রক্ষণশীল মুসলিম-জার্মান
২৮ জুলাই ২০১৭দেশটির সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য নর্থ-রাইন ওয়েস্টফালিয়ার অন্যতম শহর কোলন এবং তার আশেপাশের এলাকায় ইসলাম নিয়ে রিপোর্টিং করার অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে তিনি এই মন্তব্য করেন৷
জার্মানিতে থাকা প্রায় ৪০ লাখ মুসলিমের ১৪ লাখের বাস এই রাজ্যে৷ ২০১৫ সালে প্রায় ১০ লাখ উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দেয়ার পর, জার্মানিজুড়ে আলোচনার অন্যতম বিষয়বস্তুতে পরিণত হয় ইসলাম৷ এ কারণে এবারে নির্বাচনকে সামনে রেখে ডয়চে ভেলের গ্রীষ্ম-যাত্রায় ছয়টি বিষয়ের একটি ঠিক করা হয় ইসলাম৷
এ মাসের শুরুর দিকে কোলন ও আশপাশের এলাকায় এসে তাঁরা ইসলাম বিষয়ে কথা বলেন নানা শ্রেণি পেশা ও ধর্মের মানুষের সঙ্গে৷ এক ফাঁকে রিপোর্টিংয়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে সুমি কথা বলেন ডয়চে ভেলে বাংলা বিভাগের সঙ্গে৷ ২০১১ সাল থেকে ডয়চে ভেলে ইংরেজি বিভাগের এই উপস্থাপক জানান, ইসলাম কি জার্মানিকে বদলে দিচ্ছে? – এই প্রশ্ন নিয়ে কাজ করছি৷
তিনি বলেন, অনেক সময়ই এখানে ইসলামকে একক একটি চেহারায় ভাবা হয়৷ এটা আসলে ঠিক না৷ ধর্ম পালন এবং বিশ্বাসে জার্মানিতে বাস করা মুসলমানদের মধ্যে অনেক বৈচিত্র্য রয়েছে৷
‘‘জার্মানিতে বাস করা মুসলিমরাও নানাভাবে ইসলাম পালন করেন৷ এটা মনে রাখলে, ইসলাম জার্মানিতে কী ভূমিকা রাখছে, সেটা দেখার দৃষ্টিভঙ্গিও বদলে যাবে৷''
‘‘এখানে অনেকে রয়েছে, যারা খুবই রক্ষণশীল জীবনযাপন করেন৷ অনেকে আবার ইসলামের উদার ধারার অনুসারী৷''
‘‘আমার বারবার যে জিনিসটা দেখেছি, অনেক জার্মান ভোটারই নিজেদের এই প্রশ্ন করছেন, ইসলাম তাদেরকে ধারণ করে কিনা৷ আমরা বুঝতে পেরেছি, এখানে মুসলিম, অন্য ধর্মাবলম্বী, তারা কেউই জানেন না, ‘অন্যরা কিভাবে জীবনযাপন করছে'৷ যেমন একজন অন্য ধর্মাবলম্বী ব্যক্তির মসজিদে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নেই৷''
‘‘রক্ষণশীল মুসলিমরাও জানেন না, ভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাসের মানুষের জীবন প্রণালী কেমন৷ তাদের মধ্যে খুব কমই কথাবার্তা হয়৷ এই দুই ধারার মানুষ একে অন্যের সাথে কথা বলে না৷ এভাবেই অনেক ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়৷ এ কারণেই ইসলাম নিয়ে এত টেনশন কাজ করে৷''
কাজের অংশ হিসাবে বনের উপকণ্ঠে অবস্থিত বাড গোডেসবার্গের একটি মার্শাল আর্ট সেন্টারে যান সুমি৷ সেই অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, মার্শাল আর্ট সেন্টারে এসে দেখলাম, এখানে অনেকেই প্রশিক্ষণ নিতে আসে৷ এরা মূলত জার্মান৷
‘‘তবে এদের অনেকে আফগানিস্তান, লেবানন, ইটালির মতো দেশ থেকে এসেছে৷ এই ছোট বেলায়ই তাঁরা নিয়মানুবর্তিতা, নিয়ন্ত্রণ, শ্রদ্ধাবোধ শিখছে৷ এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা৷ উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীরাও এখানে প্রশিক্ষণ নিতে এসেছে৷''
এদের কেউ অভিবাসী, কেউ জন্মেছেন জার্মানিতে, কেউ এসেছেন উদ্বাস্তু হয়ে, কেউ নারী, কেউ পুরুষ, কেউ মুসলিম, কেউ অন্য ধর্মের –এরপরও সবাই একত্রে প্রশিক্ষণ নেয়ার মধ্যে যেন সহনশীল একটি সমাজের প্রতিচ্ছবিই দেখতে পেয়েছেন সুমি৷
তাদের একজন নাবিল হাকিম৷ যার মা-বাবা ৩০ বছর পূর্বে আফগানিস্তানে থিতু হয়েছেন বলে জানান তিনি৷ জার্মানিতে জন্ম নিয়ে এখানকার আলো বাতাসে বড় হওয়া নাবিলের কাছে জার্মানিই যেন নিজের ঘর৷ দেশ বলতে তিনি বোঝেন এই দেশকেই৷ সম্প্রতি ইসলাম নিয়ে জার্মানিতে অনেক আলোচনা সমালোচনার মধ্যে নাবিল জানালেন, মুসলিম হওয়ার কারণে ব্যক্তিগতভাবে তিনি কোনো বৈষম্যমূলক কাজ বা আচরণের শিকার হননি৷ তবে জার্মানিতে অনেক মুসলমানের এই অভিজ্ঞতা হয়৷
নাবিলের বোন হাসনাও এখানে মার্শাল আর্ট শেখেন৷ প্রশিক্ষণে রক্ষণশীল আফগান বংশোদ্ভূত এই তরুণীকে তাঁর ভাইয়ের চেয়েও বেশি সক্রিয় মনে হয়েছে৷ জার্মানিতে নিজের অবস্থানকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, এখানে তিনটি বিষয় রয়েছে৷ তাঁর কথায়, ‘‘আমি একইসঙ্গে মেয়ে, মুসলিম এবং অভিবাসী৷''
হাসনা বলেন, ‘‘জার্মানিতে আছি৷ এটা একটা উপহার৷ আফগানিস্তানে আমার মতো যারা আছে, তারা চাইলেও এমন অনেক কিছু করতে পারে না, যা আমি করতে পারি৷''
‘‘আমার বয়সি কাজিনদের মধ্যেও অনেকে আছে, যাদের সেখানে পড়াশোনার সুযোগ নেই৷ এ রকম আরো অনেক সুযোগ রয়েছ, যা আমি পারছি, কিন্তু তারা পারছে না৷ এ কারণে আমি এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে চাই৷''
‘‘তারা সেখানকার ট্র্যাডিশনাল জীবনযাপন করে৷ অনেকের অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে গেছে৷ তাঁদেরকে সব সময় ঘরে থাকতে হয়৷ হয়ত তাঁরা অনেকে সারা জীবনই ঘরে কাটায়৷ আবার পরিবার সুযোগ করে দিয়েছে – এমন অনেকেও রয়েছে৷''
‘‘আধুনিক জীবনযাপন করাও একটা চ্যালেঞ্জ৷ আফগানিস্তান একটা ট্র্যাডিশনাল দেশ৷ অনেকে এখানে আধুনিকতাকে সহজভাবে নেয় না৷ সামাজিক বাধা বিপত্তি স্বত্ত্বেও অনেকে আবার সেই পথই বেছে নেয়৷''
ব্যক্তিগত জীবনে নেলসন ম্যান্ডেলাকে আদর্শ হিসেবে মানা হাসনা আইন বিষয়ে পড়াশোনা করছেন৷ স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালে৷
তিনি বলেন, আমি জার্মানিতে থাকি, আইন বিষয়ে পড়ি, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালে কাজ করি৷ এই সব সুযোগকে আমি একত্রিত করতে চাই৷ আমার অনেক বড় লক্ষ্য রয়েছে৷ কিছু একটা করতে চান তিনি ফেলে আসা দেশ আফগানিস্তানের জন্যও৷
এখানে প্রশিক্ষণ নিতে আসা ইটালীয় বংশোদ্ভূত শ্যারন জ্যোকারো জানান, তাঁর বন্ধুদের অনেকেই মুসলিম৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা সবাই সমান৷ কে মুসলিম, কে ক্যাথলিক – এটা গুরুত্বপূর্ণ না৷ মানুষ মানুষই৷ মানবতা মানবতাই৷ আমাদের সকলের সমান মানবাধিকার রয়েছে৷''
‘‘আমি কখনো শুনিনি যে, মুসলিমরা কোনো সমস্যায় পড়েছে৷ আমরা সকলকে সমান বিবেচনা করি৷ তুমি যদি ছেলে বা মেয়ে হও, সেটা গুরুত্বপূর্ণ না৷ আমরা সবাইকে সমানভাবেই দেখি৷''