শিশু সাহিত্য ও বই পড়ার সংস্কৃতি
৩০ জানুয়ারি ২০১৮টমটম আর বুড়ো বুদ্ধের গল্প৷ আমার পড়া প্রথম গল্পের বই৷ মফস্বলের কিণ্ডার গার্টেন স্কুলে প্রথম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় তৃতীয় হবার পুরস্কার৷ সেইদিনটির কথা খুব আবছা হলেও মনে আছে৷ গাঢ় সবুজ রঙের প্যান্ট আর সাদা শার্টের ইউনিফর্ম পরে দীঘির পাড় ধরে স্কুল থেকে অনেকটা দৌঁড়েই ফিরি বাড়িতে৷ জামা জুতো খুলে এরপর অন্য কিছু ভাববার সময় কোথায়?
বই নিয়ে উঠোনে, কাঠের চেয়ারে বসে পড়তে শুরু করি৷ পাশের বাড়ির আমগাছের ঘন পাতাগুলোর ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো গোল গোল করে আমার গায়ে পড়ে, পড়ে ছবি আর হরফে সাজানো বইয়ের পাতায়৷
পরীক্ষা শেষ৷ বাড়ির কাজ করার তাড়া নেই৷ আমি ছুটে চলি টমটমের সঙ্গে, কোনো দুঃসাহসিক অভিযানে৷ বইয়ের সঙ্গে সেই যে সখ্যতা, সেই যে বন্ধুত্ব, তা এখনো রয়ে গেছে৷ আমরা কেউ কাউকে ছাড়িনি৷
আমাদের পাড়ায় একটা বইয়ের দোকান ছিল৷ বই ভাড়া পাওয়া যেত৷ সপ্তাহে এক টাকা করে বোধ হয়, ঠিক মনে নেই৷ বাড়ির বড়রা আমায় পাঠাতেন বইয়ের নাম লিখে৷ বড়দের বই ছিল আলাদা৷ ওখানে প্রেম ভালোবাসার কথা লেখা থাকতো৷ ওসব আমার পড়া বারণ৷
আমি পড়তাম তিন গোয়েন্দা, বড়জোর দস্যু বনহুর৷ পাঠ্যবইয়ে সুকুমার রায়, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ফররুখ আহমদসহ বিখ্যাত সব কবি লেখকদের লেখা পড়তে পাই৷
এরপর বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের পাঠচক্রে পূর্ব ও পশ্চিমের সাহিত্যিকদের খুঁজে পাই৷ আস্তে আস্তে দেশ-বিদেশের কালজয়ী সব লেখার সঙ্গে পরিচয় হয়৷
এতকিছু বলার একটাই কারণ, আমার শিশুবেলায় সাহিত্যের সঙ্গে সখ্য, গল্পের প্রতি আগ্রহ, সম্ভবত বাড়ির বড়দের কাছে গল্প শুনে শুনে৷ কিন্তু সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিতি একেবারেই ছন্নছাড়াভাবে৷ যেটা যখন পেয়েছি, পড়েছি৷ এর কারণ বোধ করি, শিশু সাহিত্য পড়ার একটা স্বাভাবিক সংস্কৃতি নেই আমার বাংলাদেশে৷ অন্য দেশেরটা অত জানি না৷
কিন্তু তার বড় দরকার৷ পাঠ্যসূচিতে যা আছে, তা তো পড়বেই শিশুরা৷ কিন্তু তা যতটা না আগ্রহ, তার চেয়ে পরীক্ষার খাতায় কতটা উগড়ে দেয়া যায় সেই প্রতিযোগিতা৷ যেমন এখনকার শিশুরা৷ স্কুলের পড়া পড়তে পড়তে এদের সময় কোথায় গল্পের বই পড়ার৷
আমাদের সময়ও এতটা ছিল না৷ ঐ যে খাটের নিচে শুয়েও বই পড়েছিলাম, সেটা তো আজও জানে না বাড়ির লোকেরা৷
সেই আগ্রহটা কোথায় এখনকার শিশুদের? ওরা খাটের নীচে গিয়ে বড়জোর গেমস খেলে মোবাইলে৷ অথবা বন্ধুদের সঙ্গে সেল্ফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট দেয়৷ লাইক তো পেতেই হবে৷
বাংলায় শিশুসাহিত্যের ক্লাসিকগুলো অনেক সমৃদ্ধ৷ কিন্তু সেইসঙ্গে এ যুগের শিশুদের জন্যও সমৃদ্ধ সাহিত্য প্রয়োজন৷ তার কতটা আছে সেখানে?
একুশের বইমেলা ঘুরলে কিছুটা আঁচ করা যায় যে, শিশুদের জন্য কেমন লেখা আসছে বাজারে৷ বইমেলা চলাকালীন ছুটির দিনগুলোতে শিশুপ্রহর করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ৷ তাই শুক্র ও শনিবার সকালগুলোতে শিশুদের বেশ ভিড় হয়৷
১০ বছরের নীচের শিশুরা মূলত ছবি দেখে বই পছন্দ করে৷ আর সেই বইগুলোর অনেকগুলোই এতটাই নিম্নমানের যে, তাকে সাহিত্য বলতে রুচিতে বাঁধবে৷
শিশুদের জন্য প্রকাশিত বইয়ে বানানসহ যে কোনো ধরনের ভুল অমার্জনীয় অপরাধ, যেটি হরহামেশাই করা হয়ে থাকে৷ এছাড়া টেক্সটের সঙ্গে মিল নেই ছবির৷ ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করা হচ্ছে ছবি৷ কিছু টেক্সট দিয়ে ছাপিয়ে দিচ্ছে৷ ব্যবসাও হচ্ছে ঢের৷ কিন্তু ক্ষতি যা হচ্ছে আমাদের শিশুদের৷
এছাড়া বইমেলায় সিডিও পাওয়া যায়৷ আজকাল পড়তে চায় না কেউই৷ সবাই ভিডিও দেখতে চায়৷ তাই সারা পৃথিবীতে ভিডিওর এত কদর৷ তাই এরও কাটতি ভালো৷
কিন্তু এ সবের মাঝেও যে ভালো কাজ নেই, তা নয়৷ সবকিছুর ওপরে শিশুর পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি৷ বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র যা করে আসছে কয়েক যুগ ধরে, স্কুলগুলোতেও তা করা উচিত৷ নিয়ম করে শিশুকাল থেকেই পাঠ্যসূচির বাইরের শিশু সাহিত্য পড়তে উদ্বুদ্ধ করা দরকার৷ প্রযুক্তির এই যুগে তো আরো বেশি করে করা দরকার৷ তাহলেই হয়ত একটা বই পড়ার সংস্কৃতি বহাল থাকবে, যা জাতির মননকে সমৃদ্ধ করবে৷
আয় যেখানে খ্যাপার গানে
নাইকো মানে নাইকো সুর৷
আয়রে যেথায় উধাও হাওয়ায়
মন ভেসে যায় কোন্ সুদূর৷
শিশুর মন যদি মোবাইল, ল্যাপটপ, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে কোন সুদূরে ভেসে না বেড়ায়, তাহলে টমটমের গল্প গল্পই থেকে যাবে৷ বাস্তবে টমটমদের খুঁজে পাওয়া যাবে না৷
লেখাটি নিয়ে কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷