রাজনৈতিক ‘খেলায়' জঙ্গিরা
২১ আগস্ট ২০১৫বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার প্রথম বড় ঘটনা ২০০১ সালে রমনা বটমূলে পহেলা বৈশাখে ছায়ানটের বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলার মধ্য দিয়ে৷ এরপর পল্টনে সিপিবি-র সমাবেশে বোমা হামলা হয়৷ তারও পরে ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে তখনকার বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনার সমাবেশ স্থলে গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নিহত হন৷
এর পরের বছর ১৭ই আগস্ট দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা হামলা চালায় জমিয়তুল মুজাহেদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)৷ জেএমবি-র আরেকটি শাখার নাম জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি)৷ এরপর তারা আদালত এলাকায় হামলা চালিয়ে বিচারক হত্যাসহ আরো হত্যাকাণ্ড ঘটনায়৷
২০০১ এবং ২০০৪ সালের বোমা এবং গ্রেনেড হামলার পরই জানা যায় হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের নাম৷ তার প্রধান মুফতি হান্নান এখন কারাগারে৷ আর জেএমবি ও জেএমজেবি-র দু'জন নেতা শায়খ আব্দুর রহমান এবং বাংলা ভাইকে বিচারক হত্যা মামলায় ফাঁসি দেয়া হয়েছে৷
বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে গ্রেনেড হামলা মামলার অন্যতম আসামি বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার ছেলে ও দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৮ জন আসামি আজও পলাতক৷ সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও মুফতি হান্নানসহ অন্য আসামিরা আছে কারাগারে৷ এই মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমান ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘মামলাটির বিচার কাজ চলছে৷ ডিসেম্বরের মধ্যেই বিচার শেষ হবে বলে আশা৷'' তিনি আরো দাবি করেন, ‘‘মামলার তদন্ত এবং সাক্ষ্য প্রমাণে এটা স্পষ্ট যে, জঙ্গিরা তখনকার বিএনপি সরকারের ছত্রছায়ায় গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে৷''
এছাড়াও অভিযোগ রয়েছে ময়মনসিংহ অঞ্চলে চরমপন্থি আন্দোলন দমনে তখনকার মন্ত্রী-এমপিদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই জেএমবি-র উত্থান৷ তখনকার মন্ত্রী জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী বাংলা ভাইয়ের পক্ষ নেন৷
২০১৩ সালে শাহবাগে গণজাগারণ মঞ্চের আবির্ভাব থেকে জঙ্গিদের নতুন ধরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ হরকাতুল জিহাদ এবং জেএমবি বাদে শোনা যাচ্ছে এক নতুন নাম – আনসারুল্লাহ বাংলা টিম৷ তারা ব্লগার ও মুক্ত চিন্তার মানুষকে হত্যার মিশনে নেমেছে৷ এ পর্যন্ত তারা পাঁচজন ব্লগারকে হত্যা করেছে৷ তারা আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, আনসার বাংলা সেভেন, আনসারুল্লাহ, আনসার বিডি, আনসার আল-ইসলামসহ নানা নামে কাজ করছে৷ পুলিশের দাবি, তাদের প্রধান মুফতি জসিম উদ্দিন রাহমানি কারাগারে থাকলেও সেখানে বসেই নিয়ন্ত্রণ করছেন জঙ্গি কার্যক্রম৷
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পুলিশের দৃষ্টি এড়ানোর জন্যই ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম' আলাদা আলাদা গ্রুপে বিভক্ত হয়েছে৷ বিভাজিত গ্রুপের কারণে সবাইকে নজরদারির মধ্যে রাখা যাচ্ছে না৷ তাছাড়া এক গ্রুপের সদস্যদের খবর অন্য গ্রুপের কাছে পাওয়া যায় না৷ এমনকি কেউ কারো নামও বলতে চায় না, যা জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে৷''
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক নূর খান বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা নিয়ে কাজ করছেন দীর্ঘদিন ধরে৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতার উত্থানের পিছনে রাজনৈতিক মদদ ছিল৷ তবে এখন তারা নিজেদের পায়ের নীচে মাটি খুঁজে পেয়েছে৷ তারা আগের চেয়ে এখন আরো শক্তিশালী এবং কৌশলী৷''
তিনি বলেন, ‘‘আগে জঙ্গিরা একটি বিশেষ শ্রেণি থেকে আসত৷ কিন্তু এখন তারা সবখানে ছড়িয়ে গেছে৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক এমনকি প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরাও জড়িয়ে যাচ্ছেন৷''
তাঁর মতে, ‘‘এখন প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতেও জঙ্গি তৎপরতার কল্পিত অভিযোগ আনা হচ্ছে৷ জঙ্গিদের নিয়ে রাজনৈতিক খেলা এখনো থামেনি৷ আর এই খেলার কারণেই জঙ্গিরা আরো শক্তিশালী হচ্ছে৷'' নূর খান বলেন, ‘‘জঙ্গিদের নিয়ে রাজনৈতিক খেলা বন্ধ না হলে তারা বিস্তৃত হতেই থাকবে৷''
প্রসঙ্গত, এ পর্যন্ত বাংলাদেশে ৬টি জঙ্গি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷ সংগঠনগুলো হলো – হরকাতুল জিহাদ, জেএমবি, জেএমজেবি, শাহদাত ই আল-হিকমা, হিজবুত তাহরির এবং আনসারুল্লাহ বাংলা টিম৷ কিন্তু তাতে জঙ্গি তৎপরতা থামার কোনো লক্ষণ নেই৷