লকডাউন নিয়ে যত বিভ্রান্তি
১৯ জুন ২০২০টেকনিক্যাল কমিটির সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ঢাকার দুই সিটি ও চট্টগ্রামের যেসব এলাকায় প্রতি এক লাখ জনসংখ্যায় সর্বশেষ ১৪ দিনে ৬০ জন আক্রান্ত হয়েছে সে সব এলাকা রেড জোন৷ আর ঢাকার বাইরে প্রতি লাখে ১০ জন৷
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জনসংখ্যার হিসাব করেছে ২০১১ সালের সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী৷ কিন্তু এখন জনসংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে৷ ফলে জনসংখ্যার অনুপাত নিয়ে জটিলতা হচ্ছে৷ স্থানীয় পর্যায়ে তাই লকডাউন ঘোষণা কঠিন হচ্ছে৷
কে লকডাউন ঘোষণা করছে?
ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় প্রায় তিন লাখ মানুষের বসবাস৷ ওই এলাকায় বুধবার রাতে হঠাৎ করেই লকডাউনের ঘোষণা দেয়া হয় মাইকে৷ আর এই ঘোষণায় পুরো এলাকার মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন৷ তারা নানা জায়গায় ফোন করে জানতে চান বিষয়টি৷ কারণ এটা নিয়ে আগাম কোনো প্রচার ছিল না৷ পরে বৃহস্পতিবার সকালে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম ঢালি দুঃখ প্রকাশ করেন এবং জানান লকডাউনের ঘোষণা ভুল ছিলো৷ এরকম কেন হলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আসলে করোনা প্রতিরোধে আমরা আগের চেয়ে একটু বেশি বড়াকড়ি আরোপ করেছি বসুন্ধরা এলাকায়৷ আর তাতেই কিছু যুবক উৎসাহী হয়ে লকডাউনের কথা মাইকে প্রচার করেন৷’’
লকডাউন পূর্ব রাজাবাজার
লকডাউন ১৪ দিন, না ২১ দিন তা নিয়েও বিভ্রান্তি আছে পূর্ব রাজাবাজারে৷ সেখানে লকডাউন শুরু হয় ৯ জুন থেকে৷ ১৪ দিনের হলে তা আগামী সোমবার শেষ হওয়ার কথা৷ কিন্তু বাসিন্দারা জানেন না ঠিক সোমবারে লকডাউন শেষ হবে কিনা৷ তারা শুনেছেন এটা ২১ দিন হতে পারে৷ তাহলে শেষ হবে ৩০ জুন৷
ওই এলাকার বাসিন্দা গাড়িচালক মাসুদ আহমেদ এই লকডাউনে দুই ধরনের সমস্যায় পড়েছেন৷ তিনি একটি বাসার প্রাইভেট কার চালান৷ সেই বাসা আবার লকডাউনের বাইরে৷ তিনি সেখানে যেতে পারেন না৷ তিনি জানে না এখন তিনি বেতন পাবেন কিনা৷ আবার লকডাউন এলাকায় ভ্যানে করে শাকসবজি বিক্রি করা হলেও তার দাম চড়া বলে জানান তিনি৷ ওই এলাকায় অনেকেই আছেন যারা অন্য এলাকায় চাকরি করেন৷ সেখানে অফিস খোলা৷ এখন তাদের অফিস বেতন দেবে কিনা তা নিয়েও আছে অনিশ্চয়তা৷ সরকার লকডাউন এলাকায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলেও এব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো ঘোষণা দেয়নি৷
ওই এলাকার আরেকজন বাসিন্দা সাংবাদিক আমিন আল রশীদ বলেন, ‘‘এলাকার যারা বাইরে বেসরকারি চাকরি করেন তাদের মধ্যে বিভ্রান্তি আছে যে তারা বেতন পাবেন কিনা৷ একারণে প্রতিদিন সকালেই লোকজন নানা অজুহাতে বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করেন৷ তাদের থামাতে প্রতিদিনই মাইকিং করতে হয়৷’’
পূর্ব রাজাবাজারের লকডাউন এলাকায় ৫০ হাজার বাসিন্দা আছেন৷ স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরিদুর রহমান খান ইরান জানান, ‘‘এখনো ২১ দিন লকডাউনের সিদ্ধান্ত হয়নি৷ ১৪তম দিনে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে আর বাড়ানো হবে কিনা৷’’
তিনি লকডাউনে তার বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বলেন, গভীর রাতে কেউ কোমল পানীয়, কেউ পান-সুপারি, কেউ আইসক্রিম এনে দিতে বলছেন৷
আক্রান্ত বাড়ছে পূর্ব রাজাবাজারে
এদিকে পূর্ব রাজাবাজার লকডাউন করার পর করোনা আক্রান্ত বেড়েছে৷ ওয়ার্ড কাউন্সিলর জানান, লকডউনের আগে মোট আক্রান্ত ছিলেন ৩১ জন৷ পরীক্ষায় আরো ১৫ জন করোনা আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে গত পাঁচ দিনে৷ এখন মোট আক্রান্ত ৪৬ জন৷ তবে ওই এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক বলছেন, এখন প্রতিদিন ২০-২৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে৷ ফলে পজিটিভ শনাক্ত হচ্ছে বেশি৷ এরা আগেই আক্রান্ত৷
মেয়ররা জানেন না
উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ১৭টি এবং দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ২৮টি এলাকা, এই মোট ৪৫টি এলাকাকে ঢাকার রেড জোন ঘোষণা করা হয়েছে৷ এর বাইরে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ১০টি, গাজীপুরের সবকটি উপজেলা, নারায়ণগঞ্জ পুরো সিটি ও জেলার আরো তিন উপজেলা এবং নরসিংদী জেলাসদরসহ তিন উপজেলা রেড জোন৷
ঢাকা দুই সিটির রেড জোন ঘোষণা করা হলেও কবে, কখন লকডাউন করা হবে তা এখনো স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়নি৷ ঢাকা দক্ষিণের মেয়র ফজলে নূর তাপস জানিয়েছেন, লকডাউনে সুনির্দিষ্টভাবে কার কি দায়িত্ব হবে তা জানাতে হবে৷ সেটা না জানানোর আগে লকডাউন নয়৷ ফলে ওয়ারী এলাকার মানুষ আছেন বিভ্রান্তিতে৷ কারণ পূর্ব রাজাবাজারের সঙ্গেই ওই এলাকাও লকডাউন হওয়ার কথা ছিলো৷ সেখানে এখন লকডাউনের মতোই কড়াকড়ি চলছে৷
উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলামও তার ১৭টি এলাকা রেড জোন করা হয়েছে বলে জেনেছেন৷ কিন্তু এব্যাপারে বিস্তারিত কোনো নির্দেশনা পাননি৷ তিনি মনে করেন, লকডাউন করা আগে কমপক্ষে ৪৮ ঘণ্টা সময় দেয়া দরকার৷
লকডাউন না করার চাপ
ঢাকার সাভার, আশুলিয়া এবং গাজীপুরে লকডাউন না করার চাপ আছে৷ কারণ ওই সব এলাকায় সবচেয়ে বেশি পোশাক কারখানা আছে৷ পোশাক কারখানার মালিকরা লকডাউন যাতে না হয় তার চেষ্টা তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন৷ সাভার এলাকায় কয়েকদিন ধরে লকডাউনের গুজব ছড়াচ্ছে বলে স্থানীয়রা জানান৷ কিন্তু হচ্ছেনা৷ তবে আজ (শুক্রবার) মধ্য রাত থেকে ধামরাই পৌর এলাকায় লকডাউন শুরু হচ্ছে ১৪ দিনের জন্য৷ এজন্য গত দুই দিন ধরে প্রচার চলছে৷ পৌর মেয়র গোলাম কবির বলেন, ‘‘আমরা আগেই সময় দিয়েছি৷ সবাইকে যার যার খাবার কিনে রাখতে বলেছি৷ লকডাউন কয়েকদিন চলার পর দেখে সিদ্ধান্ত নেব যে খাবার সরবরাহ করতে হবে কিনা৷’’
এখনো চূড়ান্ত হয়নি
রেড জোনের একটি তালিকা করা হলেও বাস্তবে এর অনেক কিছুই চূড়ান্ত হয়নি৷ লাখে কত মানুষ আক্রান্ত হলে রেড জোন হবে তাই চূড়ান্ত নয় বলে জানিয়েছেন আইইডিসিআরের পরিচালক এবং টেকনিক্যাল কমিটির সদস্য ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা৷ লাখে ৩০ না ৬০ জন তাও এখনো আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে৷ ঢাকার পূর্ব রাজাবাজার লকডাউন করা হয়েছে পরীক্ষামূলকভাবে৷ তার ফল দেখেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে৷
তিনি জানান, ‘‘ঢাকার লকডাউনের ব্যাপারে স্বাস্থ্য মহাপরিচালক সিদ্ধান্ত নেবেন৷ আর ঢাকার বাইরে সিভিল সার্জন৷ তবে পুরো প্রক্রিয়া কী হবে তা এখনো আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে৷’’
বিভ্রান্তিতে সিভিল সার্জনরা
দেশের রেড জোন নির্ধারণ করা হয়েছে ২০১১ সালে সর্বশেষ আদমশুমারির ভিত্তিতে৷ কিন্তু গত ৯ বছরে জনসংখ্যা আরো অনেক বেড়েছে৷ নারায়ণগঞ্জ পৌর এলাকার পুরোটাই রেড জোন৷ নারায়ণগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘‘লকডাউনের সিদ্ধান্ত আমি নিতে পারি, কিন্তু জনসংখ্যাইতো ঠিক করতে পারছি না৷ ঢাকার বাইরে এক লাখে ১০ জন আক্রান্ত হলে লকডাউন হবে৷ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তো ২০১১ সালের হিসেবে নারায়ণগঞ্জের জনসংখ্যা ২৫ লাখ ধরে রেড জোন ঘোষণা দিয়েছে৷ কিন্তু বাস্তবে এখন তো জনসংখ্যা এর দ্বিগুণ৷ তাহলে তো আর এটা রেড জোন হয় না৷’’
‘‘আর সর্বশেষ ১৪ দিনে আক্রান্তের হিসেব করলে আক্রান্ত তো অনেক কম৷ আমি কিসের ভিত্তিতে লকডাউন করব৷ তারপরও আলাপ আলোচনা করছি,’’ বলেন ডা. ইমতিয়াজ আহমেদ৷