জনমাধ্যম হয়ে উঠছে ফেসবুক
২ আগস্ট ২০১৬খুলনা শহরে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করে আপনার কানে মাইকেল জ্যাকসনের পরিচিত কোনো গানের সুর ভেসে আসতেও পারে৷ গানের উৎস খুঁজতে একটু এগিয়ে গেলে হয়তো আরও চমকে উঠবেন৷ সাদা শার্ট, আঁটসাঁট কালো প্যান্ট, গলায় টাই, মাথায় সেই পরিচিত কালো টুপি৷ পপসম্রাট নিজে খুলনা শহরের ধুলোমাখা রাস্তায়! নিজের বিখ্যাত ‘মুনওয়াক' করে বিক্রি করছেন চানাচুর!
গত বছর সেপ্টেম্বরে খুলনার চানাচুর বিক্রেতা বিল্লালকে নিয়ে এমনই একটা ভিডিও আমি পোস্ট করেছিলাম ফেসবুকে৷ সেই ভিডিও এরই মধ্যে শেয়ার হয়েছে এক লাখের বেশিবার৷ ভিডিওটি যাঁরা শেয়ার করেছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন মাসুদ রানার স্রষ্টা, কিংবদন্তি লেখক কাজী আনোয়ার হোসেনও৷ বাংলাদেশের এক প্রান্তের শহরের প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ বিল্লাল পৌঁছে গেছেন পুরো বিশ্বের মানুষের কাছে৷ ১৮ লাখেরও বেশি বার দেখা ভিডিওটিতে মন্তব্য করেছেন ইউরোপ-অ্যামেরিকার ভিনদেশি অনেকেও৷ বিল্লাল এরই মধ্যে বাংলাদেশের বেশ কিছু প্রধান টিভি চ্যানেলে এসে অনুষ্ঠানও করেছে গেছেন৷
কিংবা কক্সবাজারের আট বছরের সেই শিশু জাহিদ, সমুদ্রসৈকতে পর্যটকদের মাথা মালিশ আর নানারকম গান শুনিয়ে দিন চলত যার৷ তার একটি গান ‘মধু খই খই...' বদলে দিল জীবন৷ ঢাকা থেকে বেড়াতে আসা মোহাম্মদ ইমরান হোসেন ও তাঁর পাঁচ বন্ধুর করা ভিডিওর কল্যাণে জাহিদ পৌঁছে গেল লাখো মানুষের কাছে৷ জাহিদ এখন কক্সবাজারেরই নামকরা একটা হোটেলে চাকরি করে, গান শোনায়৷ পাশাপাশি স্কুলেও যায়৷
একটু ঠাট্টার ছলে হলেও ‘হিরো আলম' নামের বগুড়ার একজন সাধারণ তরুণ দেখিয়ে দিয়েছেন, কীভাবে তাঁর মতো মানুষও পৌঁছে যেতে পারে সবার কাছে, সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে৷
ফেসবুক কিংবা ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো এভাবেই বাংলাদেশে পরিণত হয়েছে জনমানুষের মাধ্যমে৷ তথ্যপ্রযুক্তির সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক শক্তি বোধ হয় এটাই৷ আগে মিডিয়ার আসল ক্ষমতা ছিল কিছু মানুষের হাতে৷ সেখানে খবরও প্রকাশিত হতো কিছু মানুষের৷ ‘কিছু মানুষের’ এই বৃত্ত ভেঙে দিয়েছে সামাজিক মাধ্যম৷ খুব সহজভাবে ভাবুন, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘মিডিয়া', যে মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ, সেখানে আপনার-আমার ব্যক্তিগত খবর, জন্মদিন কিংবা বিয়ের ছবি প্রকাশিত হচ্ছে৷
বিশ্বে জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যম বেশ কটি৷ যদিও বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ফেসবুকই মূলত গণমানুষের মাধ্যম হয়ে উঠেছে৷ টুইটার এখনো সে রকম অবস্থান বা ভূমিকা রাখতে পারেনি৷ আর আছে ইউটিউব৷
ফেসবুক আমাদের কাছে হয়ে উঠেছে ডায়েরির মতো৷ আমরা সেই ভার্চুয়াল ডায়েরিতে লিখছি৷ পার্থক্য হলো, নিজের ব্যক্তিগত দিনলিপি আমরা হয়তো লুকিয়ে রাখতাম৷ কিন্তু আমরা ফেসবুকে আমাদের কথা ছড়িয়ে দিচ্ছি৷ ছড়িয়ে দিচ্ছি আমাদের ভাবনা, আমাদের মতামত৷ সেই ভাবনা বা মতামত কখনো কখনো শুধু ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতির মধ্যে আটকে থাকছে না৷ আমরা বলছি, এই দেশ, এই রাষ্ট্র, এই সমাজ নিয়ে৷ আমরা বলছি বিশ্বকে নিয়েও৷
আমি নিজে একজন সংবাদকর্মী৷ ১৪ বছর ধরে বাংলাদেশের শীর্ষ একটি সংবাদমাধ্যমে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, সামাজিক মাধ্যমগুলোকে এখনো বিকল্প মাধ্যম বলা হলেও ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে এই মাধ্যমগুলোই মূল হয়ে উঠছে যেন৷ গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে বড় বড় রাজনৈতিক ঘটনাগুলোর সঙ্গে সামাজিক মাধ্যম সরাসরি জড়িয়ে আছে৷ গণজাগরণ মঞ্চ সেটার সবচেয়ে বড় উদাহরণ সম্ভবত৷ একদম অচেনা একজন মানুষের ছোট্ট একটা ফেসবুক ইভেন্ট কী করে সারা বাংলাদেশে আক্ষরিক অর্থেই নতুন একটা গণজাগরণ তৈরি করতে পেরেছিল, ভাবতে এখনো অবাক লাগে৷ অবাক লাগে এই ভেবেও, সেই আলোড়ন, সেই উত্তুঙ্গ আবেগের স্রোতটাকে কী করে ধরে রাখা গেল না এই ভেবেও৷
গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষে-বিপক্ষে তাই আছে নানা আলোচনা৷ তবে এটা সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে কীভাবে একদম সাধারণ মানুষ ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা রাজনীতিকেও টলিয়ে দিতে পারে, এটার উদাহরণ হয়ে থাকবে অবশ্যই৷ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো এই ঘটনার পরই বাধ্য হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কথাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে৷ স্কুলপড়ুয়া এক শিক্ষার্থীর কথা শুনে তাই যোগাযোগমন্ত্রীকেও আমরা দ্রুত উদ্যোগ নিতে দেখেছি৷ এই ঘটনা দেশের মূল ধারার সংবাদমাধ্যমকেও বাধ্য করেছে সামাজিক মাধ্যম সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে৷ মিডিয়া এখন আর একমুখী নেই৷ শুধু সংবাদমাধ্যম বলবে আর এর পাঠক, শ্রোতা, দর্শক শুনবে - তা হবে না৷ মিডিয়াকেও এখন পাঠক, শ্রোতা, দর্শকের কথা শুনতে হবে৷ তাদের সেই মতামত, মন্তব্য প্রকাশ করতে হবে৷
সামাজিক মাধ্যমের সবচেয়ে বড় শক্তির আরেকটি দিক দেখা গেল ১ জুলাই গুলশানের রক্তাক্ত ঘটনার পর৷ পুলিশ খুঁজে বের করার আগেই ফেসবুক ব্যবহারকারীরাই আইএস প্রকাশিত ছবি ধরে ধরে মিলিয়ে প্রায় সব জঙ্গির নাম পরিচয় বের করে ফেলেছিল৷ পুলিশ এরপরও আকাশ, বিকাশ, ডন, বাঁধন, রিপন নাম দিয়ে জঙ্গিদের পরিচয় করিয়ে দিলে এ নিয়েও তীব্র সমালোচনা উঠেছিল ফেসবুকে৷ পুলিশ বাধ্য হয়েছিল নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করতে৷
কিন্তু এ সবই তো ফেসবুকর ইতিবাচক দিক৷ খারাপ দিকও কি নেই? গুলশান ট্র্যাজেডির ওই সময়টাতেই ফেসবুকের অন্ধকার দিকটির চেহারা দেখা গেছে৷ যেখানে বন্ধুর জন্য প্রাণ উৎসর্গ করা ফারাজকে নিয়ে একটা দীর্ঘ সময় অপপ্রচার চলতে দেখা গেছে৷
ফেসবুক কখনো কখনো সেই ‘মিডিয়া ট্রায়াল'-এর ভূমিকাও নিয়ে ফেলছে৷ প্রমাণ হওয়ার আগেই ফেসবুক অনেক সময় জনমত তৈরি করে ফেলছে কারও বিরুদ্ধে৷ কারও কারও কাছে ফেসবুক ‘যা ইচ্ছে তা-ই' লেখার হাতিয়ার হয়ে উঠেছে৷ অভিযোগ আছে, কিছু কিছু বড় ফেসবুক গ্রুপ, ফেসবুকের কল্যাণে তারকা হয়ে ওঠা ‘ফেসবুক সেলেব্রিটি' রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে এই মিডিয়া ব্যবহার করছেন৷ কিছু রাজনৈতিক দল বা সংগঠন ‘পেইড ফেসবুকার' ব্যবহার করে জনমত প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ শোনা যায়৷
ফেসবুকে কখনো কখনো মিথ্যা গুজব, বানোয়াট ফটোশপ করা ছবি; এমনকি কারসাজি করা ভিডিওও ভাইরাল হতে দেখা যাচ্ছে৷ সাময়িক সময়ে অসৎউদ্দেশ্যে ফেসবুক ও এর শক্তিকে ব্যবহার করতে অনেকেই সফলও হয়েছেন৷ গুজব ও মিথ্যা কথা দাবানলের মতো ছড়িয়েও গেছে৷ কিন্তু ফেসবুক এখন যে নেটিজেন জার্নালিজমের ভূমিকা পালন করছে, তাতে এমনও অনেক সময় দেখা গেছে, মিথ্যা অপপ্রচার বেশিক্ষণ ধোপে টেকেনি৷ পাল্টা যুক্তি দিয়ে, তথ্য প্রমাণ দিয়ে অনেকেই মিথ্যা অপপ্রচারের সেই দাবানল নিভিয়ে দিয়েছে৷
শুধু সমস্যা একটাই মনে হয়, কখনো কখনো ভাষার ব্যবহারে আমরা সংযত থাকি না৷ আমরা বুঝতে পারি না, সামাজিক মাধ্যমে আমরা কারও সমালোচনা করলেও সেটির ভাষা শালীন রেখেই সমালোচনা করা যায়৷ কখনো কখনো আমরা খুব সহজেই অন্যের মতামতে প্রভাবিত হই৷ সেই মতটা আসলেই ঠিক কি না, যাচাই করি না৷ এমনও আমি দেখেছি, একই বিষয়েরই পক্ষে-বিপক্ষে যখন ফেসবুকে আলোচনা হয়; এমন অনেকেই আছে, দুই পক্ষের পোস্টেই লাইক দিচ্ছে!
সম্প্রতি রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি উচিত কিনা, এমন বিতর্কেও এই অভিজ্ঞতা আমার হলো৷ আমার ফেসবুকে আছেন এমন বেশ কজনকে দেখলাম, পক্ষের বক্তব্যেও লাইক দিচ্ছেন, বিপক্ষের বক্তব্যেও দিচ্ছেন৷ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটিও নিশ্চয়ই কমে আসবে৷
বাংলাদেশে ফেসবুকের আরেকটি বড় সমস্যা হলো, ভিন্নমতকে সহ্য করতে না পারার প্রবণতা৷ ফেসবুকে আমরা ভার্চুয়াল আড্ডাই দিই৷ পার্থক্য হলো, আগে আমি বেছে নিতাম আমার আড্ডায় কারা কারা থাকবে৷ সে সব আড্ডাতেও চায়ের কাপে ঝড় উঠত বৈকি৷ কিন্তু মোটের ওপর সমমনারাই আড্ডায় জমায়েত হতো৷ কিন্তু ভার্চুয়াল জগতে সেই সীমারেখার দেয়াল নেই৷ এখানে তাই পরস্পর বিরোধী মতবাদের বিশ্বাসী দুই পক্ষ মুখোমুখি হয়ে যায়৷ কখনো কখনো সেই আলোচনা যুক্তির বদলে কদর্য বাক্য বিনিময়ে রূপ নিয়ে নেয়৷ বিরুদ্ধ মতকে শ্রদ্ধা করা ‘ভলতেয়ার'রা অবশ্য বরাবরই সংখ্যালঘু ছিলেন৷ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটিও আশা করি বদলে যাবে৷
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক মাধ্যমগুলো আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে নিশ্চয়ই৷ বিকল্প গণভোটের ভূমিকা পালন করবে এই মাধ্যম৷ সরকারকে, ক্ষমতাধরদের শুনতেই হবে সাধারণ মানুষের কথা৷ তাদের করতে হবে জবাবদিহি৷ যদিও ক্ষমতাভোগীরা সব সময়ই মানুষের এই কণ্ঠস্বরকে ভয় পায়৷ বাংলাদেশেও একটি আইন ‘৫৭ ধারা' নামে পরিচিতি পেয়েছে, যা অবাধ মতপ্রকাশের বিরুদ্ধে৷
তবু মানুষের মুখ বন্ধ নেই৷ সেই মুখের গ্রন্থিত বই হয়ে উঠেছে ‘ফেসবুক'৷ যে ফেসবুক শুধু রাজনৈতিক ভাষ্যের মঞ্চ হয়ে নেই৷ বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগ, পথশিশুদের পুনর্বাসন, শিক্ষা - কত কাজে জড়িয়ে আছেন বাংলাদেশের ফেসবুক ব্যবহারকারীরা৷ সামাজিক উদ্যোগের দিক দিয়ে বাংলাদেশই সম্ভবত সবচেয়ে সফলভাবে সামাজিক মাধ্যমকে আক্ষরিক অর্থেই ‘সামাজিক' করতে পেরেছে৷ রক্তের সাহায্য চেয়ে দেওয়া পোস্টগুলোতে এই অভিজ্ঞতা হয় আমার৷
এমনও দেখেছি, গণজাগরণ মঞ্চের তুমুল বিতর্কের সেই সময়টায় মঞ্চের এক কর্মীর মায়ের সংকটাপন্ন অবস্থায় রক্ত দিয়ে গেছেন মঞ্চের বিপক্ষে সবসময়ই সোচ্চার একজন৷ এই ছবিটাই যেন সার্থক হয়৷ ভিন্ন মত থাকবে, তর্ক থাকবে, ঝগড়া থাকবে; কিন্তু এটাই মনে রাখা দরকার; সে তুমি ডানপন্থি হও কিংবা বাম আদর্শে বিশ্বাসী; সে তুমি উদারপন্থি হও কিংবা কট্টর; তোমার ধর্ম, তোমার মতবাদ আমার থেকে আলাদা হলেও রক্তের রং কিন্তু ভাই একই!
প্রিয় পাঠক, ফেসবুক আপনার জীবনে কী পরিবর্তন এনেছে জানাতে পারেন আমাদের৷ লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে...