1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

শ্রমিকনেতা হত্যায় ক্ষুব্ধ মার্কিন ক্রেতা জোট, তৎপর পুলিশ

১০ আগস্ট ২০২৩

গাজীপুরের টঙ্গিতে শ্রমিকনেতা শহীদুল ইসলামের মাথায় কিছু একটা দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করা হয়। এতে তার মাথার পেছনের অংশের একটি হাড় ভেঙে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই অজ্ঞান হয়ে পড়েন তিনি। এরপর হাসপাতালে মৃত্যু হয় তার।

https://p.dw.com/p/4V0gN
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবিছবি: Colourbox

হত্যাকাণ্ডের ৪৫ দিন পর বুধবার ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন দিয়েছে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ। সেখানে শহীদুলের মৃত্যুর কারণ হিসেবে এসব কথা উল্লেখ করা হয়েছে। শহীদুলের এমন মৃত্যুতে ক্ষুব্ধ মার্কিন ক্রেতা জোট।

যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক ও জুতা বিক্রেতা প্রায় এক হাজার কোম্পানির প্রতিনিধিত্বকারী একটি সমিতি বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের নেতা শহিদুল ইসলামের হত্যাকাণ্ডে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। দ্য আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশন (এএএফএ) নামের এই সংগঠন হত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় এনে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার আহবান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিজিএমইএকে চিঠি দিয়েছে।

বিদেশি ক্রেতা জোটের এমন প্রতিক্রিয়ায় নড়েচড়ে বসেছে তদন্তকারীরাও। থানা পুলিশের কাছ থেকে এই মামলার তদন্ত দেওয়া হয়েছে শিল্প পুলিশও বিজিএমইএকে। এজাহারে থাকা ৬ জনের মধ্যে ৫ জনসহ এ পর্যন্ত ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পুলিশের সাম্প্রতিক তৎপরতায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন মামলার বাদি বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি কল্পনা আক্তার। নিহত শহীদুল এই সংগঠনের গাজীপুর শাখার সভাপতি ছিলেন।

‘কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করতে পারলেই চার্জশিট দিয়ে দেবো’

১১ বছর আগে এই সংগঠনেরই নেতা আমিনুল ইসলাম খুন হয়েছিলেন। ২০১২ সালের ৪ এপ্রিল আশুলিয়া থেকে নিখোঁজ হওয়ার পরদিন তার ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া গিয়েছিল টাঙ্গাইলের ঘাটাইল থানা এলাকায়। তখনও বিদেশি ক্রেতা জোট এই হত্যাকান্ডের সুষ্ঠু বিচার দাবি করে সরকারকে চিঠি দিয়েছিল। ওই হত্যা মামলায় একজনের ফাঁসি হয়েছে। গত ২৫ জুন রাতে টঙ্গীর সাতাইশ বাগানবাড়ী এলাকায় হামলার শিকার হন শ্রমিক নেতা শহীদুল ইসলাম।

নিজের ফেডারেশনের একজন কর্মী ও অন্য দুই ফেডারেশনের দুই জন নেতাকে নিয়ে গত ২৫ জুন টঙ্গির প্রিন্স জ্যাকার্ড সোয়েটার লিমিটেডে যান শহীদুল। তার সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় শ্রমিক কর্মচারী পরিষদের গাজীপুর জেলা শাখার সভাপতি মো. মোস্তফা, জাতীয় নিট ডাইং গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের গাজীপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মো. শরীফ ও বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের কর্মী আক্কাস আলী।

আক্কাস আলী ডয়চে ভেলেকে বলেন, "ওই ফ্যাক্টরিতে বেতন ভাতা হচ্ছে না এমন খবর পেয়ে শহীদুল ভাইয়ের সঙ্গে আমরা তিনজন ফ্যাক্টরিতে যাই। সেখানে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলি। এক পর্যায়ে শহীদুল ভাই তাদের বলেন, আজকের মধ্যে বেতন না দিলে কালই আমরা কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরে অভিযোগ করব। গেট থেকে বাইরে বের হওয়া মাত্রই গেটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েক যুবক শহীদুল ভাইকে ডাক দেন। বেতন ভাতা নিয়ে বাড়াবাড়ি না করতে বলেন। ভাই প্রতিবাদ করলে তারা ভাইকে মারধর শুরু করেন। মোস্তফা ভাইকে রক্ষায় এগিয়ে গেলে তাকেও মারধর শুরু করে। এক পর্যায়ে আমরা দৌঁড়ে সেখান থেকে পালিয়ে যাই। তখন ওরা ভাইকে কীভাবে মারধর করেছে সেটা আমরা দেখিনি। তখনও ওরা ভাইকে মারধর করছিল। সেখান থেকে হাসপাতালে গিয়ে ভাইকে মৃত অবস্থায় দেখি।” আক্কাস আলী বলেন, "ওরা ওই ফ্যাক্টরির মালিক পক্ষের হয়েই এসেছিল বলে আমাদের মনে হয়েছে।”

হামলাকারীদের ভাড়া করেছিলেন কিনা? জানতে চাইলে প্রিন্স জ্যাকার্ড সোয়েটার লিমিটেডের মালিক মো. সাইফ উদ্দিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "ওরা যেদিন আমার ফ্যাক্টরিতে এসেছিল সেদিন আমার ফ্যাক্টরি প্রায় বন্ধ ছিল। আমেরিকা ও ইতালিতে ৮/১০ কোটি টাকা বায়ারদের কাছে পাওনা থাকায় আমি শ্রমিকদের বেতন দিতে পারছিলাম না। এমন কী বিদ্যুৎ বিল দিতে না পারায় বিদ্যুৎ সংযোগও বিচ্ছিন্ন ছিল। আমি তো ছিলাম না, আমার কোন কর্মকর্তাও ওইদিন ফ্যাক্টরিতে ছিলেন না। ২০-২৫ জন শ্রমিক তখন ভেতরে কাজ করছিল। শহীদুল সেখানে গিয়ে ওই শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে চলে যান। আমরা যেটা পরে জেনেছি। তিনি যে ফ্যাক্টরিতে এসেছেন সেটাই যদি না জানি তাহলে হামলাকারীদের ডাকব কীভাবে? আসলে আমি যেটা জেনেছি, আমাদের ওই এলাকায় ১৭টি শ্রমিক ফেডারেশন কাজ করে। একজনের জায়গায় আরেকজন গেলে তাদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এক্ষেতেও এমনটি হয়েছে বলে আমার ধারণা।”

‘কারখানা মালিকের সম্পৃক্ততা কী তা খুঁজে বের করতে হবে’

শহীদুল নিহত হওয়ায় ঘটনায় তার সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি কল্পনা আক্তার বাদি হয়ে টঙ্গি পশ্চিম থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। সেখানে তিনি ৬ জনের নাম উল্লেখ করেছেন। এছাড়া অজ্ঞাত আরও ৭-৮ জনের কথা বলেছেন। মামলার তদন্ত কী সঠিক পথে এগুচ্ছে? জানতে চাইলে কল্পনা আক্তার ডয়চে ভেলেকে বলেন, "বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তদন্ত যেভাবে এগুচ্ছে তাতে আমি সন্তুষ্ট। পুলিশ বেশ তৎপর। তবে একটা বিষয়ে এখনও আমাদের অসন্তুষ্টি আছে। সেটা হল, কামরুল নামের একজনের কথা আমরা বারবার পুলিশকে বলছি। কিন্তু পুলিশ তার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। কারণ ইন্ধনদাতাদের তো খুঁজে বের করতে হবে।”

কারখানা মালিক যে, ফেডারেশনের দ্বন্দ্বের কথা বলছেন, আসলে বিষয়টা কী? জানতে চাইলে কল্পনা আক্তার বলেন, "আমাদের ফেডারেশনগুলোর মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব নেই। একসঙ্গে পাঁচ জন সাংবাদিক কোন সংবাদ সংগ্রহে গেলে কী তাদের মধ্যে সংঘাত হবে। আর শহীদ তো একা যায়নি। তিনি আরও দু'টি ফেডারেশনের দুই জন নেতাকে সঙ্গে নিয়ে গেছেন। যাতে শ্রমিকদের পক্ষে মালিককে আরও বেশি চাপ দেওয়া যায়। আমরা তো বলছি, এই হামলার সঙ্গে কারখানা মালিকের সম্পৃক্ততা কী সেটাও পুলিশকে খুঁজে বের করতে হবে।”

কামরুলকে কী তদন্তের আওতায় আনা হয়েছে? জানতে চাইলে গাজীপুর শিল্প পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও মামলার তদন্ত তদারক কমিটির সভাপতি ইমরান আহম্মেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমাদের তদন্ত তো এখনও শেষ হয়নি। তদন্তের স্বার্থে যা করা প্রয়োজন সেটা আমরা করছি। কামরুলের ম্যানেজার হানিফকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দেখেন, কল্পনা আক্তার যে মামলা করেছেন, সেখানে তিনি আসামি হিসেবে ছয়জনের নাম উল্লেখ করেছেন। এখানে আসলে একজনের নাম দুইবার এসেছে। ৪ ও ৫ নম্বরে সোহেল রানা ও রিপনের নাম বলা হয়েছে। এটা আসলে একজন ব্যক্তি। অর্থাৎ এজাহারে থাকা ৫ জনকেই আমরা গ্রেপ্তার করেছি। এই পাঁচজনই কিন্তু আবার আরেকটি শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। এর বাইরে আরও ৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছি। এর মধ্যে ৫ জন আদালতে নিজেদের দোষ স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ”

শহীদুল হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাই কী গ্রেপ্তার হয়েছে? জানতে চাইলে ইমরান আহম্মেদ বলেন, "না, এখনও কয়েকজন বাকী আছে। তাদের গ্রেপ্তার করতে পারলেই আমরা চার্জশিট দিয়ে দেব।” শহীদুলকে কেন হত্যা করা হয়েছে? তদন্তে আপনারা কী পেয়েছেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, "এখন পর্যন্ত তদন্তে আমরা যেটা পেয়েছি সেটা হল, শ্রমিক সংগঠনের দু'টো বিষয়। ফেডারেশনগুলোর এলাকা ভাগ করা আছে। একজন আরেকজনের এলাকায় ঢোকা একটা বিষয়। আরেকটা হল, স্থানীয় প্রভাবশালীর সম্পৃক্ততার বিষয় আছে। সেটাও আমরা পেয়েছি। এখানে আধিপত্যের একটা বিষয় আছে।”

এই হত্যা মামলার প্রধান আসামি মো. মাজাহারুল বাংলাদেশ পোশাক শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের টঙ্গী পশ্চিম থানার সাধারণ সম্পাদক। অপর আসামিদের মধ্যে আকাশ আহমেদ একই সংগঠনের গাজীপুর জেলার সহসভাপতি। সোহেল রানা ওরফে রিপন ওই শ্রমিক সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক। রাসেল এই সংগঠনেরই কর্মী।

এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর কাছে পাঠানো চিঠিতে এএএফএ বলেছে, এই হত্যাকাণ্ড কেবল শহীদুলের পরিবারের জন্য অপূরণীয় ক্ষতিই নয়; বরং বাংলাদেশের শ্রমিকদের অধিকার ও তাদের সামগ্রিক কল্যাণ পরিস্থিতির অবনতির লক্ষণ। বাংলাদেশে শ্রমিক ইউনিয়ন ও নেতাদের ওপর যেভাবে একের পর হামলা করা হচ্ছে, শহীদুল হত্যাকাণ্ড তার সবচেয়ে নিকৃষ্ট নজির। এ ক্ষেত্রে এএএফএ মার্কিন সরকারের সঙ্গে একই সুরে দোষীদের বিচারের আওতায় এনে এই হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার আহবান জানিয়েছে। সেই সঙ্গে বিচারের মধ্য দিয়ে কঠোর বার্তা দেওয়ার কথা বলেছে তারা, সেটা হলো, এ ধরনের ঘৃণ্য কাজ সহ্য করা হবে না। তারা মনে করে, শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় ইউনিয়ন গঠনের অধিকার থাকা জরুরি। সেই সঙ্গে যথাযথ শ্রম পরিবেশ এবং বৈরিতামুক্ত শ্রমিক-মালিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি।

ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি সমীর কুমার দে৷
সমীর কুমার দে ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি৷