‘রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কৌশল পরিবর্তন করা দরকার'
২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪এসব বিষয়েই ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন এক সময় মিয়ানমারে বাংলাদেশ দূতাবাসে সামরিক আ্যটাশে হিসেবে কাজ করা সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) এম শহীদুল হক৷
ডয়চে ভেলে: বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের আপতত কোনো সম্ভাবনা দেখছেন?
মেজর জেনারেল (অব.) এম শহীদুল হক : আমি এমন কোনো সম্ভাবনা দেখছি না যে রোহিঙ্গারা দ্রুত তাদের দেশে ফেরত যেতে পারবে। ওখানে অন গ্রাউন্ডে অনেকগুলো জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এক নাম্বারে আরাকান। ওখানে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে অনেক বড় এলাকা চলে গেছে। আর আরাকান আর্মি কিন্তু রাখাইন বুদ্ধিস্টদেরই একটা এক্সটেনশন। ওদের পলিটিক্যাল পার্টিও কিন্তু তাদের এক্সটেনশন। তারা এখন রাখাইনে খুবই পাওয়ারফুল।
তারা কি রোহিঙ্গা বিরোধী?
পুরো জনগোষ্ঠী না। কিন্তু তারা মাঝেমধ্যে টেকনিক্যালি তাদের ন্যাশনাল ইন্টারেস্টের দিকে খেয়াল রেখে কথা বলে। আরাকান আর্মি এবং ওদের রাজনৈতিক দল ইউএনপি বা এআইপির সম্মতি ছাড়া কোনোভাবেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ তো অনেক দিন ধরেই কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে। আপনার বিবেচনায় কার্যকর কূটনৈতিক তৎপরতা কি হচ্ছে?
২০১৭ সাল থেকে ২০২৪ সালে এসে এখন আমি বলবো, আমরা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে যে পলিসি ফলো করছি এতদিন ধরে, এটা পরিবর্তন করা দরকার। এটা তো কোনো কাজে আসছে না।
আমাদের পলিসি তো দ্বিপাক্ষিক। সেটা এখন কীভাবে পরিবর্তন করা দরকার?
হ্যাঁ দ্বিপাক্ষিক। তবে আমি শুরুতেই বলেছিলাম এটা বহুপাক্ষিক করা দরকার। ২০১৭ সাল থেকে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের যে দ্বিপাক্ষিক ডিলগুলো, সেগুলো যদি পর্যবেক্ষণ করেন, তাহলে দেখবেন সেগুলো কোনো কাজে আসেনি। তারা কোনো ট্রাস্টেড পার্টনার না। থার্ড পার্টিকে সঙ্গে রেখে ডিলটা করা উচিত।
মিয়ানমারকে বাংলাদেশ আট লাখের মতো রোহিঙ্গার তালিকা পাঠিয়েছে। তার মধ্যে মাত্র ৩৭ হাজারের মতো তারা কনফার্ম করেছে। মিয়ানমার তো এখন পর্যন্ত একজনও ফেরত নেয়নি। সমস্যাটি কোথায়?
মিয়ানমার ১৯৮২ সালে যে নাগরিকত্ব আইন করেছে তা তো নাগরিকত্ব দেয়ার জন্য না। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব থেকে বাদ দেয়ার জন্য। ওই আইন সংশোধন না করলে হবে না। ওরা ভ্যারিফিকেশন কার্ড দেবে। ওটা কিন্তু নাগরিকত্বের কার্ড নয়। ওটা দিয়ে রোহিঙ্গারা সেখানে গিয়ে থাকতে পারবে। পূর্ণ নাগরিক অধিকার পাবে না।
রোহিঙ্গারাও তো পূর্ণ নাগরিকত্ব না পেলে মিয়ানমারে ফেরত যেতে চায় না। এটাও তো একটা সমস্যা...
জ্বী। ভ্যারিফিকেশন কার্ড দিয়ে রোহিঙ্গারা সেখানে গিয়ে থাকতে পারবে, পূর্ণ নাগরিক অধিকার পাবে না। বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারবে না, বার্থ রেজিস্ট্রেশন করতে পারবে না, ম্যারেজ রেজিষ্ট্রেশন করতে পারবে না. নাগরিক সুবিধা পাবে না। ২০১৯ সালে মিয়ানমারে সর্বশেষ আদমশুমারীতে শতকরা এক ভাগ মুসলিম দেখানো হয়েছে রাখাইনে। কিন্তু সেখানে মুসলিম ৩৫ ভাগ। বাকিদের অন্যান্য ক্যাটাগরিতে দেখানো হয়েছে। এটা পরিস্কার যে, তারা আসলে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে চায় না।
মিয়ানমারে এখন যে যুদ্ধ চলছে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে তাতে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আমাদের সমস্যা কি আরো বাড়বে?
এখানে নানা ইন্টারেস্ট গ্রুপ আছে। অ্যামেরিকার স্বার্থ আছে। ভারত ও চীনের স্বার্থ আছে। যার যার স্বার্থ অনুযায়ী এই পরিস্থিতিতে তারা সক্রিয় আছে। কিন্তু আমার আশঙ্কা হলো, পালাতাও নামে একটা জায়গা আছে, যেটা আরাকান আর্মি দখল করেছে। এটা আমাদের বান্দরবন থেকে কাছে। তবে এখন পর্যন্ত মিয়ানমার- বাংলাদেশের সীমান্ত মিয়ানমারের দিকে মিয়ানমার সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে। এখন এই বর্ডারটাও যদি আরাকান আর্মিও হাতে চলে যায় তাহলে তারা কিন্তু ভিতরে অপারেশন আরো বিস্তৃত করবে । তখন কিন্তু আরো অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসার আশঙ্কা আছে। এটা বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় ঝুঁকির কারণ হবে।তখন আবার আমরা না সামরিক ও জিও পলিটিক্যালি ইনভলব হয়ে যাই সেটাও বড় আশঙ্কা।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা কমে যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে তাদের আগ্রহ কি কমে যাচ্ছে?
রেশন কমে এখন আট ডলার হয়েছে। এখন তারা ইউরোপের শরণার্থীদের নিয়ে বেশি মনোযোগী। ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা কারণে ইউরোপে শরণার্থী বাড়ছে। আমাদের পলিসি পরিবর্তন না করলে এই আগ্রহ আরো কমতে থাকবে। রোহিঙ্গাদের কারণে আমাদের পরিবেশ, প্রতিবেশ, নিরাপত্তা সংকটে আছে। আর্থিক চাপ তো আছেই। আমরা এক মিলিয়ন মানুষের বোঝা কাঁধে নিয়ে আছি।
আমাদের নিরাপত্তায় কী প্রভাব ফেলছে?
এখানে রোহিঙ্গাদের নানা গ্রুপ আছে। তার মধ্যে আরসা কিন্তু মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হয়ে কাজ করে। রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে মেরে ফেলা হলো কেন? কারণ, সে চাচ্ছিল রোহিঙ্গাদের নিয়ে মিয়ানমারে ফিরে যেতে। আরসা কিন্তু প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধে। তাই যারাই ফিরে যেতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় আরসা। আরসা ক্যাম্পগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে। এটা আমাদের জন্য হুমকি।