সমুদ্রের নীচে ভয়াবহ মরণফাঁদ
২৬ অক্টোবর ২০১৫জার্মানির উত্তর সাগরের হুকসিল উপকূলের সামনেই একটি উইন্ডমিল শোভা পাচ্ছে৷ এটি জার্মানিতে পুরোপুরি টেকসই জ্বালানি ব্যবহারের পরিকল্পনার প্রতীকের মতো৷ উপকূল থেকে দূরে এমন আরও অনেক উইন্ডমিল বসানো হলে কেমন দেখাবে, এখনই তার আন্দাজ পাওয়া যায়৷
একটা আস্ত উইন্ডমিল পার্ক সৃষ্টি হচ্ছে৷ প্রথম মিলটির নাম ‘সামুদ্রিক বাতাস'৷ বছরে প্রায় ৩ লক্ষ বাড়িতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে সেটি৷ তবে এমন উইন্ডপার্ক তৈরির আগে বিশেষ জাহাজের সাহায্যে সমুদ্রের তলদেশ পরীক্ষা করতে হবে৷ আবহাওয়া ভালো থাকলে প্রতিদিন সকালে একদল নাবিক আরএএম জাহাজে করে বেরিয়ে পড়েন৷ তাঁদের লক্ষ্য উত্তর সাগরকে আরও নিরাপদ করে তোলা৷
দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধের ফলে সেখানে মাইন, টর্পেডো ও গ্রেনেডের বিশাল সম্ভার রয়েছে৷ সি টেরা অর্ডন্যান্স ক্লিয়ারিং সার্ভিসের ডিটার গুলডিন বলেন, ‘‘পরিচিত এলাকা সত্যি খুব বড়৷ উত্তর সাগরে নিশ্চয় ১০ লক্ষ টনেরও বেশি বিপজ্জনক বস্তু পড়ে রয়েছে৷ তাছাড়া এমন সব জায়গাও রয়েছে, ডাম্পিং এরিয়া যাবার পথে যেখানে অস্ত্রশস্ত্র ফেলা হয়েছে৷ আবার যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে তেল বাঁচাতে বিমান থেকে বাড়তি বোঝা সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়েছে৷''
যুদ্ধ শেষ হবার পর মিত্রশক্তিও বাজেয়াপ্ত করা অস্ত্রশস্ত্র উত্তর ও বাল্টিক সাগরে ফেলে দিয়েছে৷ বহু দশক ধরে নোনা জল ধাতুর ক্ষয় ঘটিয়েছে৷ ফলে বিস্ফোরক সমুদ্রে বেরিয়ে এসেছে৷ ডুবুরি রোবট এখন সেগুলি শনাক্ত করছে৷ বিরল ক্ষেত্রে বোমা নিজে থেকেই ফেটে যায়, বিশেষ করে যখন রাসায়নিক প্রক্রিয়ার ফলে অ্যাসিড ফিউজ সক্রিয় হয়ে ওঠে৷
ডিটার গুলডিন ও তাঁর বিশেষজ্ঞ দল কন্ট্রোল রুমে বসে দেখতে পান, রোবট কিছু পেলো কিনা৷ ডিটার বলেন, ‘‘এই অবস্থায় সবকিছু ভালো করে জানতে হবে৷ ঠিক কী ধরনের গ্রেনেড, কী ধরনের ফিউজ, কী ধরনের মাইন – সেটা জেনে সিদ্ধান্ত নিতে হবে৷ সেটি সরানো কি সম্ভব? অথবা কোথাও জমা রাখা? সমুদ্রের নীচে কেবেল লাইন থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে, নাকি ঘটনাস্থলেই ধ্বংস করতে হবে?''
একেবারে নিশ্চিত হতে এক ডুবুরিকে বস্তুটি পরীক্ষা করতে হয়৷ পোড় খাওয়া ও অভিজ্ঞ এই ডুবুরিরা কার্যত সব সবরকম বিস্ফোরক হাতে নিয়েছেন৷ এই বস্তুটি সম্ভবত একটি সি-মাইন৷ তাই অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে৷ তাড়াহুড়ো করে দ্রুত কিছু করলে চলবে না৷ কিন্তু ঝুঁকি কখনোই পুরোপুরি দূর করা যায় না৷ ডুবুরি হাইকো ভ্লক বলেন, ‘‘ভয় করলে চলে না৷ এমন জিনিস, অস্ত্র বা বিস্ফোরক সম্পর্কে মনে ভয় থাকলে অফশোর ক্ষেত্রে কাজ করার কোনো অর্থ হয় না৷''
শুধু উদ্ধার করলেই কাজ শেষ হয় না৷ বিশেষ বাহিনী এসে বড় আকারের বোমা নিষ্ক্রিয় করে৷ অনেক সময় বিপজ্জনক ছোট বস্তু জলে ভেসে উপকূলে চলে আসে৷ বিস্ফোরক উদ্ধার পরিষেবার হান্স মোয়র বলেন, ‘‘পর্যটক বা পথিকরা এই সব বস্তু খুঁজে পেয়েছেন৷ তখন কর্তৃপক্ষের কাছে তা জানাতে হয়৷''
নিষ্ক্রিয় করা না গেলে ঘটনাস্থলেই বিস্ফোরণ ঘটানো হয়৷ সরানো না গেলে জলের নীচেই সেটি নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়৷ পরিবেশ সংরক্ষণকারীরা এই পদক্ষেপের সমালোচনা করেন৷ কারণ তাঁদের মতে, জলের মধ্যে বিস্ফোরণ সেখানকার প্রাণীদের জীবন বিপন্ন করে তোলে৷ পরিবেশ সংরক্ষণ জোটের ইয়ান শ্যুরিংস বলেন, ‘‘আগে ডায়নামাইট দিয়ে মাছ ধরার যে প্রবণতা শুরু হয়েছিল, সৌভাগ্যক্রমে তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷ শরীরে একটি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে মাছ জলের মধ্যে চাপের তারতম্য বুঝতে পারে এবং সেই অনুযায়ী চলাফেরা করে৷ কিন্তু এমন বিস্ফোরণে তীব্র শব্দ হয় এবং প্রচণ্ড শক্তিশালী চাপের তরঙ্গ সৃষ্টি হয়৷ ফলে মাছের মৃত্যুও হতে পারে৷''
জ্বালানি সংস্থার হয়ে যারা কাজ করেন, প্রাণী সংরক্ষণ সম্পর্কে তাঁরা মোটেই উদাসীন নন৷ কিন্তু উত্তর সাগরে বোমা সরানোই তাঁদের মূল উদ্দেশ্য৷ এই সব বিস্ফোরক ক্রমশঃ আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে৷
জাহাজ চলাচল থেকে শুরু করে সমুদ্রের নীচে প্রাণীজগতের জন্য এটা একটা হুমকি৷ উইন্ডপার্ক তৈরির ক্ষেত্রেও এই বাধা বিলম্ব ঘটাচ্ছে৷ ডুবুরিরা তাঁদের ক্ষমতার সীমা সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন৷ ডিটার গুলডিন বলেন, ‘‘উত্তর সাগরে বিস্ফোরক দূর করার বিষয়ে আলোচনা করলে জানতে হবে, যে আগামী ১০ থেকে ২০ বছর ধরে কোটি কোটি বস্তু দূর করতে হবে৷ শুধুমাত্র উপকূলবর্তী এলাকার নিরাপত্তার জন্যই এটা করা প্রয়োজন৷ গোটা উত্তর ও বাল্টিক সাগর তো আরও দূর অস্ত৷''
যুদ্ধের পর ১০ লক্ষ টন বিস্ফোরক উত্তর ও বল্টিক সাগরে ফেলে দেওয়া হয়েছিল৷ তার মধ্যে চরম বিষাক্ত রাসায়নিক অস্ত্রও ছিল৷ সেই বোঝা অত্যন্ত বিপজ্জনক৷