মুক্তিযোদ্ধা পাপড়ি বসু
১১ জুলাই ২০১২‘‘আমার মামা ছিলেন নীতিশ রায় চৌধুরী৷ তিনি ছিলেন আকাশবাণী'র সংবাদদাতা৷ তিনি যুদ্ধের সময় সীমান্ত এলাকা থেকে সংবাদ সংগ্রহ করতেন৷ মাঝে মাঝে আমি তাঁর সাথে খবর সংগ্রহের জন্য যেতাম৷ আবার কখনও তিনি একাই খবর নিয়ে আসতেন৷ আমার তখনই খুব অন্য রকম এক চেতনা ছিল৷ আমিও খুব লিখতাম তখন৷ মামার খুব বিশ্বাস ছিল যে, যেগুলো অপ্রয়োজনীয় সংবাদ সেগুলো আমি ঠিকঠাক মতো কেটে ফেলতে পারি৷ তাই কখনও মামার সাথে বসে কিংবা কখনও আমি একাই সংবাদগুলোকে কেটেছেঁটে সম্পাদনা করতাম৷ পরের দিন দেখা যেতো এই সংবাদগুলোর প্রায় অংশই দেব দুলাল কিংবা সান্যাল দার কণ্ঠে ভেসে আসতো আকাশবাণী থেকে৷ মামা মে মাসে এসেছিলেন৷ আগস্ট পর্যন্ত থেকে আবার কলকাতা চলে যান৷ এসময় আমি তাঁর সাথে সংবাদগুলো পরিবেশনের কাজ করতাম৷ তাছাড়া সেসময় আমি ৩/৪ টি নিবন্ধ লিখেছিলাম৷ তখন ইন্দিরা গান্ধীর মানবিকতা ও মহানুভবতা দেখেছি আমরা৷ প্রায় এক কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলাম৷ আমাদের শরণার্থী শিবিরগুলোতে কীভাবে খাবার সরবরাহ করা হতো সে বিষয়ে আমি একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম৷ আনন্দবাজার পত্রিকায় সেটি ছাপা হয়েছিল৷ শিরোনাম ছিল ‘মানবিকতার প্রশ্নে ইন্দিরাজি'৷ সেই লেখাটি খুব সমাদৃত হয়েছিল৷ আসলে একটি দেশের নেত্রীর যদি ঐকান্তিকতা না থাকে তাহলে কি তিনি তাঁর জনগণের সমর্থন নিয়ে প্রতিবেশী দেশের বাড়তি এক কোটি মানুষকে আশ্রয় ও সেবা দিতে পারতেন? সেটিই ছিল আমার লেখার মূল উপজীব্য৷'' এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি হাতড়ে নিজের কিছু কাজের কথা বলছিলেন বীর নারী মুক্তিযোদ্ধা পাপড়ি বসু৷
এছাড়া দেশকে স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই দেশের মানুষ নিজেদের কীভাবে প্রস্তুত করছিলেন তারই একটি নমুনা তুলে ধরেন তিনি৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘১৯৭১ সালের ২১শে মার্চ৷ ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত আমাদের বাড়ির সামনের চত্বরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ কর্মকাণ্ড অবলোকন করার জন্যই আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন৷ তখন আমরা তাঁকে ছানার সন্দেশ খেতে দিয়েছিলাম৷ তখন তিনি বলেছিলেন, না, পুরোটা খাওয়া যাবে না৷ দেশে খুব ক্রান্তিলগ্ন৷ জাহাজ দিয়ে সব সৈন্য চলে আসবে কিছুদিনের মধ্যেই৷ তাই আমরা একটি খাবারের চার ভাগের এক ভাগ খাবো৷ বাচ্চারা পেট পুরে খাবে আর তোমরা খাবে তিন ভাগের দুই ভাগ৷ সেইদিনই তাঁর সাথে আমার শেষ দেখা৷ শেষ পর্যন্ত ২৯শে মার্চ তাঁকে হত্যা করা হয়৷''
দেশ স্বাধীন হলে ১৬ই ডিসেম্বর জাসদের নেতা রাশেদ খান মেনন এবং জেঠিমা শান্তি ধরের সাথে আখাউড়া দিয়ে নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন পাপড়ি বসু৷ এসময়ের হৃদয় বিদারক একটি ঘটনার কথা জানান তিনি, ‘‘যখন বিজয়ের পতাকা উড়ছে৷ আমরা সীমান্তের কাছে থাকায় পতাকা দেখতে পাচ্ছিলাম৷ কিন্তু সীমান্ত দিয়ে আসার সময় আমি নিজে দেখলাম পাকিস্তানি সৈন্যদের বর্বরতার শিকার কিছু বীরাঙ্গনাদের৷ ট্রেঞ্চে চার/পাঁচ জন বীরাঙ্গনা ছিলেন৷ তাঁদের মধ্যে আমার এক আত্মীয়ও ছিলেন৷ আমাদের এক দাদার মেয়ে তাঁকেও দেখেছি৷ সেটা আমাকে খুব বেদনা এবং প্রেরণা দেয়৷ তবে আমি এখনও প্রশ্ন রাখতে চাই যে, আমাদের নজর দেওয়া জরুরি যে বাংলাদেশের নারী মুক্তিযোদ্ধারা এবং বীরাঙ্গনা মায়েরা কী অবস্থায় আছে?''
নতুন দেশে ফিরে আবারও লেখাপড়া শুরু করেন পাপড়ি বসু৷ ১৯৭২ সালে মাধ্যমিক এবং ১৯৭৪ সালে কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা পাস করেন৷ পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে লেখাপড়া সম্পন্ন করেন এই নারী নেত্রী৷ এরপর কিছুদিন ইস্পাহানি কলেজে অধ্যাপনা করেন পাপড়ি বসু৷ তবে মুক্তির সংগ্রাম আর আন্দোলনে কেটেছে যাঁর বিদ্যালয় জীবন, তিনি খুব বেশিদিন কলেজের গণ্ডিতে আবদ্ধ না থেকে সমাজ সেবামূলক কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন৷ তিনি দীর্ঘদিন বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতির কেন্দ্রীয় পরিচালনা পরিষদে সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন৷ পরিবার পরিকল্পনা সমিতির দক্ষিণ এশিয়ার পরিষদেও প্রতিনিধিত্ব করছেন তিনি৷
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪১ বছর হয়ে গেলেও এখনও নারী মুক্তিযোদ্ধা এবং বীরাঙ্গনাদের যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি বলে ক্ষোভ ঝরে পড়ে এই সাহসী ও ত্যাগী নারী নেত্রীর কণ্ঠে৷ তবে বীরাঙ্গনারাও নিজেদের প্রকাশ করতে চান না৷ তাই তাঁদেরকে নিয়ে কাজ করার কথা বলেন পাপড়ি বসু৷ একইসাথে তাঁদের ন্যায্য অধিকার ও সম্মান প্রদানের জন্যও জোর আহ্বান জানান তিনি৷
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: আরাফাতুল ইসলাম