রূপগঞ্জ ট্রাজেডির চারতলায় হারানো মানুষেরা
ঘটনার সাত দিন পর কারখানাটির আশেপাশে বসবাস করা কয়েকজনের সাথে কথা বলে এই গ্যালারি বানিয়েছেন প্রতিবেদক।
টেকা দিয়া আমরা কি করমু স্যার
আগুনের খবর পাওয়ার পরপরই কিশোরগঞ্জ থেকে চান্দু মিয়া তার মেয়ে রাবেয়া খাতুনের খোঁজে এসে বলেন, “স্যারের এক শিশি রক্ত নিসে কি নাকি পরীক্ষা করবো লাশের লগে। শুনসি সরকার দুই লাখ কইরা টেকা দিব যারা মারা গেছে অগো রে। কিন্তু মাইয়া না থাকলে এইসব দিয়া কি করুম? টেকা দিয়া তো মাইয়া ফেরত আইব না।”
আমার মাইয়াটা অর মা রে হারাইলো
পেশায় রিকশাচালক মোঃ সেলিম মিয়া হাশেম ফুডসের কারখানায় এসেছেন ক্ষতিপূরণের অর্থপ্রাপ্তির জন্য বিস্তারিত জানতে। তিনি জানান তার স্ত্রী অমৃতা বেগম ৮ তারিখের পর থেকে নিখোঁজ। তাদের আড়াই বছরের এক মেয়ে আছে জানিয়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, “আমার মাইয়া অর মা রে হারাইলো, এ ক্ষতি কেমনে পোষামু আমি?”
এক মাইয়া ফেরত আইছে, আরেকটা আহে নাই
হাফসা বেগমের পাঁচ সন্তানের মধ্যে দুই মেয়ে কাজ করতেন হাশেম ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ কারখানায়। সকালের শিফটে কাজ করে বড় মেয়ে বাড়ি ফিরলেও বিকালের শিফটে কাজ করা ১৫ বছরের ফাতেমা বেগম আর আসেননি। কেন এত ছোট মেয়েকে কাজে পাঠিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “অভাবের তাড়নায় দিছি। অর বাপের পানের দোকানের আয় দিয়া সংসার চলে না। তাই বড় দুই মাইয়ারে কামে লাগাইছিলাম।“
ইস্কুল বন্ধ, তাই কামে দিছিলাম মাইয়াটারে
পেশায় কাঠমিস্ত্রী মুইরা চরণ সরকার জানান, এই কারখানায় পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা বেতনে কাজে দিয়েছিলেন ১৫ বছরের মেয়ে শেফালি সরকারকে। গত দেড় বছর ধরে করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় মেয়েকে এখানে দিয়েছেন। এখানে কাজ করতে দিয়ে ছোট মেয়েকে এভাবে হারাবেন, কল্পনাও করেননি বাবা।
নাতিনে খালি মায়ের কথা জিগায়
হাশেম ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ কারখানায় এক বছর ধরে কাজ করেন ২৪ বছর বয়সী সুফিয়া বেগম। দূর্ঘটনার দিন থেকে তার কোন খোঁজ মেলেনি। সুফিয়ার মা রহিমা আক্তার জানান, তার মেয়ের চার বছরের মেয়ে রয়েছে। কিছুক্ষণ পরপর নাতনি শুধু তার মায়ের কথা জিগাস করে। তিনি বুঝতে পারছেন না এ অবুঝ শিশুকে কিভাবে বোঝাবেন।
মানুষের জীবনের দাম দুই লাখ টাকা?
মাছ ব্যবসায়ী প্রভা বর্মণ তার ১৫ বছরের মেয়েকে এ কারখানায় কাজে দিয়েছেন এক মাস হলো। এখানে চতুর্থ তলায় কাজ করতেন মেয়ে কম্পা রানী বর্মণ। ক্ষতিপূরণের টাকার ব্যাপারে ক্ষোভের সুরে তিনি বলেন, “আজকার বাজারে একটা গরুর দাম অই ১৫ লাখ টেঁকা। আর সেই জায়গায় মানুষ মাইরা ফালাইলো, তার জীবনের দাম নাকি মাত্র দুই লাখ?”
বইনের লাশটা খালি চাই
পেশায় হোটেল কর্মচারী রুবেল হোসেন বলেন, তার মামাতো বোন আমেনা বেগম সেজান জুস কারখানায় কাজ করতেন তিন বছর ধরে। মূলত ছয় তলায় কাজ করলেও কয়েকদিনের জন্য চার তলায় নিয়ে যাওয়া হয় তাদের কয়েকজনকে। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, “জানি বইন আর ফেরত আইব না, এখন খালি তার লাশটা ফেরত চাই আমরা।“
বেতন বোনাস কিছু পাই নাই
ক্ষতিপূরণের টাকা দাবি করে হাশেম ফুডসের কারখানার গেটে সস্ত্রীক পাওয়া গেল বাচ্চু মিয়াকে যিনি মেয়ে তাসলিমা আক্তারকে হারিয়েছেন। ক্ষোভের সুরে তিনি বলেন, “মাইয়ার এক মাসের কামের বেতন বোনাসের টেকা কিছু দেয় নাই আমাগোরে। যারা বাইচা আছে, হেরা খালি টেকা পাইছে। যারা মারা গেছে, কেউই এহনো এইসব পায় নাই বইলা হুনছি।”
মরণে টাইনা নিয়া গেছিল ঐ বিল্ডিংয়ে
১৫ বছর বয়সী ফারজানা আক্তার কাজ করতেন হাশেম ফুডসের একটি ভবনের ৬ তলায়। করোনার কারণে কাজ কম থাকায় আগুন লাগা ভবনের ৪র্থ তলায় তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় দিন সাতেক আগে। ফারজানার খালাতো বোন আসমা বলেন, “বইনরে সরায় না নিলে আজকা এই অবস্থা হইতো না তার। মরণই আমার বইনরে ঐ বিল্লিংয়ে লয়া গেসে।“
মাইয়া আমার কারো সাথে পাচে আছিল না
১৬ বছর বয়সী ইসরাত জাহান তুলি মাত্র দেড় মাস হলো হাশেম ফুডসের কারখানায় কাজ শুরু করেছেন। তুলির মা জহুরা বেগম কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, “আমার মাইয়াডা এতো লক্ষ্মী আছিল, কি কমু। পর্দা করতো, বাইরের কারো লগে তেমন কথা কইতো না। হেই সোনার টুকরা মাইয়া আমার বুকে আজ নাই, আল্লাহ লয়া গেছে হেরে।“
মামলা তুলে নেওয়ার চাপ
হাশেম ফুডস অ্যান্ড বেভারেজের প্রধান ফটকের সামনে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে নিখোঁজ কয়েকজনের আত্মীয় বসে আছেন। সাংবাদিক দেখে এগিয়ে এসে তারা বলেন, যারা বেঁচে আছেন এবং যারা নিহতের স্বজন, তাদেরকে মালিকপক্ষের লোকেরা চাপ দিয়েছেন যেন তারা মালিকের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য আন্দোলন করেন। তাহলে হয়ত তারা বকেয়া বেতন বোনাসের টাকা পেতে পারেন।
গত ৮ জুলাই বৃহস্পতিবার নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাশেম ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত উদ্ধারকৃত ৫২ টি মরদেহের মধ্যে ৪৭ টি মরদেহ ই পাওয়া গেছে চতুর্থ তলায়। কেন এক ফ্লোরেই এতো হতাহত জানতে চাওয়া হলে ফ্যাক্টরিটির অপারেটর সুজন মিয়া বলেন, “তৃতীয়-পঞ্চম তলার ফ্লোর ইনচার্জের ভুল নির্দেশনাতেই চতুর্থ তলার কেউ বের হননি, আর নিচ তলার আগুন চারতলা পর্যন্ত পৌঁছাবে এটা কারও ধারণা ছিল না, যার ফলে এক ফ্লোরেই এতো মানুষ মারা গেসে বলে শুনসি।“ ঘটনার সাত দিন পর এই প্রতিবেদক কারখানাটির আশেপাশে বসবাস করা কয়েকজনের সাথে কথা বলেছেন।