শহরকে শিশুর বাসযোগ্য করতে...
১ ফেব্রুয়ারি ২০২১কলকাতার বিত্তবান অথবা বর্ধিষ্ণু এলাকা যেগুলো, সেখানে দেখা যেতো ওদের। বিশেষ করে যেখানে বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা বেশি, সেই জায়গায়। শ্বেতাঙ্গদের দেখলেই পিছু নেয় এই বাচ্চারা। ঘ্যানঘ্যান করতে থাকে বিদেশি চকলেট, খাবার, অথবা পাউন্ড–ডলারের জন্য! হ্যাঁ, কাদের কাছে কী ভিক্ষে চাইতে হবে, সেটা ওরা ভালোমতোই জানে। ওদের শিখিয়ে পড়িয়ে দেওয়া হয়। তার জন্য রীতিমতো ‘পাঠশালা' আছে, যেখানে ওদের তালিম চলে। ঠিক যেমন শপিং মল, কিংবা অ্যামিউজমেন্ট পার্ক থেকে বেরোলে আমোদপ্রিয় মানুষজনের আত্মদংশন বাড়িয়ে, তাদের আত্মধিক্কারে ভরিয়ে দিতে, ভিক্ষের হাত পেতে বসে থাকে ‘বিপন্ন' কোনো মা, ঘুমন্ত শিশু কোলে! বিভিন্ন এনজিও এবং অবশ্যই পুলিশের কাছে কিন্তু খবর থাকে, এই করুণ দৃশ্যগুলো আসলে সযত্নে সাজানো। ওই কোলে ঘুমিয়ে থাকা বাচ্চারাও ভাড়া নেওয়া।
বছর দশেক হলো, আরো নতুন এক ধরনের কৌশলী ভিক্ষাবৃত্তি চালু হয়েছে কলকাতা শহরের বড় রাস্তাগুলোর মোড়ে। ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়ি এসে থামলেই একদল বাচ্চা এসে কাচের জানলায় টোকা মেরে নানা রকম জিনিস বিক্রি করতে চেষ্টা করে। হয় রঙিন বেলুন, বা গোলাপ ফুলের গুচ্ছ, নয়ত ধূপের প্যাকেট। এবং এদের সবার বিক্রি করার কৌশল একটাই। হাতের জিনিসটি বাড়িয়ে দিয়ে করুণ মুখে বলা, ‘আজ সারাদিন কিছু খাইনি!' দিনের পর দিন ধরে একই জিনিস দেখতে দেখতে কিছু লোক যেমন ভিক্ষার এই কৌশল বুঝে ফেলেন, তেমন অনেকেই দয়া পরবশ হয়ে বেশি দাম দিয়ে অপ্রয়োজনের বেলুন অথবা গোলাপ কিনে ফেলেন। অনেকে আবার দাম মিটিয়ে দেন, কিন্তু জিনিসটা নেন না। সেটাও ওরা জানে। কিছু কিনতে না চাইলে ওরা তখন বলে, তা হলে দশটা টাকা দিয়ে যান!
এমন সুসংগঠিত ভিক্ষা–চক্র শহর থেকে সরানোর উদ্যোগ আপাতভাবে অসম্ভব বলে মনে হলেও, সেই কাজটাই ছোট করে শুরু করলো পশ্চিমবঙ্গের শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশন ডাব্লিউবিসিপিসিআর। কমিশনের একদল কর্মী সম্প্রতি তিন–চার দিন ধরে দক্ষিণ কলকাতার টালিগঞ্জ থেকে গড়িয়াহাট পর্যন্ত লাউড–স্পিকার মারফৎ প্রচার চালালেন পথচলতি মানুষজনের কাছে, যাতে এই শিশু বিক্রেতা এবং শিশু ভিক্ষুকদের অর্থ সাহায্য বন্ধ করা হয়। সাধারণভাবে রাস্তার মোড়ে থেমে থাকা গাড়িতে ভিক্ষা চাইতে যে বাচ্চারা আসে, তারা স্থানীয় ঝুপড়িবাসী, অথবা ফুটপাথেই তাদের বাস।
রাজ্য শিশু অধিকার রক্ষা কমিশনের চেয়ারপার্সন অনন্যা চক্রবর্তী বলছেন, আসলে এদের কারোরই ফুটপাথে থাকার কোনো দরকার নেই। কারণ, রাজ্যে এই ধরনের গৃহহীন মানুষদের জন্য যথেষ্ট সরকারি আশ্রয়–কেন্দ্র আছে, যেখানে এরা নিখরচায় থাকতে পারেন। কিন্তু শহরে ভিক্ষার মাধ্যমে সহজে উপার্জনের বন্দোবস্ত হয়ে যায় বলেই এরা ফুটপাথ ছেড়ে যেতে চান না। সেই কারণেই প্রাথমিক আবেদন সাধারণ মানুষের প্রতি, শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তিকে প্রশ্রয় না দেওয়ার।
অনন্যা চক্রবর্তী জানালেন, ‘‘এটা সবে শুরু হয়েছে, তার পর তিন–চারদিন চলেছে, গড়িয়াহাট, গোলপার্ক, রাসবিহারী জায়গাগুলোতে। প্রাথমিকভাবে শুধু সচেতনতা প্রচার, মাইকিং, এগুলো হয়েছে। পরবর্তীকালে, যে এনজিওরা এবং পুলিশ আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছে, তারা একটা রিপোর্ট দেবে। দেখবে, আদৌ কোনো কাজ হয়েছে কিনা। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে আমাদের আরেকটা আলোচনা হবে। তারপর ভবিষ্যৎ কর্মসূচি ঠিক হবে।''
ডাব্লিউবিসিপিসিআর মানছে যে. প্রায় দু কোটি মানুষের এই শহরকে শিশু শ্রমিক ও শিশু ভিখারি মুক্ত করা সহজ কাজ হবে না। কিন্তু তবু ওরা চেষ্টা করতে চায়, যাতে ভবিষ্যতের কলকাতাকে আরো একটু বেশি শিশুদের বাসযোগ্য যদি করে তোলা যায়।