পাঠের ক্ষেত্রে পাঠক সিলেক্টিভ কিংবা স্বেচ্ছাধীন৷ কিন্তু লেখকের লক্ষ্য যেমন পাঠক,পাঠকের লক্ষ্যও লেখক, তবে তা শর্তসাপেক্ষে ৷ দুই দুইয়ের পরিপূরক বটে৷ এককে ছাড়া অপর পরিপূর্ণ নয়৷ অচলতো বটেই, অস্তিত্বহীনও৷ কিন্তু তবুও লেখক সর্বাংশে পাঠক মুখি নয়৷
বাকি থাকে প্রকাশক৷ তিনি এই দুইয়ের সেতুবন্ধন৷ লেখক লিখেন, প্রকাশক প্রকাশ করেন আর পাঠক পড়েন৷ লেখক না লিখলে পাঠক কিংবা প্রকাশকের অস্তিত্ব থাকে না৷ কিন্তু পাঠক না পড়লে, প্রকাশক প্রকাশক প্রকাশ না করলে লেখক লিখতেন কিনা এই বিষয়টি আলোচনার দাবি রাখে৷
সমকালে দুজন লেখক বহুল আলোচিত৷ একজন জীবনানন্দ, যার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ লেখা আবিস্কৃত হয়েছে তাঁর মৃত্যুর পর ট্র্যাংকে, ফটোগ্রাফ খুঁজতে গিয়ে৷ আর দ্বিতীয়জন কাফকা,যিনি তার বন্ধুকে বলে গিয়েছিলেন, মৃত্যুর পর তাঁর সব লেখা পুড়িয়ে দিতে৷
এই দুইজন লেখকের প্রসঙ্গের অবতারণা এজন্য যে লেখক আসলে কেন লিখেন,পাঠককে লক্ষ্য করে কি? ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয় লেখার তাড়না এক অন্তর্গত বোধ,যা তাকে তাড়িত করে লিখতে৷ সেক্ষেত্রে একজন লেখক যখন লিখেন তখন কি সামনে পাঠক থাকেন? আমার ধারণা জনপ্রিয় ঘরানার লেখক ছাড়া অন্য লেখকদের মোটেই তা থাকে না৷ জনপ্রিয় ঘরানার লেখকরা লিখেন পাঠকের মনোরঞ্জনের জন্য৷ পাঠক কী পড়তে পছন্দ করবে,কী ধরনের লেখা সংখ্যাগরিষ্ঠ লেখকের প্রত্যাশা তা মাথায় রেখে তিনি লিখেন৷ জনপ্রিয় ধারার লেখার সাথে অর্থের সংযোগ থাকে৷ বেস্টসেলার তকমা লাভের হাতছানি থাকে৷ ফলে প্রচলিত জনমানস কিংবা প্রথার বিরুদ্ধে যায় এমন কোন সত্য তিনি উচ্চারণ করেন না,কিংবা উচ্চারণ করার সাহসও করেন না৷ তিনি বাজারমুখি৷ সাহিত্যে তিনি আবশ্যিক কিনা এ প্রশ্নটি উহ্য রেখে বলা যায়, তাকে অস্বীকার করা যায়না৷ যুগে যুগে এমন ধারার লেখক ছিলো আছে এবং থাকবে৷ তিনি জনপ্রিয় হন তাঁর লেখার ক্ষমতা দিয়েই৷ তিনি লিখতে পারেন বলেই তো লিখেন৷ লিখে পাঠক মন জয় করেন৷ তার লেখা সস্তা হতে পারে,কিন্তু সহজ নয় কোনোমতেই৷ সদাসর্বদা জনমানসকে তৃপ্ত রাখার প্রচেষ্টা খুব সহজ প্রচেষ্টা নয়৷
কিন্তু জাত লেখক এসব নিয়ে ভাবিত হননা কখনোই৷ পাঠক কী চান তা ভাবেন না মোটেই৷ কিন্তু তার লেখা পাঠকের হাতে পৌঁছাক,পাঠক পড়ুক, উপলব্ধি করুক এই বাসনা তারও থাকে৷ কিন্তু প্রথা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমানসের বিপরীতে দাঁড়িয়ে নিজের শক্তিশালী কণ্ঠকে উচ্চকিত করা লেখা সবসময় গুটিকয়েকের জন্য,যারা মননশীলতার চর্চা করেন৷ যুগে যুগেই এমন পাঠকের সংখ্যা কম৷
প্রকাশক কে? প্রকাশক সে,যিনি মূলত পাঠক এবং লেখকের মধ্যে সেতুটি তৈরি করে দেন৷ এর বাইরে তার আরেকটি দায়িত্বও কিন্তু রয়েছে,যে দায়িত্বটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ সেটি হলো এই, যে তিনি যুগোত্তীর্ণ কিংবা কালোত্তীর্ণ লেখাকে প্রকাশের আলোতে নিয়ে আসবেন৷ তিনি হয়তো জানেন এই লেখা তেমন বেশি সংখ্যক পাঠক পড়বে না৷ এই বই বিক্রি করে তিনি আর্থিকভাবে লাভবান হবেন না৷ কিন্তু সামাজিক কিংবা নৈতিক কিংবা পেশাগত সততা থেকে তিনি কাজটি করবেন৷
সামাজিক দায়িত্ব বলি কিংবা নৈতিক অথবা পেশাগত সততা যে তিনটি বিষয় এখানে উল্লেখ করলাম এই তিনটি একজন পুস্তক প্রকাশকের জন্য আবশ্যিক৷ কারণ তিনি বই প্রকাশ করতে এসেছেন৷ কেবলই ব্যবসা করতে নয়৷ শুধু লাভ যদি তার কাছে মুখ্য হয় তবে তিনি আলু পটল ডিম তেল পেঁয়াজ নানা কিছুর ব্যবসা করলেই পারতেন৷ স্থূল দাগে এই তিনটি বিষয় একজন পুস্তক প্রকাশক এবং অন্য ব্যবসায়ীর মধ্যে পার্থক্য তৈরি করে দেয় সুস্পষ্ট ভাবে৷
প্রশ্ন উঠতে পারে বই বিক্রি না হলে কি প্রকাশক লোকসান দেবে? বাংলাদেশের খুব কম প্রকাশককেই আমি লোকসান গুনতে দেখেছি৷বাংলাদেশের প্রকাশকরা সবাই ধনাঢ্য হয়েছেন বইয়ের ব্যবসা করেই৷ কিন্তু গুটি দুচারজন ছাড়া লিখে ধনাঢ্য হয়েছেন তেমন লেখক পাওয়া কঠিন৷
চিন্তাশীল, মননে ঢিল ছুঁড়ে আন্দোলিত করে এমন পাঠকের সংখ্যা সবসময়ই কম৷ বাংলাদেশের প্রকাশকরা অধিকাংশই পেশার ক্ষেত্রে খুবই আপসহীন৷ তারা ব্যবসাটাই বোঝেন৷ দায়বদ্ধতা কিংবা দায়িত্বের জায়গাটিতে সৎ কোনো প্রকাশকের দেখা আমি এখনো পাইনি৷ লেখকের প্রকাশিত বইয়ের কয় কপি বিক্রি হলো, অধিকাংশ লেখক তা জানেন না৷ আমি সবসময় প্রকাশকের কাছে শুনে এসেছি আমার বই বিক্রি হয়না৷ আমি জানি, আমার বই হটকেকের মতো বিক্রি হয় না,কিংবা হটকেকের মতো বিক্রি হবে এমন বই আমি লিখতে পারিনা৷ ফলে প্রকাশকের সাথে দর কষাকষিতে যাওয়ার সাহস আমার থাকেনা৷ থাকলেও উপায় নেই৷আমি চাইলেও সত্যটা জানতে পারবো না৷
শুনেছি বই প্রকাশের আগে প্রকাশকগণ লেখকের সাথে চুক্তি করেন৷ কিন্তু আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় আমি কোন প্রকাশক পাইনি যিনি আমার সাথে লিখিত চুক্তি করেছেন৷ কোনো কোনো লেখক বলেন বটে কিন্তু তার সত্যতা নিয়ে আমার সন্দেহ নেই, কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা নিয়ে দ্বিধা আছে৷ দু চারজন থ্রিলার লেখক আর জনপ্রিয় ধারার গুটিকয়েক লেখক ছাড়া কোন নিবেদিত প্রান লেখক প্রকাশকের সাথে বাক্যালাপ বাড়াতে চান বলে আমার মনে হয়না৷ লেখক যে ধ্যানে লিখেন, বই বিক্রি হয়না,কেউ পড়েনা রকম মন্তব্যে সত্যিকারের লেখক মগ্নতায় ঘাটতি ঘটাতে চান বলে মনে হয়না৷ শেষ পর্যন্ত প্রকাশকই তো লেখকের ভরসা,লেখাকে পাঠক অন্তত একজন পাঠকের কাছে পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রেও তো প্রকাশকই এগিয়ে আসেন৷ তাই লেখকের প্রকাশকের সাথে সদ্ভাব রাখাটাই যুক্তিযুক্ত৷ নইলে জীবনানন্দের মতো ট্র্যাংকবন্দী করে রাখাই লেখার নিয়তি৷ এ যুগে এতোটা নির্মোহ লেখক পাওয়া বোধকরি কঠিন৷ চুক্তিতে আবদ্ধ না হলেও আমি বেশ কয়েকজন প্রকাশকের কাছ থেকে রয়্যালটির টাকা পেয়েছি৷ যদিও তা টাকার অংকে সামান্যই৷ এতে লেখক হিসাবে আপত্তি নেই৷ কিন্তু প্রকাশক সম্ভবত তখন বইয়ের প্রকাশক হিসাবে নিজের নৈতিকতার পরিচয় দিতে পারবেন,যখন তিনি বই বিক্রির উপর ভরসা না করে লেখককে রয়্যালটি দিয়ে প্রকাশের জন্য একটি ভালো বই মনোনীত করবেন৷
ইদানিং বইমেলায় একটি প্রবণতা ফেইসবুক সেলিব্রিটি,মোটিভেশনাল কিংবা আমলা, ক্ষমতাবান,বিত্তশালীদের বই প্রকাশ৷ এদের বই প্রকাশে প্রকাশকদের আগ্রহ অসীম৷ এদের বই প্রকাশে প্রকাশকদের প্রবল ও প্রচুর আগ্রহ৷ এক্ষেত্রে প্রকাশকদের কোন আর্থিক ঝুঁকি থাকেনা৷ টাকার বিনিয়োগ নিয়ে ভাবতে হয়না,উলটো অনুগত কিংবা স্বার্থগত কারণে বইয়ের ক্রেতারও অভাব হয়না৷
তেতো হলেও যা সত্য, তা হলো খুব কম প্রকাশক খুঁজে ভালো বই প্রকাশ করেন৷ লেখকের নিজেকে প্রমাণের যাত্রাটি বড়োই নিঃসঙ্গ একা৷ যিনি লেখালেখিকে পেশা নয়, মননে ধারণ করেন তিনি বইমেলা কেন্দ্রিক বই লিখেন না৷ বিক্রি নিয়ে তারা খুব চিন্তিতও নন৷ কিন্তু প্রকাশকগণ মেলা কেন্দ্রিক৷ বেশিরভাগ প্রকাশক মেলাকে কেন্দ্র করেই বই প্রকাশ করেন৷ এই মেলা কেন্দ্রিক বই প্রকাশের লক্ষ্য নিশ্চয়ই বিক্রি৷ বলা বাহুল্য মেলাকেন্দ্রিক পাঠক অপাঠক সবারই বই কেনার ঝোঁক থাকে৷ জনপ্রিয় লেখকের বই বিক্রি বেশি হয়,অজনপ্রিয়দের বই বিক্রি হয় কম৷ কিন্তু তাই বলে লেখক কি হতাশ হন? বিক্রির জোয়ারভাটা তাকে কি বিমর্ষ করে?যিনি প্রাণের আনন্দে লিখেন, তিনি অনাহারে থেকেও লিখেন,অর্ধাহারে থেকেও লিখেন৷ বেচাকেনার হাট তাঁকে বিচলিত করে বলে মনে হয় না কখনোই৷