রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কেন তৎপর চীন?
২৮ মে ২০২৩বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু করার জন্য ঢাকাকে পরামর্শ দিচ্ছে চীন৷ গত কয়েক মাসে দুইবার সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে বেঠক করেছে চীনের কূটনীতিকেরা৷ আর প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় দুই দেশকেই সর্বাত্মক সহায়তা করার কথা জানিয়েছে দেশটি৷
অবশ্য বাংলাদেশও দ্রুতই রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে আগ্রহী৷ তবে প্রত্যাবাসন যেন টেকসই, নিরাপদ ও স্বেচ্ছায়হয় তা নিশ্চিত করতে চায় বাংলাদেশ৷
তবে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে চীনের এই তৎপরতা এ অঞ্চলের ভূরাজনীতি নিয়ে দেশটির কৌশলের অংশ বলেই মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক৷ রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া সতকর্তার সঙ্গে বিবেচনার জন্য বাংলাদেশ সরাকারের প্রতি পরামর্শ তাদের৷
চীনের সাম্প্রতিক তৎপরতা
বাংলাদেশ সফররত চীনা ভাইস মিনিস্টার সুন ওয়েইডং বাংলাদেশকে দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানা গেছে৷ শনিবার বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন এবং চীনা ভাইস মিনিস্টার সুন ওয়েইডং-এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় দুই ঘন্টারও বেশি সময় ধরে বৈঠক হয়৷ বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি প্রধান্য পায়৷
চলতি বছরের শুরুতে পাইলট প্রকল্পের আওতায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে জোর দেয় চীন৷ এপ্রিল মাসে ঢাকায় আসেন মিয়ানমার বিষয়ক চীনের বিশেষ দূত দেং সুজুন৷ তখন তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন এবং পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন৷
এরপর ১৮ এপ্রিল চীনের কুনমিংয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমার-চীনের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়৷ বৈঠকে এক মাসের মধ্যে এক হাজার ১৭৬ জন রোহিঙ্গাকে পাইলট প্রকল্পের অধীনে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর সিদ্ধান্ত হয়৷
ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ৫ মে রোহিঙ্গাদের একটি প্রতিনিধি দল মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য ঘুরে আসে৷ ২৫ মে মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধি দল কক্সবাজারে এসে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে যায়৷
শনিবার ঢাকায় পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে বৈঠকে চীনা ভাইস মিনিস্টার সুন ওয়েইডং বলেছেন, কুনমিংয়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে আলোচনায় যে প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে সেই প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করে সমস্যা সমাধানে এগিয়ে যেতে হবে৷ তিনি বলেন, শুরুর সংখ্যা যেটাই হোক না কেন প্রত্যাবাসন শুরু হওয়া জরুরি৷
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনার জন্য দুই মাসের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো বেইজিং থেকে সিনিয়র কর্মকর্তাদের এটি দ্বিতীয় ঢাকা সফর৷ এর আগে গত জানুয়ারিতে ঢাকায় সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতি করেছিলেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিন গ্যাং৷
বিশ্লেষকরা যা বলছেন
মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক সামরিক অ্যাটাশে ও সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল(অব.) শহীদুল হক মনে করেন, ‘‘চীন স্বল্প পরিসরে হলেও রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন শুরু করতে চাইলেও মূল সমস্যা থেকেই যাচ্ছে৷ আর তা হলো রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব৷ ওরা যে ভেরিফিকেশন কার্ড দেবে বলছে এটা নাগরিকরত্বের কার্ড না৷ এটা যে নাগরিকত্বের কার্ড হবে তার নিশ্চয়তা দরকার৷ আর যেখানে রোহিঙ্গাদের নিয়ে রাখবে , আমার ২০১২ সালের অভিজ্ঞতায় বলছি সেটা বসবাসের উপযোগী নয়৷’’
তিনি মনে করেন, ‘‘ইন্টারন্যাশানাল কোর্ট অব জাস্টিসে( আইসিজে) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যে সাবমিশন আছে চীন চাইছে সীমিত পরিসরে প্রত্যাবাসন শুরু করে মিয়ানমারকে রিলিফ দিতে৷ চীন চাইছে না এই প্রত্যাবাসনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো দেশ মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলে প্রবেশ করুক৷ যদি ইউএনএইচসিআর বা আন্তর্জাতিক এনজিও ওই অঞ্চলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর আগে সার্বিক পরিস্থিতি দেখতে যায় তাহলে সেটা চীনের কন্টোলের বাইরে চলে যেতে পারে৷ তাই চীন দ্রুত, এটা ছোট পরিসরে হলেও প্রত্যাবাসন শুরু করতে চায়৷’’
তার কথা, ‘‘বাংলাদেশেন সবকিছু দেখে শুনে এগোতে হবে৷ টার্মস এন্ড কন্ডিশনগুলো বুঝতে হবে৷ নয়তো পরে দেখা যাবে তারা অল্প কিছু রোহিঙ্গা নিয়ে আর নিচ্ছে না৷ তখন আমরা বিপাকে পড়ে যাব৷’’
‘‘আরেকটি বিষয় হলে রোহিঙ্গাদের জন্য প্রয়োজনীয় মূল অর্থ আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে৷ তাই তাদের সঙ্গেও আলাপ হওয়া দরকার৷ নয়তো তারা যদি অর্থ দেয়া বন্ধ করে দেয় তাহলে আরেকটি সংকট হবে,’’ মনে করেন এই কূটনীতিক৷
তবে চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ মনে করেন, ‘‘সংখ্যায় কম হোক আর বেশি হোক রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হওয়াটা খুব জরুরি৷ একবার শুরু হলে এটা এগিয়ে নেয়া যাবে৷ চীন ছাড়া এখন পর্যন্ত তো কেউ প্রত্যাবাসনের জন্য এগিয়ে আসেনি৷ গত ছয় বছরে তো একজনকেও ফেরত পাঠানো যায়নি৷ তাই ১০-১২ জন করে প্রত্যাবাসন শুরু হলেও প্রক্রিয়াটা জোরালো স্বীকৃতি পাবে৷ তখন হয়তো আরো এগিয়ে নেয়া যাবে৷ চীন এখন যেটুকো করছে পরে তার চেয়ে বেশি করতে পারলে আরো ভালো৷’’
তবে তিনি মনে করেন, ‘‘এর টার্মস এন্ড কন্ডিশনসগুলো প্রকাশ করে কাজ শুরু করা উচিত৷ যাতে পরে ধরা যায়৷ আর এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক গ্যারান্টি ক্লজ থাকতে হবে৷’’
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘চীনের মধ্যস্থতায় এখন প্রত্যাবাসন শুরু হলে কেউ সরাসরি বাগড়া দিতে আসবে না৷ তবে মার্কিন যুক্তনরাষ্ট্রসহ অন্য দেশ সবকিছু দেখতে চাইতে পারে৷ বলতে পারে এটা এভাবে নয়, ওভাবে করতে হবে৷ তাতে আমাদের অসুবিধা নেই৷ তাতে প্রত্যাবাসন আরো ভালো হতে পারে৷’’
তার মতে, যারা দূর থেকে এই বিষয়টি দেখছে বা এটা নিয়ে খেলতে চায় তাদেরও বাংলাদেশকে সহায়তার সুযোগ আছে৷
ওখানে (মিয়ানমারে) তো জান্তার বিরুদ্ধে একটা গৃহযুদ্ধ চলছে সেই মনোভাবকে তারা আরো উসকে দিতে পারে৷ এতে তারা আরো চাপে পড়বে৷ তাদের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা আছে৷ আবার আরাকান আর্মি তো রোহিঙ্গাদের সব অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার কথা বলছে৷ তাদেরও সহায়তা করা যায়৷ এটা বাংলাদেশ করবে না৷ তবে অন্যরা কৌশলে করতে পারে৷''
প্রসঙ্গত, জাতিসংঘের হিসেবে বাংলাদেশে এখন ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে৷ বাংলাদেশ এপর্যন্ত নয় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর তালিকা মিয়ানমারকে দিয়েছে বলে ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন শরণার্থী , ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াত৷ তা থেকে এখন পর্যন্ত ২৯ হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ তাদের নাগরিক বলে নিশ্চিত করেছে৷