যোগীর রাজ্যে মাদ্রাসায় গীতা পড়ানো হবে কেন!
৯ মার্চ ২০২১মালদার আবুর কথা মনে পড়ছে। আবু সিদ্দিকি ছোটবেলার বন্ধু। ওর মতো গম্ভীরা গান অনেকেই গাইতে পারে না। আবু গড়গড় করে রবি ঠাকুরের 'কর্ণ-কুন্তীর সংবাদ' আবৃত্তি করতো। আবৃত্তি শেষ করেই আবু ফুট কাটতো। কেন মহাভারতে কর্ণ ওর সবচেয়ে প্রিয় চরিত্র তার হাজারটা ব্যাখ্যা দিত। আবার একই সঙ্গে কারবালার গল্প শোনাতো। কারবালা নিয়ে গানও বেঁধেছিল একটা।
আবুর সঙ্গে দেখা হয়নি দীর্ঘদিন। সরকারি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছে। এখন সরকারি চাকরি করে। এই লেখার সূত্রেই আবুর সঙ্গে আরেকবার কথা হলো। কেন্দ্রীয় সরকারের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ওপেন স্কুলিংয়ের (এনআইওএস) কথা শুনে আবু দৃশ্যত অবাক এবং ব্যথিত। এনআইওএস জানিয়েছে উত্তরপ্রদেশের ১০০টি অটোনমাস মাদ্রাসায় রামায়ণ এবং গীতা পড়াতে হবে। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের নিউ এডুকেশন পলিসি বা শিক্ষা প্রকল্প মেনেই এই নীতি নেওয়া হয়েছে বলে তারা জানিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, কেন মাদ্রাসায় রামায়ণ বা গীতার মতো ধর্মগ্রন্থ পড়ানো হবে?
ভারতে মূলত দুই ধরনের মাদ্রাসা আছে। এক, সরকার পরিচালিত মাদ্রাসা এবং দুই, স্বাধীনভাবে তৈরি হওয়া মাদ্রাসা। তবে পশ্চিমবঙ্গের মতো জায়গায় সরকার পরিচালিত মাদ্রাসার চল অনেক বেশি। বাম আমলে পশ্চিমবঙ্গে মাদ্রাসা বোর্ড তৈরি করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার পাঠ্যক্রমই সেখানে পড়ানো হয়। পাশাপাশি ধর্ম এবং ভাষা শিক্ষার আলাদা ব্যবস্থা আছে। ঠিক যেমন পশ্চিমবঙ্গে অসংখ্য খ্রিস্টান মিশনারি স্কুল আছে। তাদের পাঠ্যক্রম মাধ্যমিক বোর্ডের মতোই। শুধু তার সঙ্গে অতিরিক্ত ধর্মশিক্ষার পাঠের ব্যবস্থা আছে। রামকৃষ্ণ মিশনের স্কুলে যেমন সাধারণ পাঠ্যক্রমের পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা আছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার কখনো মাদ্রাসায় হিন্দু ধর্মগ্রন্থ পড়াতে বলেনি, ঠিক যেমন মিশনারি স্কুলে বা রামকৃষ্ণ মিশনের স্কুলে কোরান পড়ানোর প্রশ্ন ওঠেনি।
পশ্চিমবঙ্গে মাদ্রাসায় হিন্দু ছাত্ররা পড়তে যায়। মিশনারি স্কুলে মুসলিম ছাত্ররা পড়তে যায়। আবার রামকৃষ্ণ মিশনে মুসলিম এবং ক্রিস্টান ছাত্ররা পড়তে যায়। শিক্ষার মান এবং দূরত্ব দেখে বাবা-মায়েরা বাচ্চাদের স্কুলে পাঠান। ধর্ম সেখানে কখনোই প্রাধান্য পায় না। সে জন্যই আবু মাদ্রাসায় পড়ে যেমন ইসলাম জেনেছে, তেমনই নিজের ইচ্ছায় অন্য ধর্মের বইও পড়েছে। নিজের জ্ঞান বাড়িয়েছে। সেই আবুই নতুন নিয়ম শুনে হাহুতাশ করছে। আবু বিশ্বাস করে, এভাবে চাপিয়ে দিয়ে কাউকে কিছু শেখানো যায় না। বরং বিভেদ তৈরি হয়।
স্বাভাবিক ভাবেই উত্তরপ্রদেশে নতুন এই নিয়ম নিয়ে ঝড় বইছে। একাধিক মুসলিম সংগঠন এবং ইসলামিক স্কলাররা এর বিরোধিতা করেছেন। লখনউয়ের ইসলামিক সেমিনারি দারুল উরুল ফিরাঙ্গি মহল সাড়ে তিনশো বছরের পুরনো। সেখানে এখন নাজিম বা চেয়ারম্যান মৌলানা খালিদ রশিদ। ডিডাব্লিউকে তিনি জানিয়েছেন, ''মাদ্রাসার উপর এভাবে সরকারি সংস্থা কিছু চাপিয়ে দিতে পারে না। বেসরকারি মাদ্রাসা তার নিজের পাঠ্যক্রম নিজে ঠিক করে। সরকার কীভাবে সেখানে হস্তক্ষেপ করবে? শুধু তাই নয়, সরকারি মাদ্রাসাতেও এভাবে সরকার কিছু চাপিয়ে দিতে পারে না। এতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হবে।''
বিশিষ্ট ইসলামিক স্কলার মৌলানা ইয়াসুব আব্বাসের বক্তব্য, ''ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে হিন্দু এবং মুসলিম কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছে। এদেশে সকলে একসঙ্গে থাকে এবং নিজের নিজের ধর্ম পালন করে। কেউ কারো উপর কিছু চাপিয়ে দেয়নি। নতুন সরকার বিভাজন তৈরির চেষ্টা করছে।''
যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশ এর আগেও একাধিক বিতর্কিত আইন প্রণয়ন করেছে। লাভ জিহাদের আইন সেখানে পাশ হয়েছে। হিন্দু মুসলিমের মধ্যে যা বিভাজন তৈরি করতে পারে। সেই আইন নিয়েও বহু আলোচনা এবং আন্দোলন চলছে। কিন্তু মাদ্রাসায় হিন্দু ধর্মগ্রন্থ পড়ানোর এই আইন আগের সব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে।
দীর্ঘদিন ধরে ভারতের মুসলিম সমাজ নিয়ে কাজ করেন সাংবাদিক মিলন দত্ত। তাঁর প্রশ্ন, আরএসএস পরিচালিত স্কুলগুলিতে কোরান পড়ানো হবে? সংস্কৃতের টোলে কি কোরান পড়ানো হবে? সরকার কি সেই আইন করবে? তার বক্তব্য, সকলে সব কিছু পড়তে পারেন। নিজের ইচ্ছায় পড়তে পারেন। জানার কোনো শেষ নেই। কিন্তু কোনো ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এভাবে ধর্মগ্রন্থ চাপিয়ে দেওয়া যায় না। বিশেষত মাদ্রাসায়। যা তৈরিই হয়েছে নির্দিষ্ট একটি ধর্মের সংস্কৃতি অবলম্বনে।
ভারতে আবুর মতো মানুষ কম নন। বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশন কলেজের বেদান্তের শিক্ষক শামিম আহমেদ। দীর্ঘদিন ধরে মহাভারত নিয়ে তিনি পড়াশোনা করেছেন এবং পড়াচ্ছেন। শামিমের বক্তব্য, ''রামায়ণ-মহাভারত ভালোবেসে পড়েছি। ছোটবেলায় যদি চাপিয়ে দেওয়া হতো, তাহলে হয়তো আজ তা নিয়ে এত পড়াশোনাই করা হতো না।''
ভারতীয় সংস্কৃতির গোড়ার কথাই হলো বৈচিত্র্য। নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধানের দেশে যখন এভাবে একজনের সংস্কৃতি অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, তখন গোড়ার স্পিরিটটিকেই অস্বীকার করা হয়। আর এই কাজ করতে গেলে আগুন লাগার সম্ভাবনা থাকে। আগুন একবার লেগে গেলে তা নেভানো মুশকিল। ভারতের ইতিহাস সে কথা জানে। গত কয়েক বছর ধরে বিজেপি সরকার সেই আগুন নিয়েই খেলছে। দিকে দিকে বিভেদের রাজনীতি মাথা তুলছে। সরকারের মনে রাখা দরকার, নগর পুড়লে, দেবালয় রক্ষা পায় না। আগুন লেগে গেলে তার তাপ সকলের উপর এসে পড়বে। সে আগুন সামলানো কঠিন। খুব কঠিন।