1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

শতদলে বিকশিত হচ্ছে বিশ্বকাপ

নোমান মোহাম্মদ রাশিয়া
২৯ জুন ২০১৮

উদাহরণের যুক্তি জোরালো করতে কখনো-সখনো দরকার পড়ে ব্যতিক্রমের৷ ঠিক তেমনি ঘটনার উজ্জ্বলতা বাড়ানোর জন্য অঘটনের প্রয়োজনও রয়েছে বৈকি৷ এবারের জার্মানি সেই ধারাবাহিকতার বাহক মাত্র৷

https://p.dw.com/p/30X1j
Russland, WM 2018 Eröffnungsfeier Robbie Williams
ছবি: Getty Images/C. Rose

নিজেরা জ্বলে নিঃশেষ হয়ে গিয়ে বিশ্বকাপের আলোটা ভালোভাবে জ্বেলে গেল ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নরা৷ বুঝিয়ে গেল, বিশ্বকাপ শুধু দু'হাত ভরে দেয় না, দশ হাতে কেড়েও নেয়!

এ এক আশ্চর্য ধারা! ১৯৯৮ বিশ্বকাপের শিরোপাজয়ী ফ্রান্স চার বছর পর প্রথম রাউন্ডের গণ্ডি পেরোতে পারে না৷ ২০০২-এর ব্রাজিল পরেরবার তা পেরেছিল বটে, সেটিকে ব্যতিক্রম প্রমাণ করেছে পরের আসরগুলো৷ ২০০৬ সালের চ্যাস্পিয়ন ইটালি যেমন ২০১০-এ পৌঁছতে পারে না নকআউট রাউন্ডে৷ একইভাবে ২০১০ আসরের দাপুটে স্পেন চার বছর পর কোমড়ভাঙা এক সাপ কেবল, যাঁদের ফোঁসফোঁসানি রয়েছে কিন্তু প্রতিপক্ষকে বিষদাঁতে কাটার সাধ্য নেই৷ প্রথম রাউন্ডে তাই বাদ পড়ে যায় ‘লা রোসা'রা৷

তাই বলে জার্মানিও! ইওয়াখিম ল্যোভের এই দলও!

২০১৪ আসরে শুধু বিশ্বকাপ জয়ের জন্য না, সেমিফাইনালে ব্রাজিলকে ৭-১ গোলে হারানোর কারণেও ফুটবল ইতিহাসে অমরত্ব দলটির৷ তারা কিনা ২০১৮-তে এসে মেক্সিকো, সুইডেন, দক্ষিণ কোরিয়ার সমন্বয়ে গড়া গ্রুপ থেকে নকআউট রাউন্ডে উঠতে পারে না! চতুষ্টয়ের মধ্যে হয় চতুর্থ! এবারের সর্বনাশ চূড়ান্ত হবার পরের দিন জার্মান দৈনিক ‘বিল্ড'-এর সংবাদ শিরোনাম তাই কী যথার্থই না মনে হয়! গেলবারের ৭-১ গোলের জয়ের পর উল্লাসের ছবির সঙ্গে যে শিরোনাম দিয়েছিল, এবার দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে ০-২ গোলের হারের ছবি দিয়েও একই শিরোনাম, ‘ওনে ভর্টে!', অর্থাত্‍, বাকরুদ্ধ৷

সত্যিই তাই৷ অবিশ্বাস্য বললেও কম বলা হয়! গেলবারেরটি যেমন, এবারও তেমন৷

১৭ জুন মস্কোর লুজনিকি স্টেডিয়ামে নিজেদের প্রথম ম্যাচ খেলে জার্মানি৷ মেক্সিকোর বিপক্ষে৷ মিডিয়া ট্রিবিউনে বসে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের হারের সাক্ষী ছিলাম সেদিন৷ এরপর উপস্থিত জার্মান কোচ ল্যোভের সংবাদ সম্মেলনেও৷ নিজ দলের ভুলগুলো মেনে নেন অকপটে৷ কিন্তু গেল চার বিশ্বকাপের মধ্যে তিনবার ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের প্রথম রাউন্ডে বিদায়ের ইতিহাস মনে করিয়ে যখনই এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, তাচ্ছিল্যের হাসিতে তা উড়িয়ে দেন ল্যোভ, ‘‘ওদের বেলায় কেন অমন হয়েছে, আমি জানি না৷ কিন্তু নিশ্চিত থাকতে পারেন, আমাদের তা হবে না৷ দ্বিতীয় রাউন্ডে যাবোই৷'' প্রথাগত জার্মান বিশ্বাস৷ সেই চেনা আত্মবিশ্বাস, সেই জানা অহংকার৷ পরের খেলায় সুইডেনকে শেষ মুহূর্তের গোলে হারানোর পরও এর প্রতিফলন৷ জেরোম বোয়াটেংয়ের লাল কার্ডে ১০ জনের দলে পরিণত হয়েও টনি ক্রুসের গোলে জেতে তারা৷ এরপর এই মিডফিল্ডারের আস্ফালন, ‘‘জার্মানি যেমনভাবে খেলেছে, তেমন খেলার বুকের পাটা বিশ্বের বেশি দলের নেই৷''

দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে হারের পর সেটি শোনায় ক্ষয়িষ্ণু সাম্রাজ্যের রাজা-মন্ত্রীদের ফাঁকা বুলির মতো৷ ওই সর্বনাশের গান ছিল ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার খেলাতেও৷ বিশেষত আর্জেন্টিনার৷ দিনকয়েক আগে ৩১তম জন্মদিন পালন করা লিওনেল মেসির জন্য বিশ্বকাপ জয়ের শেষ সুযোগ হিসেবে ধরা হচ্ছে এই টুর্নামেন্টকে৷ সেখানে কিনা আইসল্যান্ডের সঙ্গে ড্র দিয়ে বিশ্বকাপ শুরু করে আলবিসেলেস্তেরা! সঙ্গে আবার স্বয়ং মেসির পেনাল্টি মিস৷ পরের খেলায় তো ক্রোয়েশিয়ার কাছে ০-৩ গোলে হেরেই যায়৷ গভীর গিরিখাতের কিনারায় এসে দাঁড়ায় আর্জেন্টিনা৷ নাইজেরিয়ার বিপক্ষে শেষ ম্যাচ জিততেই হবে৷ ১৯৮২ সাল থেকে বিশ্বকাপ কাভার করা আর্জেন্টাইন সাংবাদিক সের্হিয়ো লেভেনোস্কিকে খেলার আগের দিন মিডিয়া সেন্টারে খুব আত্মবিশ্বাসী দেখায়নি, ‘‘এবার তো আমরা খুব ভালো খেলছি না৷ দেখা যাক, মেসি যদি ভালো খেলে, তাহলেই আমাদের সুযোগ আছে৷''

FIFA Fußball-WM 2018 in Russland | Nigeria vs. Argentinien | Diego Maradona
ছবি: picture-alliance/dpa/Tass/A. Demianchuk

নাইজেরিয়ার বিপক্ষে মেসি করেছেন চোখ ধাঁধানো এক গোল৷ সেটিও আর্জেন্টিনাকে দ্বিতীয় রাউন্ডে তোলার জন্য যথেষ্ট ছিল না৷ নির্ধারিত সময়ের মিনিট পাঁচেক যখন বাকি, তখনো যে খেলা ১-১ সমতায়! সময়ের দাবিতে অপ্রত্যাশিত নায়ক হয়ে আবির্ভাব তখন মার্কোস রোহোর৷ এই ডিফেন্ডারের গোলে এ যাত্রা রক্ষা হয় আর্জেন্টিনার; ওঠে দ্বিতীয় রাউন্ডে৷

সেন্ট পিটার্সবার্গ স্টেডিয়ামের মিডিয়া ট্রিবিউনে বসে সেদিন দেখেছি, মাঠে মেসিদের উদ্বাহু উল্লাস৷ গ্যালারিতে আকাশী-সাদা সমুদ্রের আনন্দ-কল্লোল৷ যেন নকআউট পর্বে উত্তরণ নয়, বিশ্বকাপই জিতে গেছে তারা৷ বুকের উপর চেপে বসা পাথর নেমে যাওয়াটা ছিল এতই স্বস্তির৷

পরদিনই খানিকটা অস্বস্তির খচখচানি দেখেছি ব্রাজিল সমর্থকদের মাঝে৷ মস্কোর স্পার্তাক স্টেডিয়ামে৷ আর্জেন্টিনার মতো অত হতশ্রী অবস্থা তাঁদের নয়৷ তবু প্রথম দুই খেলায় চার পয়েন্ট পাবার পর শেষ ম্যাচে সার্বিয়ার কাছে হেরে গেলে বিশ্বকাপ থেকে ব্রাজিলও বিদায় হতো৷ ফোলহা সাও পাওলোর সাংবাদিক জোকা কাফুরি এই ম্যাচের আগে আশার কথাই শুনিয়েছেন, সঙ্গে জার্মানির বিদায়ে হতাশাও, ‘‘খুব ভালো বিশ্বকাপ হচ্ছে৷ রাশিয়া খুব ভালো আয়োজন করছে৷ আমি আশা করি, ব্রাজিল শিরোপা জিতবে৷ তবে তা কঠিন৷ নেইমার দুষ্টু ছেলে৷ আশা করছি, আজ ও ভালো খেলবে৷ তবে জার্মানির বিদায়টা খুব বড় চমক৷ আমরা আশা করছিলাম ৭-১ গোলের প্রতিশোধ নেবো৷ সেটি হলো না৷ ওরা তো দ্বিতীয় রাউন্ডেই উঠতে পারলো না৷''

জার্মানি না পারলেও ব্রাজিল পেরেছে৷ আদেনর বাক্কি তিতের দল সাম্বার সৌরভ ছড়ানো ফুটবলে জিতেছে ২-০ গোলে৷ আর টুর্নামেন্টের তিন ম্যাচে সেলেসাওদের ধারাবাহিক ক্রমোন্নতি তাদের শিরোপা জয়ের অন্যতম ফেভারিটের আসনে বসিয়ে দিয়েছে৷ ব্রাজিলিয়ান দৈনিক ‘জোয়াও মালদো'র সাংবাদিক মাউরিও ফরসিওকা জাতীয় দল নিয়ে আশাবাদী, ‘‘আজ বিশ্বকাপে সেরা ফুটবল খেলেছে ব্রাজিল৷ তিতে প্রথম থেকেই জানতেন, কী করতে চাইছেন৷ ধৈর্য ধরে খেলিয়েছেন দলকে৷ আমরা চোখ ধাঁধানো ম্যাচ হয়তো খেলিনি, তবে খুব ভালো খেলেছি৷'' টুর্নামেন্ট জয়ে আরো কিছু প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা বলেছেন তিনি, ‘‘ফ্রান্স, বেলজিয়াম ভালো দল৷ আর্জেন্টিনাও খুব শক্তিশালী৷ ওদের মেসি আছে৷ ওঁর যদি খুব ভালো দিন যায়, তাহলে আর্জেন্টিনাকে আটকানো কঠিন৷''

ফ্রান্সও খেলছে ফেভারিটের মতো৷ দ্বিতীয় রাউন্ডেই অবশ্য আর্জেন্টিনার মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাদের৷ টুর্নামেন্ট শুরুর দুই দিন আগে কোচ লোপেতেগিকে বরখাস্তের ধাক্কা সামলে স্পেন হয়েছে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন৷ ইংল্যান্ডের শুরুটাও আশা জাগানিয়া৷ বেলজিয়ামেরও৷ আর বছর দুয়েক আগে ইউরো চ্যাম্পিয়ন হয়ে সবাইকে চমকে দেয়া ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোর পর্তুগালও বিশ্বকাপ দৌড়ে রয়েছে ভালোমতোই৷

আর রয়েছে স্বাগতিক রাশিয়া৷ মাঠের ফুটবলে এ দলটির সম্ভাবনা গোনায় ধরেনি কেউ; আয়োজনের দিক দিয়েই বরং চ্যাম্পিয়ন হতে চেয়েছিল তারা৷ সেই আয়োজন নিয়ে বড় ধরনের অভিযোগ ওঠেনি এখনো৷ আর মাঠের ফুটবলেও তো প্রথম দুই ম্যাচে সৌদি আরব ও মিশরকে হারিয়ে নকআউট পর্ব নিশ্চিত করেছে তারা৷

এছাড়া প্রথম রাউন্ডে আলোচনার বড় জায়গাজুড়ে ছিল ভিএআর প্রযুক্তি৷ অনেক অনেক পেনাল্টি৷ অনেকগুলো ম্যাচের শেষ মুহূর্তের রোমাঞ্চকর নিষ্পত্তি৷

বিশ্বকাপ তাই নিজের মতো করেই রং ছড়াচ্ছে ক্রমশ৷ নিজস্ব নিয়ম মতোই বিকশিত হচ্ছে শতদলে৷ তাতে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন জার্মানির রং মুছে গেলেইবা কী! কালো-লাল-হলুদ পতাকার পাঁপড়ি ঝরে গেলেইবা কী!

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য