেট্রোল-ডিজেল, রান্নার গ্যাসের দাম বাড়ে না কেন? আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম অনেকটা বেড়ে গেলেও বাড়ে না৷ অথচ, কেন্দ্রীয় সরকার বারবার জানিয়েছে, পেট্রোল-ডিজেলের দাম এখন বাজার নিয়ন্ত্রণ করে৷ অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে দেশেও বাড়বে, বাড়বেই, সেখানে সরকারের কিছুই করার নেই৷ আবার আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দাম কমলে দেশে দাম কমবে না, কারণ, সরকার তখন বাড়তি শুল্ক বসিয়ে রোজগারের পথ খুলে রাখবে৷ কিন্তু ভোট এলে কি বাজার পেট্রোল-ডিজেলের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে ভুলে যায়?

এই ধাঁধার জবাব পাওয়া অসম্ভব৷ তবে সরকার এবং পুলিশের পক্ষে অসম্ভব বলে কিছু নেই৷ পুলিশ চাইলে যে কোনো অপরাধীকে খুঁজে বের করতে পারে৷ বইমেলার লাখো মানুষের ভিড় থেকে কর্তাদের বাড়ির চাবি খুঁজে আনতে পারে, যত জটিলই হোক না কেন, চাইলে সব মামলার ফয়সালা করতে পারে, কোন অপরাধী কোথায় লুকিয়ে তা-ও জেনে যেতে পারে৷ তেমনই সরকারের কাছেও জাদুদণ্ড আছে৷ তাই খোলাবাজার তেলের দাম নিয়ন্ত্রণ করলেও সরকারি জাদুদণ্ডের ছোঁয়ায় তা কখনো কখনো নিয়ন্ত্রণ করতে ভুলে যায়৷ ফলে ভোট এলে দাম বাড়ে না৷ আবার যখন রাজনৈতিক প্রয়োজন মিটে যায়, তখন আবার পেট্রোল-ডিজেল-সিএনজি-র দাম বাড়ে৷ ফলে পাল্লা দিয়ে শাক-সবজি , চাল, ডাল থেকে শুরু করে সব জিনিসের দাম বাড়ে৷ আর কে না জানে, এই বাড়ার হিসাবও মেলে ন৷ ডিজেলের দাম লিটারে এক টাকা বাড়লে জিনিসের দাম ১০ টাকাও বাড়তে পারে, আবার ৪০ টাকাও৷

এই যেমন সরষের তেল৷ কিছুদিন আগে ছিল ১০০ থেকে ১২৫ টাকা লিটার৷ বাড়তে বাড়তে তা দুইশ ছাড়িয়ে প্রায় আড়াইশ ছুঁই ছুঁই হলো৷ বিধানসভা নির্বাচনের আগে সেই জাদুদণ্ড কাজ করলো, দাম কমে ১৮০-১৮৫ হলো৷ এখন আবার বাড়ার ছাড়পত্র জুটে গেছে৷

আর বাড়বে না-ই বা কেন, রাজনৈতিক দলগুলিতে কান পাতলেই শোনা যায়, বড় রাজ্যগুলিতে ভোটের জন্য তাদের খরচ বিপুল৷ সবমিলিয়ে হাজার কোটি ছাড়িয়ে গেলেও নাকি অবাক হওয়ার কিছু নেই৷ টাকাটা তাদের কাছে আসবে কোথা থেকে, কে দেবে? ওই ব্যবসায়ী, শিল্পপতিরা৷ তারা তো নিজের ঘর থেকে টাকা দেবে না৷ তাদেরও তো উসুল করে নিতে হবে৷ ফলে জিনিসের দাম বাড়বে৷ আসলে জনগণের পকেট থেকেই টাকাটা শেষ পর্যন্ত যাবে৷ আর জনগণ নামক বায়বীয়, যুক্তিহীন মানুষরা ভোটের সময় কিছু বিনি পয়সার উপঢৌকন পেয়ে আনন্দে উদ্বেল হয়ে যাবে৷

দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য

নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারি তন্ত্র ঠিক আছে৷ ক্রেতাসুরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রাইস মনিটরিং ডিভিশন বা দামের উপর নজরদারি রাখার জন্য শাখা আছে৷ তারা প্রতিদিন দেশের পাঁচটি শহরের ১৬৭টি কেন্দ্র থেকে ২২টি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম জোগাড় করে৷ তারপর তা প্রকাশ করে৷ একমাস আগে দাম কত ছিল, এক বছর আগে কত ছিল তার তুলনামূলক হিসাবও তারা প্রকাশ করে৷ এই ২২টি জিনিসের মধ্যে চাল, ডাল, তেল, চিনি, গুড়, চা, দুধ যেমন আছে, তেমনই আছে আলু, পেঁয়াজ, টমেটোর মতো সবজিও৷

তারপর তারা এই সব জিনিসের দাম পর্যালোচনা করেন, বিশ্লেষণ করেন, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি না দেশের কোনো কারণ এর জন্য দায়ী, সেসব দেখেন৷ রিপোর্ট তৈরি করেন৷ সেই রিপোর্ট মন্ত্রী ও আমলাদের কাছে যায়৷ প্রধানমন্ত্রী নিজে মাঝেমধ্যে জিনিসের দাম নিয়ে বৈঠক করেন৷

সবই হয়৷ তারপর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যখন চলে যায়, লাগামছাড়া দাম বাড়ে, সংবাদমাধ্যমে কিঞ্চিত হইচই শুরু হয়, তখন সরকারি তন্ত্র নড়েচড়ে বসে৷ তারা তখন মোবাইল ট্রাকে করে পেঁয়াজ বিক্রি করে, দরকার হলে আলু, টমেটোও৷ দরকার হলে বাইরে থেকে ডাল আমদানি করা হয়৷ তেলও৷ কিন্তু সেসব হইচইয়ের পর৷ নাহলে সরকারি তন্ত্র যেমন চলার তেমনই চলে৷ প্রতিদিনের রিপোর্ট, মিটিং, চা পান, বিশ্লেষণ, আবার রিপোর্ট, মন্ত্রী, সচিব, যুগ্ম সচিবদের বৈঠক, সবই হয়৷ এসব হয়, হয়েই থাকে৷ মাঝখান থেকে সরষের তেল আড়াইশ ছোঁয়, পেঁয়াজের কিলো কখনো পঞ্চাশের বেশি হয়ে যায়, টমেটো বিক্রি হয় ৮০ টাকা কিলোয়৷ চাল, ডাল, দুধ, তেলের দাম বাড়তেই থাকে৷

গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলে
গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলেছবি: privat

তখন উপায়? দাম বাড়লে মধ্যবিত্তরাই সব চেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন৷ কারণ, বড়লোকেদের এই দাম বাড়া গায়ে লাগে না৷ গরিবরা ভারতে এখনো বিনা পয়সায় রেশন পান৷ সেটা বন্ধ হলে তারা দুই টাকা, তিন টাকা কেজি দরে চাল ও গম পাবেন৷ ফলে তাদেরও সমস্যা হওয়ার কথা নয়৷ মধ্যবিত্তরা তখন তাদের মাসের বাজেট ঠিক রাখতে মানের সঙ্গে আপোস করেন৷ আগে ষাট টাকা কেজি দরে চাল কিনতেন, দাম বাড়ার পর কম দামের চালের খোঁজ করেন৷ তারা দিনে পেঁয়াজ কেনার পরিমাণ অর্ধেক করে দেন৷ এক লিটার দুধের বদলে আধ লিটার দুধ আসে বাড়িতে৷ এভাবেই তাদের জীবনযাত্রার মান হয় কমে বা মাসের শেষে তারা ভবিষ্যতের জন্য কিছুই জমাতে পারেন না৷ এই শাঁখের করাত তাদের কাটতেই থাকে৷

সরকারি চাকরি হলে ডিএ বাড়ে, বেসরকারি চাকুরেদের কিছুই বাড়ে না৷ বছরের শেষে তাদের শুনতে হয়, কোম্পানি করোনার বাজারে, আর্থিক সংকটের সময়ে, যুদ্ধের আবহে খুব খারাপ অবস্থায় আছে৷ তাই বাড়া তো দূরস্থান, মাইনে কমে যেতে পারে৷ তখন? তখন আর কী, স্বামী-স্ত্রীর কপালে চিন্তার ভাঁজ আরো গভীর হয়৷ সংসারের বাজেট মেলাতে গিয়ে পাগল পাগল লাগে৷ তাদের কাছে কোনো জাদুদণ্ড নেই, মাস গেলে সামান্য কয়েকটা টাকা আছে৷ জাদুদণ্ড তো সরকারের হাতে৷ তারা আশা করতে থাকে, কবে সেই জাদুদণ্ড আবার সচল হবে, কবে আবার জিনিসের দাম সাধ্যের মধ্যে আসবে৷ কবে লড়াই বন্ধ হবে, করোনা যাবে, অর্থনীতি সচল হবে, তাদের হাতে দুটো বাড়তি টাকা আসবে৷

এই স্বপ্নের চক্র ঘুরতে থাকে৷ ঘুরতেই থাকে৷ পেট্রোল-ডিজেলের দাম আবার বাড়ে৷ ফলে আবার সেই একই কাহিনির পুনরাবৃত্তি৷ এই আশা নিয়ে বাঁচতে বাঁচতেই তাদের দিন কেটে যায়, কষ্টে, চিন্তায়, উদ্বেগে৷

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি গৌতম হোড়৷
গৌতম হোড় ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি৷
স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য