লকডাউনের প্রথম দিন
২৬ মার্চ ২০২০এতদিনে ভারতের সাধারণ লোক জেনে গিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন ঠিক রাত আটটায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন, তখনই তিনি গুরুতর কিছু ঘোষণা করেন। এ ভাবেই নোটবন্দি, জনতা কার্ফুর কথা শুনেছে দেশ। সোমবার রাত আটটায় শুনল সারা দেশে ২১ দিনের লক ডাউনের ঘোষণা। কোনও সন্দেহ নেই অভূতপূর্ব পদক্ষেপ। এতেও কোনও সন্দেহ নেই, খুবই জরুরি পদক্ষেপ।
কিন্তু মুশকিল হল, লকডাউন বা সম্পূর্ণভাবে অবরুদ্ধ থাকা বলতে কী বোঝায়, তার তো কোনও পূর্ব ধারণা লোকের নেই। কোনও অভিজ্ঞতাও নেই। তাও আবার ২১ দিনের জন্য। স্মৃতিতে যতটা দৃষ্টিপাত করা যায়, ততদূর দেখেও এরকম কোনও ঘটনার কথা মনে পড়ল না। ছেলেবেলায় একবারই কিঞ্চিত লকডাউনের অবস্থা হয়েছিল, সেই ১৯৭১ এ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়। কলকাতায় মাঝে মধ্যে সাইরেন বাজছে। সেই শব্দ শুনলেই লোকে ভয়ে বাড়ি ঢুকে পড়ছে। রাতে ব্ল্যাক আউট। জানলার কাচে খবরের কাগজ সাঁটা। আলো যাতে বাইরে না যায়। গাড়ির লাইটের কাচে অর্ধেকটা আলকাতরা দিয়ে কালো করে রাখা। সন্ধে হলেই রেডিওর সামনে বসে দেবদুলাল বন্ধ্যোপাধ্যায়ের খবর। গলাটা সামান্য কাঁপিয়ে, আবেগের উচ্চারণে সমৃদ্ধ সংবাদপাঠ। তার সঙ্গে তো লকডাউনের কোনও তুলনাই হয় না। কারণ, তখন তো দোকান পাট খোলা। সোস্যাল ডিসটেন্সিংয়ের কোনও গল্প সেখানে ছিল না। লোকে অবাধে মিশছেন। গল্প হচ্ছে। অফিস খোলা। সব বন্ধ এরকম পরিস্থিতিতে আগে কখনও পড়েছে কি দেশ? মনে হয় না।
এই করোনা আতঙ্কের বাজারে সেটাই হল প্রধান ওষুধ। সব বন্ধ করে আলাদা থাকতে হবে। ফ্ল্যাট বা বাড়িবন্দি হয়ে। পরিবারের বাইরে আর কারও সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ নয়। লোকে তো প্রথমে বুঝতেই পারছিলেন না, কখন বাড়ি থেকে বেরবেন, আদৌ বেরতে পারবেন কি না। না বেরলে সবজি, চাল, ডাল বা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া যাবে কী করে? তাদেরই বা দোষ দেব কী করে? বহিঃশত্রুর আক্রমণ নেই, ভয়ঙ্কর কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেই, শুধু এক ভাইরাসের তাণ্ডবে যে ১৩০ কোটি লোককে ঘরবন্দি হয়ে থাকতে হবে তা কেই বা আর ভাবতে পেরেছে। কিন্তু এটাই বাস্তব। ওই ভাইরাসকে কাবু করতে গেলে প্রথমে মেলামেশা বন্ধ। তার সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি পালন।
যতই ছটফটানি হোক না কেন, গন্তব্য এখন নিজের শোওয়ার ঘর থেকে বারান্দা পর্যন্ত। এই অবস্থায় সকালে ঘুম ভাঙতে প্রথম চিন্তা হল, সবজি পাব কোথায়? আপাতত ২১ দিনের লকডাউন। পরে তার মেয়াদ যে আরও বাড়বে না তা কে বলতে পারে? সেরকম হলে খাবটা কী? প্রধানমন্ত্রী আগের ভাষণেই বলেছেন, ''ভয় পেয়ে ঘরে জিনিস মজুত করবেন না। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের কোনও অভাব নেই।'' ফলে চাল, ডাল, তেল, মশলার অত সংগ্রহ ঘরে নেই। তাই প্রথম কাজটা হল, আগামী দিনের কথা ভেবে রেশন জোগাড় করা।
পাশেই বাজার। তাও গাড়ি নিলাম। কারণ, তাতে প্রেস স্টিকার রয়েছে। পকেটে প্রেস কার্ড নিতে ভুললাম না। যদি পুলিশ ধরে তো দেখালে ছাড় পাওয়া যাবে। শুনশান রাস্তা। বাজারের সামনে সধারণ দিনে গাড়ি পার্ক করাটা দুরূহ। এ দিন সহজেই পার্ক করে এগোলাম। একটিমাত্র দোকান খোলা। সেখানে অন্তত জনা ছয় সাত লোক। একটু দূরত্ব রেখে চালের কথা বলতেই দোকানি বললেন, ''দেখে নিন, কোনটা নেবেন।'' সেখানে জনা চারেক লোক নিরাপদ দূরত্বে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে জিনিস নিচ্ছেন। বললাম, আগে খালি হোক। জিনিস নিয়ে স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করে বাড়ি ফিরে তা রেখে দিলাম বারান্দায়। ১২ ঘন্টা অন্তত এরকমভাবে থাক। সতর্কতার তো কোনও মার নেই।
বারান্দা দিয়ে দেখা যাচ্ছে সামনের রাস্তা। কয়েকজন কুকুর নিয়ে বেরিয়েছেন। একটা দুটো গাড়ি যাচ্ছে। বেলা বাড়তে পুলিশের গাড়ি চলতে শুরু করল। সামনের শিমূল গাছের ওপরে চোখ পড়তেই অবাক হলাম। দিল্লির আকাশ তো এত নীল কখনও দেখি না। দূষণের জন্য সবসময় ঘোলাটে আকাশ। কয়েকদিনেই দূষণ কেটে গিয়ে নীল আকাশ বেরিয়ে পড়েছে। হাওয়া হালকা হয়েছে। রাতে তারা দেখা যচ্ছে। এ অভিজ্ঞতাও সাম্প্রতিক সময়ে কখনও হয়নি।
বারান্দা থেকে আবার ঘর। ঘর থেকে আবার বারান্দা। যাওয়া আসা বলতে এইটুরুই। বুঝতে পারছি, লকডাউনটা খুবই জরুরি। শুধু আমি কেন, দেশের তাবত লোক বুঝতে পারছেন, অনন্যোপায় হয়ে এই কঠোর সিদ্ধান্ত নিতেই হয়েছে। কিন্তু বিপদ অন্যত্র। কলকাতা থেকেই ফোনে বন্ধু জানালেন, তাঁর বাবা-মা দু'জনেই আশি পার করেছেন। শরীর ভালো নেই। বাড়িতে রান্না করে মেয়ে তা পৌঁছে দিতে গিয়েছিলেন বাড়িতে। গাড়ি নিয়ে বেরতে পারেননি। অনুমতি নেই। থানায় ফোন করে অনুমতি চাওয়ার পর শুনতে হয়েছে, এটা জরুরি কাজের মধ্যে পড়ে না। আগে থেকে খাবার দাবার বাড়িতে নিয়ে রাখেননি কেন? পরে এক সাংবাদিককে ধরে ডিসিপিকে ফোন করিয়ে অনুমতি জোগাড় করতে হয়েছে।
পুলিশেরও তো লকডাউনের অভিজ্ঞতা নেই। তাদের বলা হয়েছে, রাস্তায় যেন লোক না থাকে তা দেখতে। সঙ্গে সঙ্গে তারা লাঠিসোটা নিয়ে নেমে পড়েছে। ইতিমধ্যে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, পুলিশ বাইরে লোক দেখলেই লাঠি চালাচ্ছে। সরকার বলছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া যায় এমন দোকান খোলা থাকবে। চাল, ডাল, তেল বা মুদির দোকান, ওষুধের দোকান, দুধের দোকান, এমনকী মাছ-মাংসের দোকানও। কিন্তু ভারতে তো সেই দোকানদারদের কাছে, কর্মীদের কাছে কোনও পরিচয়পত্র নেই। ফলে যারা দোকানের কাছে থাকেন, তাদের অসুবিধা হচ্ছে না। যারা দূরে থাকেন, তারা আসতে পারছেন না। পুলিশই বা বুঝবে কেমন করে, কে কোথায় যাচ্ছে। তাই লোক দেখলেই লাঠি।
বিপদ তো শুধু এইটুকই নয়। সব চেয়ে বিপদে গরিব মানুষ। লকডাউনের বাজারে তাঁরা কী করবেন? বিশেষ করে দৈনিক মজুরিতে যাঁরা কাজ করেন? কিছু রাজ্য সরকার চেষ্টা করছে তাদের সাহায্য করার। উত্তর প্রদেশ সরকার গরিবদের মাসে এক হাজার টাকা করে দেবে বলে জানিয়েছে। পাঞ্জাব সরকার নির্মাণ শিল্পের শ্রমিকদের মাসে তিন হাজার টাকা দেবে। গরিবদের কাছে খাবার ও ওষুধ পৌছনোর কাজ শুরু হয়েছে। হরিয়ানা, কেরালা সরকারও গরিবদের মাসে মাসে টাকা দেবে বলেছে। কিন্তু তা হল বিন্দুতে সিন্ধু। করোনার বাজারে কবে তাঁরা হাতে টাকা পাবেন, কী করে তাঁরা সেই টাকা তুলতে পারবেন, সেই ধাঁধার সমাধানও হচ্ছে না।
দিল্লি লাগোয়া গুড়গাঁওতে সব কারখানা বন্ধ। শ্রমিকদের বাড়ি চলে যেতে বলা হয়েছে। রাতারাতি তাঁরা যাবেন কোথায়? ধোলাকুঁয়াতে এরকমই একদল অভুক্ত ও পুলিশের কাছে মার খাওয়া শ্রমিকের কাছে খাবার পৌঁছে দিয়েছেন সাংবাদিক আশুতোষ। এই শ্রমিকরা পায়ে হেঁটে উত্তর প্রদেশে তাঁদের বাড়ি ফেরার চেষ্টা করছেন। কবে ফিরবেন, কীভাবে ফিরবেন, কতবার পুলিশের মার খেতে হবে, তা কে জানে! আর যাঁরা রাস্তার ধারে ছোট চায়ের দোকান করে বা সাইকেলের ওপর পরোটা বা কুলচা-ছোলা অথবা মোমো বিক্রি করে সংসার চালান, তাঁরাই বা ২১ দিন কী করে কাটাবেন?
উত্তর জানা নেই। করোনার থাবা থেকে সাধারণ মানুষ কী করে বাঁচবেন, কী করেই বা তাঁরা সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং করবেন, ঘরবন্দি হয়ে থাকবেন, তা বলা অসম্ভব। সরকারি হিসাব বলছে, ভারতে ৮৭ শতাংশ লোকই অসংরক্ষিত ক্ষেত্রে কাজ করেন। করোনার থাবা থেকে তাঁদের বাঁচানোটাও সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ।
প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত মেনে প্রায় পুরো দেশ যখন ঘরবন্দি, তখন অবশ্য উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ অযোধ্যায় গিয়ে রামলালার কাছে প্রার্থনা করেছেন। সঙ্গে প্রচুর লোকজন সহ সেই ছবি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। করোনায় সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং বা লকডাউন কি তাঁর ক্ষেত্রে খাটে না? না কি, ঘর থেকে বারান্দা, বারান্দা থেকে ঘরের মধ্য়ে তাঁদের আটকে রাখা যাবে না?
তবে বাঙালির রসিকতা বন্ধ হয়নি। সপরিবারে লকডাউনে বসে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে। ঘুরছে মজার মজার জোক। নমুনা? 'স্বেচ্ছায় নিজেদের অবরুদ্ধ করে রাখার উদাহরণ তো নেতাজি ও সুচিত্রা সেন। তিরিশ বছর ধরে সুচিত্রা সেন যদি নিজেকে অবরুদ্ধ করে রাখতে পারেন, তা হলে আমরা ২১ দিন পারব না কেন?'