‘শিক্ষকদের সাথে রীতিমতো অসভ্যতা করা হয়েছে’
৩০ আগস্ট ২০২৪ডয়চে ভেলে: দেশের বিভিন্ন এলাকায় কিছু শিক্ষার্থী শিক্ষকদের অপমান, অপদস্থ করছেন৷ তাদের পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে৷ উপাচার্যদের পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে৷ এই ঘটনাগুলো আপনি কীভাবে দেখছেন?
মোহাম্মদ মজিবুর রহমান: আমার কাছে মনে হচ্ছে, এটা ভালো প্র্যাকটিস না৷ এটা আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না৷যে শিক্ষার্থীরা এই কাজ করছেন, তারা শিক্ষকদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে এগুলো করছেন৷ তবে আমি মনে করি, অভিযোগ থাকলে তারা অভিযোগ করতে পারেন৷ বিচার চাইতে পারেন৷ কিন্তু তারা শিক্ষকদের অপমান, অপদস্থ করছেন৷ আমাদের এখানে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের যে সংস্কৃতি তার সঙ্গে এই ঘটনাগুলোকে মেলানো যায় না৷
অভিযোগ থাকতে পারে৷ কিন্তু শিক্ষদের টেনে হিঁচড়ে বের করা৷ তাদের গায়ে হাত দেয়া৷ এগুলো কীভাবে নেবেন?
এই ঘটনাগুলো বেদনাদায়ক, অনাকাঙ্খিত এবং অনুচিত৷
এখন এসে শিক্ষা উপদেষ্টা এব্যাপারে কথা বলছেন৷ প্রধান উপদেষ্টাও বলছেন৷ কিন্তু এত দেরিতে কেন?
এটা কোনো রেগুলার সরকার না৷ অন্তর্বর্তী সরকার৷ ফলে তাদের বুঝতে সময় লেগেছে৷ রিআ্যক্ট করতে সময় লেগেছে৷ তারা সময়মতো এ ব্যাপারে রিঅ্যাক্ট করতে পারেনি, ব্যবস্থা নিতে পারেনি৷ তাদের তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিল৷ আমি মনে করি, এই ধরনের ঘটনা ঘটার আগেই তাদের সতর্ক হওয়া দরকার ছিল৷ আর শুরুতেই কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার ছিল৷
শিক্ষার্র্থীরা নিজেরাই দায়িত্ব হাতে তুলে নিলো৷ তারা কোনো শিক্ষককে বিদায় করছে, পছন্দের কাউকে বসাচ্ছে৷ এতে তাদের মানসিক অবস্থার এক ধরনের পরিবর্তন হচ্ছে৷ তার কী হবে?
এটা শুধু শিক্ষার্থীদের ওপর নয়, শিক্ষকদের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে৷ তারা মনে করবে যে, বাচ্চাদের আমি এতদিন ধরে পড়ালাম, তারা আমার সাথে এইরকম ব্যবহার করছে৷ আমার সাথে না করলেও আমার সহকর্মীর সঙ্গে করছে৷ ফলে ছাত্র- শিক্ষকের যে সম্পর্ক আমাদের দেশে, তার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে৷ তাই এটা দ্রুত বন্ধ করা এবং যা ক্ষতি হয়েছে তা আবার রিপেয়ার করা দরকার৷
এটা কীভবে রিপেয়ার হবে? প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘‘ছাত্ররা আমাদের নিয়োগ দিয়েছে৷'' ছাত্ররা মনে করছে, তারাই এখন দেশ চালাচ্ছে৷ এই মানসিকতার পরিবর্তন কীভাবে হবে?
আসলে ‘আমরা দেশ চালাচ্ছি'- এমন ভাব, ছাত্ররা আমাদের নিয়োগ দিয়েছে৷ এগুলো কোনো কংক্রিট বিষয় নয়৷ মূল বিষয় হলো, সরকারের অ্যাপ্রোচ৷ তার ওপরেই আসলে অনেক কিছু নির্ভর করে৷ এখন ছাত্ররা যদি মনে করে, ‘‘আমরা দেশ চালাচ্ছি৷ আমাদের মতো করেই সব কিছু হবে, তাহলে কিন্তু তারা এক ধরনের অথোরাইজেশন পেয়ে যাচ্ছে৷ কিন্তু দিন শেষে তো রাজনীতিবিদরাই দেশ চালাবেন৷ মিনিমাম যে সংস্কার দরকার সেটা শেষ করে নির্বাচনের মাধ্যমে দ্রুত নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন এই মেসেজটা যদি তারা পরিস্কার করে দেন, তাহলে তার একটা প্রভাব শিক্ষার্থীদের ওপর পড়বে৷ শিক্ষার্থীরা বুঝবেন তাদের জায়গা হলো ক্লাসরুম৷ যে শিক্ষকরা নিপীড়ন করেছেন, নিশ্চয়ই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে৷
সেই ব্যবস্থা নিশ্চয়ই ছাত্ররা নিতে পারেন না..
না, অবশ্যই না৷ তারা অভিযোগ করতে পারেন, ব্যবস্থা নেবে শিক্ষা প্রশাসন বা সরকার৷
আপনি কি খেয়াল করেছেন, এখানেও ছাত্রদের পিছনে কিছু শিক্ষক আছেন, যারা শিক্ষার্থীদের উসকানি দিয়েছেন, তাদের স্বার্থে ছাত্রদের ব্যবহার করেছেন৷
এটা যে একেবারে দেখিনি, তা নয়৷ তবে পরিস্কার কোনো এভিডেন্স আমার কাছে নাই, কোথাও যে সরসরি শিক্ষকরা উসকানি দিয়েছেন বা ছাত্রদের অন্য শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছেন, তার প্রমাণ আমার কাছে নেই৷ তবে শোনা যাচ্ছে৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে বিভিন্ন রকম কমিটি আছে, তাদের দ্বন্বেও হতে পারে৷
৫০টির মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি পদত্যাগ করেছেন৷ আবার বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ক্লাশও হচ্ছে না, ছাত্ররা ক্লাসে ফেরেনি৷ শিক্ষায় অচলবস্থা সৃষ্টি হয়েছে৷
আসলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে একরকম আবার দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুল, কলেজে যা হয়েছে, তা আরেক রকম৷ দুইটিকে এক করে দেখার সুযোগ নেই৷ আমরা জানি যে, উপাচার্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়৷ আবার রাজনৈতিক বিবেচনায় উপাচার্য নিয়োগ দেয়া হলেই যে, তারা সবাই খারাপ, তা কিন্তু আমি বলছি না৷ কিন্তু এখন একটা ন্যারেটিভ দাঁড় করানো হয়েছে যে, রাজনৈতিক বিবেচনায় উপাচার্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে৷ ফলে ভালো ভালো অধ্যাপকরা উপাচার্য হতে পারেননি৷
বর্তমান সরকার নন-পলিটিক্যাল৷ তবে এখন পর্যন্ত যে কয়জনকে নতুন উপাচার্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তারা কি নন-পলিটিক্যাল?
দেখুন মানুষ তো রাজনৈতিক জীব৷ প্রত্যেকটা মানুষের একটা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে৷ তবে দলের হয়ে সে যদি পলিটিক্যাল এজেন্ডা বাস্তবায়ন না করে, তাহলে আমি কোনো সমস্যা দেখি না৷
ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের যে গলদ তৈরি হলো, সেটা কি কাটবে? কাটবে কীভাবে?
প্রথম কথা হলো, যা হচ্ছে তা ভালো হচ্ছে না৷ এগুলো বন্ধ করে খালি জায়গায় যোগ্য লোককে বসাতে হবে৷ ওই যোগ্য লোকগুলোই চেষ্টা করলে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের যে ঘাটতি হয়েছে, তা মেরামত করতে পারবেন৷ আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে৷ ন্যাশনাল ফেলো ফিলিং হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরে৷ এই যেমন, ছাত্ররা প্রাথমিকভাবে ত্রাণ দিচ্ছেন৷ উদ্যোগটা ভালো৷ প্রাথমিক পর্যায়ে তারা এটা করতে পারে৷ কিন্তু ত্রাণ দেয়া তো তাদের কাজ না৷ আমাদের একটা ত্রাণ মন্ত্রণালয় আছে৷ নানা বাহিনী আছে৷ ঠিক আছে, ওরা প্রাথমিকভাবে ত্রাণ সংগ্রহ করেছে৷ এখন সরকারের লোকজন তাদের কাছ থেকে নিয়ে বিতরণ করবে৷ এখন দরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া, তাদের ক্লাসে ফেরা দরকার৷ লেখাপড়া শুরু করা দরকার৷ শিক্ষার্থীদের দিয়ে এসব করানো দরকার নেই৷ এই যে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ এগুলো তো তাদের কাজ না৷
একটি জেনারেশনের মধ্যে কি ক্লাস বা শ্রেণি বিমুখতা তৈরি হচ্ছে বা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা আছে?
তারা যদি দীর্ঘদিন শিখণ কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে , অলরেডি কিন্তু তারা তিন মাসের মতো বিচ্ছিন্ন৷ একটা লার্নিং গ্যাপ কিন্তু তৈরি হয়ে গেছে৷ আমি মনে করি, খুব দ্রæত এটার দিকে নজর দেয়া দরকার৷ খুব দ্রুত তাদের ক্লাসে ফেরত নেয়া দরকার৷
শিক্ষকদের যেভাবে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে, তাতে তারা কি সার্ভিস বেনিফিট থেকে বঞ্চিত হবেন? চাকরি চ্যুত করলে তো বেনিফিটসহ করা হয়৷
এটা আসলে নির্ভর করে তিনি কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন, তার চাকরির বয়স কত, তার ওপর৷ কিন্তু এভাবে গায়ে হাত দিয়ে, টেনেহিঁচড়ে পদত্যাগ করানো এটা তো বৈধ না৷ এটা তো রীতিমতো অসভ্যতা৷ এটা সরকারকে দেখতে হবে ৷ তদন্ত করতে হবে৷ আমরা আহাজারি শুনেছি মেধাবীরা শিক্ষকতায় আসছেনা, এখন তো আরো আসবেনা৷ কারণ অপমান অপদস্থ করে শিক্ষকদের বের করে দেয়া হয়৷ আশঙ্কা তো থেকেই যায়৷
যারা শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলেছেন, টেনে নামিয়েছেন- তাদের বিরুদ্ধে কি আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যায়?
আমি মনে করি, অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেয়া উচিত৷ গায়ে হাত দেয়া, অপদস্থ করা এগুলো ফৌজদারী অপরাধ৷
ব্যবস্থা নিলে কী হবে?
আমি আগেই বলেছি সরকারের অ্যাপ্রোচটা গুরুত্বপূর্ণ৷ কয়েকটি দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিলে জাতীয় পর্যায়ে এর প্রভাব পড়বে, এই ধরনের ঘটনা বন্ধ হবে৷ তবে ছাত্রদের ওপেন রেখে এই ব্যবস্থা নিলে তার আবার রিঅ্যাকশন হতে পারে৷ আগে ছাত্রদের শ্রেণি কক্ষে ফেরত নিতে হবে৷ তারপরে ব্যবস্থা নেয়ার কথা ভাবতে হবে৷