সাংবাদিকের ডায়েরি
২৬ আগস্ট ২০১৩ডয়চে ভেলেতে কাজের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের সাথে এখানে যোগ দেয়ার এটাও একটা কারণ৷ কিন্তু নতুন দেশে এসে থিতু হতে তো কিছুটা সময় লাগে! ১লা আগস্ট বনে এসেই অফিসে যোগ দেয়া৷ এরপর কাজ শুরু৷ কিন্তু এখানে এসে চেনা বলতে বাংলা বিভাগের কর্মীরা৷ কিন্তু তাঁরাও তো ব্যস্ত৷ তবে ঐ দিন সুযোগ এসে গেল আমাদের বাংলা বিভাগের প্রধান দেবারতিদির এক বন্ধু বনে ঘুরতে আসায়৷
দেবারতিদির বন্ধু তনুশ্রী, তাঁর স্বামী সুমনদা আর ছোট্ট পরী হিয়া৷ তাঁরা এখানে এসে পৌঁছানোর দিন, ১৪ তারিখেই একসাথে ঘুরতে গেলাম বেটোফেনের বাসায়৷ এরপর তাঁরা চলে গেলেন কোলোনে, আমি রয়ে গেলাম বনে৷
যাই হোক, অপেক্ষায় রইলাম ছুটির দিনের৷ শনিবার সুযোগ হলো৷ সকাল সাতটায় স্টাইনভেগের বাসা থেকে বাস ধরে সোজা হাউপ্টবানহফ, মানে বন শহরের কেন্দ্রীয় রেল স্টেশন৷ সেখানে ট্রেন ধরে সকাল সোয়া আটটায় পৌঁছে গেলাম কোলোন শহরে৷ সেখানেই সবাই একসাথে হয়ে রওনা হলাম রাইনের তীরে৷ উদ্দেশ্য জাহাজ ধরা৷ সকাল সাড়ে ন'টা৷ ‘মবি ডিক' জাহাজে উঠে পড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেড়ে দিল সেটি৷ ঝটপট জাহাজের ছাদে উঠে টেবিল দখল করলাম আমরা ছয়জন৷ আমি, দেবারতিদি, গাব্রিয়েল, তনুশ্রীদি, সুমনদা আর ছোট্ট হিয়া৷ ভোরবেলা উঠে মেঘলা আকাশ দেখে মনটা যত খারাপ হয়েছিল, জাহাজে উঠে ততটাই মন ভালো হয়ে গেল ঝকঝকে আকাশ দেখে৷
নদীর দুধারে প্রচুর সবুজ গাছপালা, সুনীল আকাশ আর ঝিরঝিরে বাতাসে প্রবাসে আসার দুঃখ অনেকটা ভুলিয়ে দিল৷ চার ঘণ্টার নদী ভ্রমণ৷ দু'পাশে অনেক পুরোনো গির্জা, চকোলেট তৈরির কারখানা, জাহাজ সারানোর কারখানা, ভাসমান রেস্তোঁরা – এমন অনেক কিছু চোখে পড়ল৷
এরমধ্যে চলল ছোটখাটো আড্ডা৷ বাঙালিরা একসাথে হবে, আর আড্ডা হবে না তাতো হতে পারে না৷ সেইসাথে দেবারতিদি আর সুমনদা একটা অভিনব শব্দ খেলায় মেতে উঠলেন৷ জাহাজ থেকে নামার মাত্র আধ ঘণ্টা আগে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শুরু হলো৷ তাই স্বাভাবিকভাবেই তাড়াহুড়ো করে শেষ করা হলো সেটি৷
জাহাজ অবশেষে এসে ভিড়ল ক্যোনিগসভিন্টারে৷ সেখানে আমাদের জন্য আগেই অপেক্ষা করছিলেন সহকর্মী সঞ্জীবদা৷ তাঁকে সাথে নিয়ে আমাদের এবারের গন্তব্য ড্রাখেনফেলস৷
ক্যোনিগসভিন্টারের পুরোনো সব রাস্তা পেরিয়ে আমরা পৌঁছালাম পাহাড়ি রেল স্টেশনে৷ ইচ্ছে করলে হেঁটেও যাওয়া যায় সেখানে৷ কিন্তু হিয়া সাথে থাকায় আমরা ট্রেনকেই বেছে নিলাম৷ ট্রেনে উঠার পর সর্পিল সরু পথ বেয়ে উঠে গেলাম ১০৫৩ ফিট উচুঁতে৷ ট্রেন থেকে নেমে যখন রেলিং ধরে নীচে তাকালাম, অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম পুরো জার্মানি আমার পায়ের নীচে৷ বন শহর এবং তার আশেপাশের বহু বসতি এখান থেকে দেখা যায়৷ এমনকি, খুব মন দিয়ে দেখলে দেখা যায় কোলোন শহরের বিখ্যাত চার্চ ‘ক্যোলনার ডোম'-টিকেও৷ রোদের আলো পড়ে অভূতপূর্ব এক দৃশ্য সৃষ্টি হয়েছিল, যা দেখে অভিভূত আমি৷
ড্রাখেনফেলস নির্মাণ শুরু হয়েছিল ১১৩৮ সালে, ১১৬৭ সালে এর নির্মাণ শেষ হয়৷ ক্যোনিগসভিন্টার শহরটিকে ঘিরে যে সাতটি পাহাড়ের বেষ্টনী, তার একটির ওপর নির্মিত এই দুর্গ৷ এরপর এর কিছু অংশ বিভিন্ন সময় ভেঙে পড়লেও এখনও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এটি৷
দুর্গে ওঠার আগে একটি ড্র্যাগন বানানো হয়েছে, যেটি এই দুর্গের ইতিহাস বর্ণনা করে৷ কতশত বছর আগে এখানে ড্র্যাগনদের রাজত্বের গল্প শোনায় এই ড্র্যাগন, যেটি ছোটদের কাছে ভীষণ পছন্দের৷
আমাদের ছোট্ট হিয়া প্রথমে এই ড্র্যাগনকে ভয় পেলেও একটা সময় ড্র্যাগনের গল্প নিয়েই পুরো সফরে মশগুল হয়েছিল৷ যাই হোক আমরা আরো উপরে উঠে দুর্গের ভগ্নস্তূপ দেখে যখন নীচে নামলাম, তখন অনেকেই ক্ষুধার্ত৷ তাই আইসক্রিম খাওয়া হলো৷ এবার নীচে নামার পালা৷ আবারো ছোট্ট ট্রেনে করে নীচে নামতে থাকলাম৷ অর্ধেক নেমে যাত্রা বিরতি৷ কেননা এবার গন্তব্যস্থল ড্রাখেনবুর্গ৷ এটি একটি প্রাসাদ৷
প্রাসাদের চেয়েও চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য আমার মন কেড়ে নিল৷ এত বড় বড় গাছ চতুর্দ্দিকে আর এত সবুজ – এক কথায় অসাধারণ৷ প্রাসাদের ভেতরে আর দশটা প্রাসাদের মতোই বড় বড় ঘর-আসবাব, দেয়ালে পেইন্টিং৷ তবে একটা চেয়ার আমাদের সবার মনোযোগ কেড়ে নিল৷ দিদিরা এর নাম দিল ‘চুম্বন চেয়ার'৷
ঘরগুলো দেখে যখন হতাশ, তখন হঠাৎই একটা সিঁড়ি খুঁজে পেলাম, সেটা দিয়ে উপরে উঠতে থাকলাম আমি আর তনুদি৷ একদম উপরে ওঠার পর যে অনুভূতি তা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়৷
এরপর নীচে যখন নেমেছি, তখন দেখি বাকিরা ঘাসে লুটিয়ে পড়েছেন৷ সময় বিকেল চারটা৷ তাই দেরি না করে আবারো ট্রেনের জন্য দাঁড়ালাম৷ ট্রেন থেকে নেমে এবার গন্তব্য সঞ্জীবদার বাড়ি, যেটা ক্যোনিগসভিন্টারেই৷ তাঁর বাসা দেখে সবাই রীতিমত মুগ্ধ৷ পুরোনো বাড়িগুলো যেরকম হয় আর কি! সেখান থেকে চা খেয়ে ঠিক ছয়টায় আমরা বেড়িয়ে পড়লাম রেলস্টেশনের উদ্দেশ্যে, কেননা আমি আর সঞ্জীবদা ছাড়া বাকিরা কোলোনে ফিরে যাবেন৷ পৌনে সাতটায় তাঁদের ট্রেনে তুলে দিয়ে আমরা দু'জন গেলাম ট্রাম স্টপে, সেখান থেকে বনের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম সাড়ে সাতটায়৷ তখনও বিকেল, আলো অনেকটা উজ্জ্বল৷ বাসায় যখন পৌঁছালাম, তখন ঘড়িতে সাড়ে আটটা৷ কেবল সন্ধ্যা নামছে...