সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল!
৩ জুলাই ২০১৭১৯৭২-এর সংবিধানে বিচারপতিদের অপসারণে বা অভিসংশনের ক্ষমতা সংসদের হাতেই ছিল৷ ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এই ক্ষমতা দেয়া হয় রাষ্ট্রপতিকে৷ ১৯৭৮ সালে জিয়উর রহমান সামরিক ফরমানে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে এই ক্ষমতা দেয়, যা সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত হয়৷ বর্তমান সরকারের আমালে ২০১৪ সালে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচাপতিদের অপসারণের ক্ষমতা আবার সংসদ সদস্যদের হাতে ফিরিয়ে দেয়া হয়৷
কিন্তু ওই বছররে ৫ নভেম্বর সংশোধনী বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি রিট করা হয়৷ শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ৫ মে গঠিত হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেন৷ রাষ্ট্রপক্ষ এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে সোমবার প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্ব সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে৷
আপিল বিভাগ শুনানিকালে মোট ১০জন অ্যামিকাস কিউরির মতামত নেয়৷ তাঁদের মধ্যে ৯ জন ষোড়শ সংশোধনীর বিপক্ষে মত দেন৷ তাঁরা হলেন ড. কামাল হোসেন, এম আই ফারুকী, আব্দুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ এফ এম হাসান আরিফ, ব্যারিস্টার এম আমিরুল ইসলাম, বিচারপতি টি এইচ খান, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, ফিদা এম কামাল এবং এ জে মোহাম্মদ আলী৷ শুধুমাত্র ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে মত দিয়েছেন৷
সোমবারে রায়ের পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘‘বিচারপতিদের অপসারণে সামরিক সরকারের করা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে আদালত কেন সাংঘর্ষিক মনে করছেন না, তা আমার বোধগম্য নয়৷ বিচারপতি অপসারণের বিষয়ে সংসদের হাতে যে ক্ষমতা ছিল, সেটি ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত৷ আপিল বিভাগ একটি সংক্ষিপ্ত আদেশ দিয়ে আমাদের আপিল খারিজ করে দিয়েছেন৷ এখনও আমরা পূর্ণাঙ্গ রায় পায়নি৷ রায় পেলে আমাদের করণীয় নির্ধারণ করবো৷''
সাবেক আইনমন্ত্রী এবং বিএনপি নেতা ব্যাস্টিার মওদুদ আহমেদ সংবাদমাধ্যমেকে বলেন, ‘‘সরকার বিচার বিভাগের ওপর যে হস্তক্ষেপ করতে চেয়েছিল, তা এই রায়ের মধ্য দিয়ে ধূলিসাৎ হয়েছে৷ এই সংশোধনীর মাধ্যমে বিচার বিভাগকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে চেয়েছিল সরকার৷''
এদিকে রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা আবার সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতেই ফিরে গেল৷ এই রায় ঘোষণার পর থেকেই কাউন্সিল আবার কার্যকর হলো৷''
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কিভাবে কাজ করে এবং এর গঠন কী জানতে চাইল মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘‘কোনো বিচারপতির অদক্ষতা, দুর্নীতি বা বিচারপতির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পেলে রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতিকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করতে বলবেন৷ প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে এই কাউন্সিলে আপিল বিভাগের একজন বিচারপতিসহ মোট তিন সদস্যের কাউন্সিল হবে৷ এই কাউন্সিলই অভিযোগের তদন্ত করবে, শুনানি করবে৷ আর যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেবে৷ এরপর তারা সিদ্ধান্ত দেবে যে অভিযোগটি সঠিক কিনা৷ তারপর রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মতামতের ভিত্তিতে ওই বিচারকের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন৷''
সংসদের হাতে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা থাকায় অসুবিধা কী ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘সংসদের হাতে থাকলে বিচার বিভাগের ওপর চাপ সৃষ্টি হতো৷ তারা পুরো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারতেন না৷ কারণ বাংলাদেশে সংসদ সদস্যরা শুধু আইন প্রণয়নই করেন না, তাঁরা নিজের নির্বাচনি এলকায় উন্নয়নমূলক কাজসহ নানা কাজে জড়িত৷ তাছাড়া উচ্চ আদালতে যত রিট বা মামলা হয়, তার অধিকাংশই এইসব কাজ নিয়ে৷ একজন সংসদ সদস্য চান যে রায় যেন তাঁর পক্ষে আসে৷ ফলে তা বিচার বিভাগের ওপর প্রভাব সৃষ্টি করতো৷ অথবা রায় কারুর বিপক্ষে গেলে সংশ্লিষ্ট বিচারপতিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া হতো৷ সংসদে অভিযোগ তুলে আলোচনাও শুরু হতো৷ ফলে বিচারকের স্বাধীনভাবে বিচার করা কঠিন হয়ে পড়তো৷''
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘এই রায়ের মধ্য দিয়ে সংসদের সার্বভৌমত্ব কোনোভাবেই ক্ষুণ্ণ হয়নি৷ এছাড়া সংসদের সার্বভৌমত্ব বলে কিছু নেই৷ বাংলাদেশের সংবিধান অনুয়ায়ী সার্বভৌম হলো জনগণ৷ অর্থাৎ স্বার্বভৌমত্ব জনগণের৷ সংসদ আইন প্রণয়ণ করবে আর সংবিধানের রক্ষক হলো সুপ্রিমকোর্ট৷ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বা যে কোনো আইনই সুপ্রিমকোর্ট বাতিল করে দিতে পারে৷''