শুধু বিধিনিয়ম কড়াকড়ি করে কি লাভ?
১১ জানুয়ারি ২০২১আমাদের এলাকার এক জার্মান দম্পতি, তারা এলাকার নানা সমাজকল্যাণমূলক কাজের সাথে জড়িত থাকায় প্রায় সকলের কাছেই পরিচিত মুখ৷ তাদের তিন ছেলে আর এক মেয়ে সবাই যার যার নিজেদের সন্তানদের নিয়ে আলাদা থাকে৷ তবে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের জন্মদিন , বড়দিন বা পারিবারিক যে কোন উৎসবে পুরো পরিবার একসাথে হয়, এটাই ওই পরিবারের রীতি৷ কিন্তু করোনার ভয়াবহতার কারণে এবার বড়দিনে সন্তানদের সবাই মা-বাবার বাড়িতে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়৷ তবে দেখা হোক সবাই চেয়েছে৷ বড় ছেলে রোম থেকে উড়ে এসেছিলো ঠিকই কিন্তু বাড়িতে থাকেনি৷ শেষ পর্যন্ত পরিবারের সকলে মিলে বাড়ির কাছাকাছি বিশাল এক পার্কে দেখা করেছে, নাতি নাতনি বা ছেলে মেয়েরা কেউ কাউকে জড়িয়ে ধরেনি, শুধুই চোখের দেখা৷ মুক্ত বাতাসে দূরত্ব বজায় রেখে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি আর গল্প-এই টুকুই ছিলো বড়দিনের আনন্দ! করোনা কতটা ভয়ঙ্কর যা এতো বছরের ঐতিহ্যকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে৷ তবে পরিবারের সবাই আশাবাদী যে আগামী বড়দিন আবার আগের মতোই সুন্দর হবে৷
করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহতা ঠেকাতে জার্মানিতেলকডাউনের নিয়মে আরো কড়াকড়ি শুরু হলো সোমবার থেকে৷ বড়দিন এবং নববর্ষের ছুটির সময়ে অনেকেই নিয়ম না মেনে মেলামেশা করায় পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি৷ আর তা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই জার্মান চ্যান্সেলর ম্যার্কেল খুবই উদ্বিগ্ন এবং কড়াকড়িও বাড়ছে৷ করোনার প্রথম ঢেউ জার্মানি খুব ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলো, আর এটা নিয়ে অন্যান্য দেশে থাকা আমার কাছের মানুষেরা যখন প্রশংসা করতো তখন খানিকটা গর্ব বোধ হতো বৈকি! তবে এখন কেমন যেন সব গুলিয়ে যাচ্ছে৷
যাই হোক গতকাল ছিলো আমাদের প্রতিবেশি জো জুন্ডাকেম্পারের ৮৫তম জন্মদিন, জুন্ডাকেম্পার দম্পত্তি আমাদের প্রতিবেশিদের সকলেরই প্রিয়৷ তাদেরকে অনেকটা লিডার বলা যায়, তারা সকলের সাথে যোগাযোগ রাখেন এবং সবার সুখে দুঃখে পাশে দাড়ান ৷ বছরে কয়েকবার সকলেই যেন একসাথে মিলিত হতে পারে তার আয়োজনও তারাই করে থাকেন ৷ একজন মানুষের ৮৫ বছর বয়স শুনলে যেমনটা মনে হয় তাদের ক্ষেত্রে মোটেই তেমনটা নয়৷ শারীরিক এবং মানসিক দিক থেকে দুজনেই গর্ব এবং হিংসে করার মতো স্মার্ট এবং ফিট৷
এই পাড়ার রীতি যাদের বয়স ৬৫-র ওপরে তাদের জন্মদিনে ১০/১২টি প্রতিবেশি পরিবার একত্রিত হয়ে বেলা ১১টায় বার্থডে গার্ল বা বয়ের বাড়ির সামনে দাড়িয়ে তাকে হ্যাপি বার্থডে গান গেয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয়৷ করোনার কারণে গতকাল আমার ১০ বছরের দেখা নিয়মের ব্যতিক্রম হলো ৷ মাস্ক পরে এবার সবাই আলাদাভাবে যার যার মতো করে বাড়ির ভেতরে না ঢুকে দূর থেকে ফুল বা মদের বোতল দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছে প্রকৃতিপ্রেমী প্রিয় মানুষটির জন্মদিনে৷ আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজন জো-কে ফুল হাতে শুভেচ্ছা জানাতে গেলে জো দরজা খুলে অতি বিনয়ের সাথে শুধু বললো, এবার তো কিছুই করা হচ্ছে না৷ আর রিটা ঘরের ভেতর থেকে জোরে জোরে বললো, ‘‘করোনার পরে অনেক বড় করে পার্টি করবো, আমরা সবাই মিলে অনেক অনেক অ-নে-ক আনন্দ করবো৷'' রিটার গলার কাঁপন শুনে আমিও কিছুটা ইমোশোনাল হয়ে যাচ্ছিলাম, আসলে বিদেশের মাটিতে ওরাই তো আমাদের আপনজন! এখানেই শেষ নয়, মেয়ে অন্তপ্রাণ এই দম্পতি ৷ তাঁদের মেয়ে স্বামী সন্তান নিয়ে বন শহরেই থাকে এবং প্রায়ই আসে , কিন্তু এবার বাবার জন্মদিনে তাকেও আসতে নিষেধ করা হয়েছে৷ মেয়ে হয়তো অতটা নিষ্ঠুর হতে পারেনি, তাই সে বিকেলে ঠিকই বাবার পছন্দের কেক বানিয়ে নিয়ে এসেছে৷ বাড়িতে না ঢুকে বাইরে থেকে বাবার হাতে কেকটি তুলে দিয়ে আবার গাড়িতে উঠে চলে গেছে! আমার পরিচিত এরকম অনেকেই আছেন, যাদের এই ত্যাগকে আমি স্যালুট জানাই৷ বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধু এদের মতো অল্পকিছু মানুষ সচেতন হলে কি হবে, যার যার অবস্থান থেকে সকলকেই যে মানতে হবে এ নিয়ম৷ করোনার আগমন প্রায় এক বছর হতে চললো, এতোদিনে করোনাকে যতটুকু বুঝলাম, তিনি নাছোড়বান্দা!
আজ স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইয়েন্স স্পান জার্মানির টিভি চ্যানেল জেডডিএফ কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘‘মানুষ যদি ব্যক্তিগতভাবে মেলামেশা করেই, তাহলে আর দোকানপাট বা স্কুল বন্ধ রেখে তো কোন লাভ নেই৷'' প্রয়োজনে খোলা জায়গায় গিয়ে বা জানালা দিয়ে বাইরের কারো সাথে কথা বলার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি৷
গতকালের হিসেব পর্যন্ত জার্মানিতে মৃত্যুর সংখ্যা ৪০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে, ১৯ লাখেরও বেশি করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা৷ কাজেই মানুষ যদি এখনো সচেতন না হয়, তবে কবে হবে? বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে সকলে আরও একটু বেশি সচেতন না হলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাড়াবে, কে জানে!