রাজনীতির অধঃপতনে ভারসাম্যহীন উন্নয়ন
৩১ ডিসেম্বর ২০১৪এ সময়ে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সূচকে অনেক ইতিবাচক দিক দেখা গেলেও, রাজনৈতিক সূচকের অধঃপতন হয়েছে৷ আর নতুন বছরে সেই অস্বস্তি থেকে স্বস্তি নয়, বরং নতুন করে সংঘাতের আশঙ্কাই করা হচ্ছে৷ রাজনৈতিক সংকট ফের সংঘাতে রূপ নেয়ার সব আলামত এখন স্পষ্ট৷ বিশ্লেষকরা বলছেন রাজনৈতিক অধঃপতনের মাধ্যমে বাংলাদেশে এক ভারসাম্যহীন উন্নয়ন ঘটছে, যা আখেরে ভালো নয়৷
যদি প্রশ্ন করা হয়, বাংলাদেশে গত এক বছরে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় কী ছিল? এর জবাব হবে একটিই৷ তা হলো ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন৷ বাংলাদেশে অনেক নির্বাচন হয়েছে৷ কিন্তু সাধারণ মানুষ দিন তারিখসহ যে দু-একটি নির্বাচনের কথা মনে রেখেছে বা রাখবে, তা হলো ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন৷
এই নির্বাচনের আগে এবং নির্বাচনের সময় বাংলাদেশ এক নজিরবিহীন সময় পার করেছে৷ নির্বাচনকে ঘিরে সহিংসতা শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও ব্যাপক আলোচিত হয়েছে৷ প্রধান বিরোধী বিএনপি-জামায়াত জোটের নির্বাচন বর্জনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার একটি একতরফা নির্বাচন করে৷ সেই নির্বাচনে জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩ জন সাংসদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন৷ বাকি ১৪৭ আসনের নির্বাচনে ভোট পড়ে শতকরা ২০ ভাগেরও কম৷ এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য ক্ষমতায় যায়৷
বিএনপি জোটের দাবি ছিল একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন৷ তারা আওয়ামী লীগ, তথা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে কোনো নির্বাচন চায়নি৷ তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চেয়েছিল৷ কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকেই নির্বাচনের ব্যাপারে অনঢ় থাকে৷ প্রসঙ্গত, এর আগে আদালতের রায়ের আলোকে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়৷
নির্বাচনের আগে সংলাপের কথা বলেছিলেন সবাই৷ এমনকি আওয়ামী লীগ-বিএনপিও৷ শেখ হাসিনা ফোনও করেছিলেন খালেদা জিয়াকে৷ আন্তর্জাতিক চাপ ছিল সংলাপের মাধ্যমে সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের৷ জাতিসংঘও উদ্যোগ নিয়েছিল৷ কিন্তু কোনো উদ্যোগই শেষ পর্যন্ত কাজে আসেনি৷
একতরফা নির্বাচনের পর গত এক বছর ধরে আরেকটি নির্বাচনের জন্য দাবি জানিয়ে আসছে বিএনপি৷ তারা আগের অবস্থানেই আছে৷ তা হলো, একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন৷ এ জন্য সংলাপের দাবিও জানাচ্ছে তারা৷ কিন্তু সরকার এখন খুব স্বাভাবিকভাবেই আগের চেয়ে আরো শক্ত অবস্থানে চলে গেছে৷ নির্বাচনের আগে বলা হয়েছিল, এটা সংবিধান রক্ষার নির্বাচন৷ পরে সব দলের অংশগ্রহণে আরেকটি নির্বাচন হবে৷ কিন্তু সেই কথায় সরকার এখন আর নেই৷ তারা বলছে, নতুন নির্বাচনের জন্য এই সরকারের মেয়াদপূর্তি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে৷ তার মানে আরো চার বছর৷ এছাড়া নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে তা তখন দেখা যাবে, বলছে আওয়ামী লীগ৷
অন্যদিকে বিএনপি তার দাবি আদায়ে গত এক বছর ধরে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে৷ নতুন বছরে অবশ্য তারা চাইছে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলতে৷ ২০১৫ সালের ৫ই জানুয়ারিকে সামনে রেখে তারা চাইছে সরকারের ওপর নতুন করে চাপ সৃষ্টি করতে৷ ৫ই জানুযারির আগে ও পরে বিএনপি-র নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোট ঢাকাসহ সারাদেশে বড় ধরণের আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ তবে সরকারও তা ঠেকাতে প্রস্তুত৷
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি তাত্পর্যপূর্ণভাবে উন্নয়নের পথে এগিয়ে গেলেও প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডে পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ৷ ‘শাসন পরিস্থিতি, বাংলাদেশ: গণতন্ত্র, দল, রাজনীতি' শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনটি ডিসেম্বর মাসেই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়৷ তাতে বলা হয়, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কর্মকাণ্ড রাজনৈতিক অগ্রগতির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য অবশ্যই একটা ঝুঁকি৷ এ অবস্থা থেকে উত্তরণে জাতীয় সংলাপই একমাত্র সমাধান৷
গত ২০শে ডিসেম্বর প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে বিআইডিএস-এর গবেষণা পরিচালক ড. বিনায়ক সেন বলেন, ‘‘অর্থনৈতিক উন্নয়ন যদি রাজনৈতিক উন্নয়নকে ছাপিয়ে যায় তাহলে সমাজে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়৷ অর্থনীতি ও রাজনীতির সমান ও সমান্তরাল উন্নয়ন প্রয়োজন৷'' তাই এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ও সহিংসতা বন্ধে আওয়ামী লীগকে সংলাপে বসার ও বিএনপি-কে জামায়াত ত্যাগের আহ্বান জানান তিনি৷
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘‘বহুদলীয় গণতন্ত্রে সব বিষয়ে সব দলের ঐক্য হবে না, এটাই স্বাভাবিক৷ তবে তা হতে হবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়৷ রাজনৈতিক দলগুলোর বিবাদে দেশে অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে৷ এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার পথ সুষ্ঠু নির্বাচন৷''
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘‘দলের তহবিল বাড়াতে এখন ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালী পরিবারের সদস্যদের রাজনীতিতে আনা হচ্ছে৷ বহুদলীয় গণতন্ত্র থেকে একচ্ছত্র দলতন্ত্রের বিকাশ ঘটছে৷ বড় দলগুলো বিশেষত সরকারি দল সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘দখলে' নিয়ে নিজেদের পক্ষে ব্যবহার করছে৷ সুশীল সমাজ, সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সবখানে পড়েছে দলীয়করণের প্রভাব৷ ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক ও পেশাজীবী সংগঠনগুলোও দলীয় রাজনীতির বলয়ে আবদ্ধ৷''
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যে উন্নয়ন আমরা দেখছি তাকে বলা যায় একটা ‘আনইভেন গ্রোথ'৷ এটাকে ভালো বলার কোনো উপায় নেই৷ কারণ রাজনৈতিক সংঘাত এই উন্নয়নকে স্থিতিশীল হতে দেবে না৷''
তিনি বলেন, ‘‘৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর আসল বিরোধী দল বাইরে৷ আর বিরোধী দল বলতে যাঁরা আছেন, তাঁরা আবার সরকারেই বসেছেন৷ এটা একটা অদ্ভুত রাজনৈতিক পরিস্থিতি৷ এই অবস্থা যতদিন চলবে, ততদিন দেশে প্রকৃত উন্নয়ন হবে না৷''
এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অধ্যাপক আহমেদ বলেন, ‘‘সরকারি দল এখন চাইছে সব কিছু ঠিক-ঠাক আছে কিনা, তা দেখাতে৷ এ জন্য তারা নানা কৌশল নিচ্ছে৷ ওদিকে বিএনপি চাইছে দেশ যে ঠিকমত চলছে না, তা দেখাতে৷ ফলে সার্বক্ষণিক এক ধরণের সংঘাত লেগেই আছে৷ বিএনপি যখন এই সংঘাতকে আরো স্পষ্ট করার সক্ষমতা অর্জন করবে, তখন তা রাজপথের সংঘাতে রূপ নেবে৷ তাই ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে যতদিন না একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান আসবে, ততদিন দেশে প্রকৃত অর্থে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসবে না৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘দেশে রাজনৈতিক বিরোধিতা নেই, যেটা গণতন্ত্রে দরকার৷ আছে রাজনৈতিক শত্রুতা আর প্রতিহিংসা, যা সব উন্নয়নকে শেষ পর্যন্ত বিপর্যস্ত করে দেবে৷''