জটিলতার কারণ হলো, ভারতে একটি নয়, একাধিক পার্সোনাল আইন আছে৷ হিন্দু পার্সোনাল আইন, যার মধ্যে বৌদ্ধ, জৈন, শিখরাও আছেন, মুসলিম, ক্রিশ্চান ও পার্সিদের জন্য আলাদা পার্সোনাল আইন আছে৷ ভারত ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হলেও পার্সোনাল আইন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধর্মভিত্তিক৷ আর এই পার্সোনাল আইন অনুসারে বিয়ে, বিবাহবিচ্ছেদ, সন্তানের অধিকার, সম্পত্তির অধিকার সবকিছু নির্ধারিত হয়৷
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন সংবিধান লেখা হচ্ছে, তখন বিষয়টি নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়েছে৷ দীর্ঘ আলোচনার পর সংবিধানকাররা সিদ্ধান্ত নেন, দেশে আপাতত একাধিক পার্সোনাল আইন থাকবে৷ কিন্তু তারা চান, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটাই পার্সোনাল আইন চালু হোক৷ তার নাম ইউনিফর্ম সিভিল কোড৷ ভারতীয় সংবিধানে ডাইরেকটিভ প্রিন্সিপাল রাখা হয়েছে৷ অর্থাৎ, যে বিষয়গুলো কোনো না কোনো কারণে তখন সংবিধানে রেখে চালু করা সম্ভব হয়নি, সেগুলি যাতে দ্রুত করা হয় তার একটি তালিকা করে রেখেছেন সংবিধানকাররা৷ ইউনিফর্ম সিভিল কোড বা সকলের জন্য একটাই পার্সোনাল আইনের বিষয়টি সেই তালিকায় রয়েছে৷
কেন সংবিধান চালুর সময় ইউনিফর্ম সিভিল কোড চালু করা হয়নি? সংবিধানকাররা ভেবেছিলেন, দেশভাগের ফলে তখন প্রবল উত্তেজনা ছিল৷ তার উপর বাড়তি উত্তেজনার মতো বিষয় চাপিয়ে দিলে পরিস্থিতি খারাপ হতে পারতো৷ তাছাড়া ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর বক্তব্য ছিল, তিনি নিজে হিন্দু৷ তাই আগে হিন্দুদের পার্সোনাল আইনকে সংস্কার করা উচিত৷ তারপর বাকিদের ক্ষেত্রে তা করা যাবে৷ সেইমতো হিন্দু ম্যারেজ, হিন্দু সাকসেশন, হিন্দু মাইনরিটি ও গার্জিয়ানশিপ ও হিন্দু অ্যাডপটেশনস ও মেনটেনেন্স আইন করা হয়েছে, যাকে বলা হয়, আধুনিক হিন্দু আইন৷ মুসলিমদের ক্ষেত্রে বছরকয়েক আগে তিন তালাক আইন করা হয়েছে৷
এই ইতিহাসটুকু না জানলে ভারতে পার্সোনাল আইনের পুরো বিষয়টা বোঝা যাবে না৷ এর সঙ্গে আরো একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্ট এই আইনের ব্যাখ্যা দিতে পারে, তারা এমন রায় দিতে পারে যা নজির হয়ে থাকবে এবং বাস্তবে হয়েছেও তাই৷ এই বছরই জানুয়ারি মাসে সুপ্রিম কোর্ট ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে হিন্দু নারীদের ক্ষেত্রে৷ সেই রায়ে বলা হয়েছে, যদি হিন্দু পরিবারের পুরুষ কোনোরকম উইল না করে মারা যান, তাহলে তার সম্পত্তি পাওয়ার অধিকার মেয়েদেরও থাকবে৷ না হলে এইরকম ক্ষেত্রে ছেলেরাই সেই সম্পত্তির অধিকারী হতেন৷ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পর মেয়েদের অধিকারও সুনিশ্চিত হলো৷ লিঙ্গ-সাম্য হলো৷ মেয়েরা বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি গেলেই যে বাবার সম্পত্তির অধিকার হারাবে, এই অন্যায় থেকে মেয়েরা বাঁচলো, তাদের অধিকার নিশ্চিত করলো সুপ্রিম কোর্ট৷
সন্তানের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য৷ এখানে বিবাহ আইনের পাশাপাশি ১৯৫৬ সালের হিন্দু মাইনরিটি অ্যান্ড গার্ডিয়ানশিপ আইন এবং ১৮৯০ সালের গার্জিয়ানস অ্যান্ড ওয়ার্ডস আইন আছে৷ ১৯৫৬ সালের আইনে বলা হয়েছে, পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত বাচ্চা মায়ের কাছে থাকবে৷ তারপর থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত বাবার অধিকার বেশি৷
কিন্তু পরে এনিয়ে প্রচুর মামলা হয়েছে৷ আদালত তাতে যে রায় দিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, বাচ্চার স্বার্থ সর্বোপরি৷ তাই বাচ্চার স্বার্থে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত বলে জানিয়েছে আদালত৷ ২০২২-এর জানুয়ারিতে সুপ্রিম কোর্টের রায় হলো, বাচ্চা কার অধিকারে থাকবে, সেখানে একটাই মাপদণ্ড থাকবে৷ বাচ্চার কল্যাণ যিনি সবচেয়ে বেশি করতে পারবেন, তার কাছেই সন্তান থাকবে৷ সুপ্রিম কোর্টের মতে, সন্তানের অধিকার সংক্রান্ত আইন এখানে অবান্তর৷
কেন অবান্তর তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন বিচারপতিরা৷ বিচারপতি অভয় ওকার মতে, সন্তানের অধিকার বাবা না মা কার কাছে থাকবে, তা ঠিক করার কোনো স্ট্রেট জ্যাকেট ফর্মুলা নেই৷ এটা একটি জটিল মানবিক বিষয়৷ সেখানে একটাই কষ্ঠিপাথর থাকবে, বাচ্চার কল্যাণ কে সবচেয়ে ভালোভাবে করতে পারবে৷ ২০২২-এর জুন মাসে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ইন্দিরা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, বাচ্চা তো বাবা-মা দুজনেরই কাছে থাকতে পছন্দ করবে৷ যদি একান্তই বাবা ও মা একসঙ্গে থাকতে না পারেন, যদি বিচ্ছেদ করতেই হয়, তাহলে বাচ্চার অধিকার থাকবে, বাবা ও মা দুজনের কাছেই যাওয়ার৷ বাবা ও মা দুজনেরই ভালোবাসা ও স্নেহ পাওয়ার৷ বাবা ও মা-র মধ্যে যত বিরোধই থাকুক না, মা কখনোই বাবাকে তার সন্তানের সঙ্গে দেখা করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে না৷ এমনকি করোনার অজুহাত দেখিয়েও এটা করা যাবে না৷
এভাবেই সুপ্রিম কোর্ট এখন ভারতে এটাই নিশ্চিত করে দিয়েছে, বাবা বা মা, যার কাছেই সন্তান থাকুক না কেন, দুজনের স্নেহ, ভালোবাসা সে পাবে৷ দুজনের সঙ্গে দেখা করতে পারবে৷ থাকতে পারবে৷ ফলে বাবা বা মা কেউই সন্তানকে পুরোপুরি কুক্ষিগত করতে পারবে না৷ ফলে আইন থেকে বেরিয়ে এসে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে পুরো বিষয়টি দেখেছে সর্বোচ্চ আদালত৷ আর তার ফলে বাচ্চারা বেঁচে গেছে৷ তারা মা ও বাবার বিচ্ছেদের পর দুজনের কাছে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে৷ আর কার কাছে সন্তান থাকবে, সেটাও নির্ধারিত হচ্ছে, কে ওই বাচ্চার কল্যাণ করতে পারবে, কার কাছে থেকে সন্তান ঠিকভাবে বেড়ে উঠতে পারবে, তার উপর৷
এভাবেই ধর্মভিত্তিক আইনের থেকে উত্তরণ ঘটছে মানবিক অবস্থানে৷ আধুনিক চিন্তাচেতনার দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে আইন৷ সময়ের সঙ্গে, সমকালীন ভাবনা, ন্যায়ের অধিকারের সঙ্গে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ হচ্ছে৷ পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে থেকেও মায়ের অধিকারও প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে৷ নিঃসন্দেহে তা বড় প্রাপ্তি৷