রাজবাড়িতে সম্রাট শাজাহান
৪ নভেম্বর ২০১৩কবি এবং গীতিকার হিসেবে খ্যাত দ্বিজেন্দ্রলাল রায় সম্ভবত সবথেকে জনপ্রিয় ছিলেন নাট্যকার হিসেবে৷ যদিও রবীন্দ্রসংগীত এবং নজরুলগীতির পাশাপাশি দ্বিজেন্দ্রগীতিও সর্বজনের মধ্যে যথেষ্ট চর্চিত এবং আদৃত একটি সাংগীতিক ধারা৷ দ্বিজেন্দ্রলাল, যিনি ডিএল রায় নামেই সমধিক পরিচিত ছিলেন, তাঁর রচিত ‘ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা' অথবা ‘বঙ্গ আমার জননী আমার' গানগুলি বাংলায় লেখা অন্যতম সেরা দেশাত্মবোধক গানের মর্যাদা পায়, যেখানে তিনি আমাদের এই বাংলার জয়গান গেয়েছেন৷ কিন্তু লোকপ্রিয়তায় তাদেরকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে ডিএল রায়ের লেখা নাটক, বিশেষত ঐতিহাসিক নাটক৷ তাঁর লেখা শাজাহান, মেবার পতন বা চন্দ্রগুপ্ত বাংলা নাটকের ইতিহাসের এক একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে স্বীকৃত৷
কাজেই ডিএল রায়ের জন্ম সার্ধশতবর্ষ পালন করতে গিয়ে তাঁর লেখা একটি নাটক, এক্ষেত্রে শাজাহান যে বেছে নিয়েছিলেন শোভাবাজার রাজ পরিবারের সদস্যরা, সেটা নেহাতই স্বাভাবিক এক নির্বাচন৷ তবে উল্লেখযোগ্য যেটা, তা হলো উত্তর কলকাতার রাজা নবকৃষ্ণ দেবের পুত্র রাজা রাজকৃষ্ণ দেবের প্রাসাদতুল্য বাড়ির ঐতিহাসিক ঠাকুর দালানে এই নাটকের অভিনয়৷ অবশ্য একেবারে ঠাকুরদালানের উপরে নয়, গৃহদেবতা গোপীনাথ জিউ-র প্রতি সম্মানহেতু, ঠাকুরদালানের সামনেই অস্থায়ী মঞ্চ বেঁধে অভিনীত হলো ডিএল রায়ের শাজাহান৷ অভিনয় করলেন রাজপরিবারের পুরুষ এবং মহিলা সদস্যরা৷ তবে মহিলা বলতে কেবলই এই রাজবাড়ির বিবাহিতা অথবা অনূঢ়া কন্যাসন্তানেরা৷ রাজবাড়ির বউয়েরা পারিবারিক রীতি মেনে এ নাটকের নেপথ্য-সহযোগী হিসেবেই থেকে গেলেন৷
অবশ্য পারিবারিক রীতির কথা বলা হলেও, ১২ বছর আগে কিন্তু একবার এই রীতি ভাঙা হয়েছিল৷ সেবার বাড়ির বউয়েরাও, যাঁদেরকে প্রথামাফিক বৌরানি বলেই সম্বোধন করা হয়, তাঁরা কেউ কেউ অংশ নিয়েছিলেন বাড়ির বাৎসরিক নাটকে৷ সেই নিয়ে রীতিমত হুলুস্থুল হয়েছিল রাজবাড়ির ভিতরে ও বাইরে৷ যদিও ফিবছর বিজয়া সম্মিলনী উপলক্ষ্যে বাড়ির সদস্যদের নাটক করার রেওয়াজ শোভাবাজার রাজবাড়িতে বহুদিনের৷ ইতিহাস বলে, দুর্গাপুজো উপলক্ষ্যে শোভাবাজারের রাজারা চার দিন ধরে যে উৎসব, নাচ-গানের আয়োজন করতেন, তা ছিল তাক লাগানো৷ স্থানীয় সম্ভ্রান্তবংশীয়রা তো অবশ্যই, এমনকি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পদস্থ সাহেব-সুবোরা আমন্ত্রিত থাকতেন সেই অনুষ্ঠানে৷ কিন্তু বিজয়া সম্মিলনী উপলক্ষ্যে রাজবাড়ির সদস্যদের নাটক ছিল সেই জাঁকজমকের থেকে আলাদা, একেবারেই পারিবারিক পুনর্মিলন উৎসব৷
কিন্তু সেইসব পারিবারিক নাটকে রাজবাড়ির বৌরানিদের ভূমিকা ছিল দর্শকের৷ নাটকের নারী-চরিত্রগুলিতে অভিনয় করতেন বাড়ির ছেলেরাই৷ সেটাই তখন রীতি ছিল৷ যেমন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে এরকমই পারিবারিক নাটকের নারীচরিত্রে অভিনয় করতেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর৷ পরবর্তী সময়ে, যখন মহিলারাই নারী চরিত্রে অভিনয় করছেন, তখন শোভাবাজার রাজবাড়িতেও বাড়ির মেয়েরা অভিনয় করেছেন দু-একবার, কিন্তু সেই অনুমতি ছিল না বাড়ির বউদের জন্য৷ ২০০১ সালে প্রথম সেই নিয়মের ব্যাতিক্রম ঘটানো হয়৷ সেবার অভিনীত হয়েছিল নটী বিনোদিনী, যে নাটকে বিনোদিনী-সহ অনেক নারী চরিত্রেই দেব বাড়ির বৌরানিরা অভিনয় করেছিলেন৷
রাজবাড়ির প্রথাভাঙা ওই নাটক যেমন বাড়ির অন্দরমহলে বিতর্কের ঝড় তুলেছিল, তেমন ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছিল বহিরাগত দর্শকদের কাছে৷ প্রথম অভিনয়ের পর একাধিক কল শো-এর আমন্ত্রণ এসেছিল৷ যদিও সেই আমন্ত্রিত অভিনয়ে আর বাড়ির বউয়েরা অভিনয় করেননি, কিন্তু সাফল্য তাতে আটকায়নি৷ রামকৃষ্ণ মিশন আয়োজিত অনুষ্ঠানে শোভাবাজার রাজবাড়ির সদস্যদের অভিনীত নটী বিনোদিনী যে টিকিট বিক্রির অর্থ সংগ্রহ করেছিল, তা দান করা হয়েছিল সেসময় ওড়িশার ঘূর্নিঝড় আক্রান্তদের সাহায্যার্থে৷ সেই শেষ সমবেত অভিনয় রাজ পরিবারের সদস্যদের৷
কাজেই এক যুগ আগে নটী বিনোদিনী নাটকে সমবেত অভিনয়ের পর আবার এই ২০১৩ সালে ডিএল রায়ের শাজাহান৷ আত্মীয়-স্বজন মিলিয়ে প্রায় শতিনেক মানুষ, সঙ্গে তাঁদের বন্ধু-বান্ধব৷ শোভাবাজার রাজবাড়ির প্রশস্ত উঠোনে বসে সবাই নাটক দেখলেন৷ ভাল দৃশ্য বা তুখোড় অভিনয়ের শেষে শুধু হাততালি নয়, সাবেকি কায়দায় আওয়াজ উঠল, এনকোর... এনকোর! শখের অভিনেতাদের মুন্সিয়ানা দেখে তারিফ করলেন দর্শকরা, কেয়াবাৎ! এবারেও অভিনয়ের শেষে আমন্ত্রিত অভিনয়ের বরাত এসেছে বাইরে থেকে৷ রাজ পরিবারের সদস্যরা ঠিক করেছেন, এবারেও ওরা যাবেন৷ এবং একটি প্রচলিত প্রথা ভেঙে চালু করবেন নতুন প্রথা৷ বাড়ির মেয়েরা, যাঁরা অভিনয় করলেন এবার শাজাহান নাটকে, বাইরের অভিনয়েও তাঁরাই থাকবেন৷ একুশ শতকের পক্ষে সেটা একটা মানানসই পদক্ষেপ হবে বইকি!