রুশ সীমান্তে ন্যাটোর যুদ্ধজাহাজ
৩০ নভেম্বর ২০২১'আমাদের জন্য অনেকেই রাতে ঘুমাতে পারেন না'। ন্যাটোর ক্ষমতা প্রসঙ্গে এমনটাই মনে করেন মার্কিন মেরিন কর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাইমন ডোরান। মার্কিন প্রতিনিধি হিসাবে ব্রিটিশ কেরিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ ২১ (বা সিএসজি২১) প্রকল্পে কাজ করেন ডোরান। এই প্রকল্পটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় যুদ্ধবিমানবাহী জাহাজের দলের তালিকায় পঞ্চম।
বর্তমানে, এই বিশাল আকারের জাহাজের দলটি যুক্তরাজ্যের দিকে ফিরছে। ঘরে ফেরার আগে চল্লিশ হাজার নটিক্যাল মাইল পথ পেরিয়েছে তারা। সিএসজি২১ দলের একেবারে মাঝে রয়েছে এইচএমএস কুইন এলিজাবেথ জাহাজ।
সিএসজি ২১ তার যাত্রাপথে কখনো ইসলামিক ষ্টেট বা কখনো চীনা সাবমেরিনের সাথে পাল্লা দিয়েছে। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি কালো সাগরে মহড়া সেরে আসা এই জাহাজগুলি প্রয়োজনে যেকোনো স্থানে গিয়ে লড়তে প্রস্তুত, নিশ্চিত করলেন ডোরান।
তিনি বলেন, "শুধু সম্ভাব্য শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তেই নয়, প্রয়োজনে আমাদের মিত্রদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারি আমরা। আমাদের বিমানবাহী জাহাজে রয়েছে বহু হালনাগাদ প্রযুক্তির যুদ্ধবিমান। মূল জাহাজটি রয়েছে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন যুদ্ধজাহাজের চক্র দিয়ে ঘেরা। ফলে, এটা নিয়ে সবাই চিন্তিত।"
যে কারণে চিন্তিত ন্যাটো
কিন্তু জুন মাসে কালো সাগরে মহড়ার পর থেকে ওই স্থানেই নতুন করে দানা বাঁধছে রুশ-ইউক্রেন চাপানউতোর। এই সংকটের প্রভাব পড়ছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, ন্যাটো ও মিত্রশক্তিগুলির ওপরেও।
পোলিশ প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেজ দুদা সম্প্রতি বেলারুশ-পোলিশ সীমান্তে চলা অভিবাসী সংকটের সাথে ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটের সম্পৃক্ততা থাকার কথা বলেন। গত সপ্তাহে ন্যাটো'র প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে তিনি আকাশপথে টহল আরো জোরদার করার কথা বলেন। পাশাপাশি, ন্যাটো-সদস্য রাষ্ট্রগুলির পূর্বদিকে, অর্থাৎ পোলিশ-বেলারুশ সীমান্তের কাছে, নজরদারি, সুরক্ষা ব্যবস্থা ও সামরিক বাহিনীর প্রস্তুতি জোরদার করতেও আহ্বান জানিয়েছেন দুদা।
ফলে মঙ্গলবার ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্রগুলির পররাষ্ট্র মন্ত্রীরা যখন বৈঠকে বসবেন, সেখানে আলোচিত হবে এই সব 'হাই ভোল্টেজ' ইস্যু।
লাটভিয়ার রাজধানী রিগায় অনুষ্ঠিত হতে চলা এই বৈঠক বিষয়ে শনিবার ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল ইয়েনস স্টোলটেনবের্গ বলেন যে এই নিয়ে "দ্বিতীয়বারের মতো, রাশিয়া এই অঞ্চলে বিরাট সংখ্যায় সামরিক সদস্যদের মোতায়েন করেছে। সাথে প্রস্তুত করেছে ট্যাংক, ড্রোনসহ নানা অত্যাধুনিক যুদ্ধের সরঞ্জাম।"
ন্যাটোর সতর্কতার পরিণাম
স্টোলটেনবের্গের মতে, রাশিয়া যা করছে তার কোনো যৌক্তিকতা নেই এবং এতে করে শুধুই চাপ বাড়ছে। রাশিয়াকে সতর্ক করে তিনি বলেন যে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিলে তার ফল ভোগ করতে হবে রাশিয়াকে।
কিন্তু কূটনীতির হিসাবে গোলমাল হলে রাশিয়াকে পিছু হঠানোর বদলে ন্যাটোর যাতে কোনো ক্ষতি না হয়ে যায়, সেবিষয়েও সতর্ক এই জোট। যদিও ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্ররা একমত যে রাশিয়ার সম্ভাব্য সামরিক পদক্ষেপ কোনোমতেই মেনে নেবে না তারা। কিন্তু বিষয়টি এতটা সহজ নয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক উচ্চপদস্থ ন্যাটো কর্তার মতে, "আমরা যদি বলি যে রাশিয়া এমন কিছু করলে তার ফল ভোগ করতে হবে, সেক্ষেত্রে আমাদের আগে স্পষ্ট করে বলতে হবে যে সেই ফলাফলগুলি কী কী। অন্যদিকে, আমরা চাইনা যে এমন কিছু করা হোক, যাতে করে যেদিকে ন্যাটো চায় এই পরিস্থিতি যাক, তার বদলে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি স্থানে গিয়ে বিষয়টি দাঁড়াক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কীভাবে আমরা সঠিক দিকগুলি চিহ্নিত করব, এবং কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাব যাতে করে পরিস্থিতি আরো জটিল না হয়ে সহজ হয়।"
কত দিন ঠেকানো যাবে সংকট?
ন্যাটোর কূটনীতিকরা যদিও এখন পর্যন্ত পরিস্থিতিকে তাদের পক্ষেই দেখছেন, কিন্তু ভবিষ্যৎ কেমন হবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। রাশিয়া ইতিমধ্যে সামরিক হাসপাতাল গড়া শুরু করেছে, যা বুঝিয়ে দিচ্ছে, হয়ত সংঘর্ষ আসন্ন।
বিশেষজ্ঞ লড়েন স্পেরানজার মতে, ন্যাটো চাইলে আরো জোরদারভাবে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত ও পুটিনকে এখনকার চেয়ে বেশি চাপে রাখাও সম্ভব হতো। তার বক্তব্য, "রাশিয়ার হাইব্রিড প্রচারণা চারদিকে বিস্তৃত এবং কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখানোটাই যথেষ্ট নয়।"
রাশিয়াকে কড়া বার্তা দিতে ইইউ এর আরো 'সংগঠিত প্রতিক্রিয়া' দেখানো উচিত বলে মনে করেন তিনি। সাইবার কূটনীতি, প্রাতিষ্ঠানিক কূটনৈতিক চাপ ও রুশ সম্পত্তি আটকে দেওয়ার মতো পন্থার সপক্ষে যুক্তি রাখেন তিনি।
আরেক বিশেষজ্ঞ অলগা লাউটমানের মতে ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্রের নেতৃত্বের অবিলম্বে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিনের প্রশংসা করা বন্ধ করতে হবে। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, "পশ্চিমা বিশ্বের কাছে পুটিন একজন গ্র্যান্ড স্ট্র্যাটেজিস্ট বা মহান কোনো রাজনৈতিক পরিচালক। কিন্তু আসলে তিনি তা নন। বর্তমানে পুটিন আমাদের পরীক্ষা করে দেখছেন আমরা আদৌ এবিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছি কি না। একই সাথে আমার ধারণা যে পুটিন আসলে যাচাই করে দেখছেন যে কত দূর পর্যন্ত কোনো আপোষ বা বৈঠক না করেই তিনি এগিয়ে যেতে পারেন। এখনই সময় তাকে একা করে ফেলবার।"
ভবিষ্যৎ অস্পষ্ট হলেও, এইচএমএস কুইন এলিজাবেথে থাকা ন্যাটো বাহিনী ক্রেমলিনের উদ্দেশ্যে দৃঢ়ভাবে তাদের বার্তা দিয়ে যাচ্ছেন। ইউরোপে ন্যাটোর ডেপুটি সুপ্রিম অ্যালাইড কমান্ডার জেনারেল টিম রাডফোর্ডের মতে, "এই জাহাজ ও বিমান নিয়ে যে আমরা কালো সাগর পেরিয়ে এসেছি, সেটাই প্রমাণ করে দেয় যে ইউরো-আটলান্টিক অঞ্চলের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে ন্যাটো। এই অঞ্চলে সার্বক্ষণিক নজরদারি চালাচ্ছি আমরা, তা সেটা উত্তর, দক্ষিণ যে কোনো প্রান্তেই হোক না কেন। এমনকি তা খোদ কালো সাগরে হলেও।"
টেরি শুলৎজ/কেএম