1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সরকার বদলালে সিলেবাসও বদলায়, জানে ভারত

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি গৌতম হোড়৷
গৌতম হোড়
২৪ নভেম্বর ২০২৩

ভারতের শিক্ষাব্যবস্থায় কাঠামোগত পরিবর্তন আনা কঠিন। কিন্তু সিলেবাসে রাজনৈতিক মতাদর্শ গুঁজে দেওয়া সহজ।

https://p.dw.com/p/4ZOP9
কলকাতার একটি স্কুলের শ্রেণীকক্ষে পাঠদান
ভারতে কেন্দ্রীয় সরকার স্কুল শিক্ষার কাঠামোয় বড় রকমের পরিবর্তনের প্রস্তাব এনেছেছবি: Payel Samanta/DW

ভারতের স্কুলিশিক্ষার ক্ষেত্রে একাধিক বোর্ড আছে। প্রতিটি রাজ্যের যেমন নিজস্ব শিক্ষাবোর্ড আছে, তেমনই আছে কেন্দ্রীয় শিক্ষাবোর্ড। এদেশে রাতারাতি সিলেবাস বদলে ফেলা সহজ নয়। আবার খুব কঠিনও নয়।

নব্বই সালের কথা মনে পড়ছে। আমরা তখন স্কুলছাত্র। দেখতাম, বাড়িতে বাবা-জেঠুদের বন্ধুরা, পরিচিতরা নিয়মিত আসছেন এবং গভীর বৈঠকে বসছেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই খবরের কাগজে হেডলাইন-পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিক স্তরের পাঠক্রম থেকে তুলে দেওয়া হচ্ছে ইংরেজি। খুব ভুল না করলে, সম্ভবত অষ্টম শ্রেণি থেকে ইংরেজি পড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে দিকে দিকে তখন পক্ষে বিপক্ষে সভা চলছে। আমাদের বাড়িতেই দুইটি বিতর্ক সভার আয়োজন করা হয়েছিল বলে মনে পড়ে। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদেরা সেখানে পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা করেছিলেন।

খুব সহজে কি সেই পরিবর্তন সম্ভব হয়েছিল? বলাই বাহুল্য, না। স্কুলের সিলেবাস কী হবে, তা ঠিক করার জন্য নির্দিষ্ট কমিটি থাকে। গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাবিদেরা সেখানে থাকেন। বহু আলোচনা, বাইরে থেকে মতামত গ্রহণ করেই সিলেবাসের কাঠামোগত পরিবর্তন করা হয়। ইংরেজি তুলে দেওয়া তেমনই এক কাঠামোগত পরিবর্তন ছিল। এবং এই ধরনের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে শেষপর্যন্ত সরকারের শিলমোহর লাগে। সরকার সবুজ সংকেত দেওয়ার পরেই তা শিক্ষাব্যবস্থায় লাগু হয়। ৯০ সালে পশ্চিমবঙ্গে সেই কাঠামোগত পরিবর্তন হয়েছিল। যদিও খুব বেশিদিন তা চলতে পারেনি। কিছু বছরের মধ্যেই সেই কাঠামোর ফের পরিবর্তন করা হয়। এখনো মনে পড়ে, সরকারের সেই পরিবর্তন নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয়েছিল। সিলেবাস কমিটির বেশ কিছু সদস্যও ওই পরিবর্তন মেনে নিতে পারেননি।

অতি সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার স্কুল শিক্ষার কাঠামোয় বেশ বড় রকমের পরিবর্তনের প্রস্তাব এনেছে। পরীক্ষাব্যবস্থা, প্রশ্নের ধরন, সিলেবাসের চলন-- এই সবকিছু নিয়েই গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে সেই প্রস্তাবে। নিউ এডুকেশন পলিসি বা ন্যাশনাল এডুকেশন পলিসি নামে পরিচিত ওই প্রস্তাব নিয়েও তীব্র বিতর্ক হচ্ছে। অনেকেই বলছেন, কেন্দ্রীয় সরকারের এই নতুন শিক্ষানীতিআসলে শিক্ষাব্যবস্থাকে গেরুয়াকরণের দিকে আরো একধাপ এগিয়ে দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই কেন্দ্র তা মানছে না। কেন্দ্রীয় শিক্ষাকেন্দ্রগুলিতে নতুন শিক্ষানীতি চালু হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গসহ বহু রাজ্যই এখনো তা গ্রহণ করেনি।

ভারতের সংবিধানে ৪২ নম্বর ধারায় শিক্ষা বিষয়ক আলোচনা আছে। মনে রাখা দরকার, ভারত একটি ফেডারেল স্টেট বা যুক্তরাজ্যীয় রাষ্ট্র। এখানে রাজ্যের হাতে কিছু ক্ষমতা থাকে, কেন্দ্রের হাতে কিছু ক্ষমতা থাকে। সংবিধান সেই ক্ষমতা ভাগ করে দিয়েছে। সংবিধানের ৪২ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে শিক্ষা স্টেট সাবজেক্ট বা রাজ্যের বিষয়। ফলে প্রতিটি রাজ্য তার নিজস্ব শিক্ষা নীতি ঠিক করতে পারে। এবং সেই শিক্ষানীতি নির্দিষ্ট কমিটির হাত ঘুরে সরকারের কাছে পৌঁছায়। ১৯৭৬ সালে এই ধারায় একটি সংশোধন আনা হয়। শিক্ষা যৌথ বিষয় বা কনকারেন্ট লিস্টে গৃহীত হয়। অর্থাৎ, কেন্দ্র এবং রাজ্যের সমানাধিকার থাকবে শিক্ষার বিষয়ে। এর মূল কারণ, কেন্দ্র এবং রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে একটি ভারসাম্য রক্ষা।

যৌথ বিষয় হলেও, কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতি সম্পূর্ণভাবে মানতে বাধ্য নয় রাজ্য। আবার কোনো রাজ্যের নির্দিষ্ট শিক্ষানীতি মানতে বাধ্য নয় ওই রাজ্যেই অবস্থিত কেন্দ্রীয় শিক্ষাকেন্দ্র। সকলেই তার নিজস্ব রাস্তায় চলতে পারে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষার জন্য কেন্দ্র এবং রাজ্য নিজেদের শিক্ষানীতি নিয়ে আলোচনা করে, একটি মূলগত সমতা বজার রাখআর চেষ্টা করে।

শিক্ষার পরিকাঠামোগত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এখনো কেন্দ্র এবং রাজ্য এই ভারসাম্য বজায় রেখেই চলছে। রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলির শিক্ষাব্যবস্থায় সাংঘাতিক কোনো তফাত নেই। কিন্তু যতদিন যাচ্ছে, সিলেবাসে আমূল তফাত তৈরি হচ্ছে। আর এর সবচেয়ে বড় কারণ রাজনীতি

একসময় স্কুল সিলেবাসে সামান্য পরিবর্তন হলেও তা নিয়ে রীতিমতো আলোচনা হতো। সরকার আইনসভার ভিতর এবং বাইরে বিতর্ক আহ্বান করতো। ইদানীং সে সব চল আর নেই বললেই চলে। কথা নেই বার্তা নেই, সিলেবাস বদলে দেওয়ার এক আশ্চর্য চল শুরু হয়েছে গত কয়েক দশক ধরে। এবং এই সিলেবাস পরিবর্তন মূলত রাজনৈতিক।

গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলে
গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলেছবি: privat

কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক। পশ্চিমবঙ্গের স্কুলপাঠ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা পড়ানো হয়। ২০০৬ সালে ঘটে যাওয়া সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলন স্কুলপাঠ্যে ঢোকানো হয়েছে। এর থেকে স্পষ্ট, স্কুলপাঠ্যকে আসলে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ঠিক একইরকম ভাবে ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশন রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং (এনসিইআরটি) নিয়মিত জাতীয় স্কুলপাঠ্যের পাঠক্রম বদলে চলেছে। ইতিহাস বই থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে মুঘল আমল। দক্ষিণপন্থি রাজনীতির আলাদা চ্যাপ্টার যোগ করা হচ্ছে। উত্তরপ্রদেশের স্কুলপাঠ্য থেকে বাদ গেছে রবীন্দ্রনাথের কবিতা। যুক্ত হয়েছে বাবা রামদেবের লেখা। এই ধরনের পরিবর্তনকে ঠিক কাঠামোগত পরিবর্তন বলা যায় না। এই ধরনের পরিবর্তনের জন্য খুব বেশি কাঠ-খড়ও পোড়াতে হয় না। সন্তর্পনে এই কাজগুলি ধীরে ধীরে চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আর এইভাবেই পাঠক্রম নিয়ে রাজনীতি সমানে চলছে। গত কয়েকদশকে এই পরিবর্তনের মাত্রা এতটাই বেড়ে গেছে যে ইদানীং তা নিয়ে কোথাও কোথাও আলোচনা, বিতর্ক শুরু হয়েছে।

ভারতের মতো বিরাট দেশে রাতারাতি শিক্ষা ব্যবস্থার পরিকাঠামো বদলে ফেলা সহজ নয়। এখানে কমিটি গঠনের জন্যও কমিটি বসানো হয়। আলোচনার বিষয় স্থির করার জন্য আলোচনাসভার আয়োজন করা হয়। এর যেমন অনেক খারাপ দিক আছে, তেমন কিছু ভালো দিকও আছে। হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগে। যে কোনো সিদ্ধান্তেই চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের সুযোগ বেশি। কিন্তু স্কুলপাঠ্য থেকে ইংরেজি তুলে দেওয়ার মতো হঠকারী সিদ্ধান্ত একবার নেওয়া হয়ে গেলে তার পরিবর্তন করতেও অনেকটা সময় লেগে যায়। বলি হয়ে যায় একটা গোটা প্রজন্ম।

বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে যে পরীক্ষানিরিক্ষা শুরু করেছে, তার প্রভাবও আজ দেখা যাবে না। কয়েকদশক পর একটা আস্ত প্রজন্মকে এর জন্য ভুগতে হবে। 

ভারতের প্রথম রোহিঙ্গা স্নাতক

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি গৌতম হোড়৷
গৌতম হোড় ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি৷
স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান