‘যেন প্রতিমাসে একজন ব্লগার হত্যার মিশন চলছে’
১০ আগস্ট ২০১৫গত শুক্রবার ঢাকায় ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়কে (নিলয় নীল) হত্যার মধ্য দিয়ে গত সাড়ে পাঁচ মাসে দুর্বৃত্তরা মোট চারজন ব্লগারকে হত্যা করেছে৷ রোজার মাস বাদ দিয়ে তারা প্রতিমাসেই একজন করে হত্যা করেছে৷ গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দেখেশুনে মনে হচ্ছে তারা তালিকা ধরে প্রতিমাসে অন্তত একজন ব্লগারকে হত্যার মিশনে নেমেছে৷ তাই প্রশ্ন উঠছে এরপর কে? আর পুলিশ তা চেয়ে চেয়ে দেখছে৷''
গত ২৬শে ফেব্রয়ারি একুশে বইমেলার বাইরে টিএসসি এলাকায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় লেখক ও ডিডাব্লিউ-র দ্য বব্স পুরস্কারপ্রাপ্ত মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ব্লগার অভিজিৎ রায়কে৷ একই ঘটনায় আহত হন তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা৷
অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের মাত্র এক মাসের মাথায় তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের বেগুনবাড়িতে খুন হন ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু৷ এরপর ১২ই মে, সিলেটের সুবিদবাজার এলাকার কর্মস্থলে যাওয়ার পথে কুপিয়ে হত্যা করা হয় অপর মুক্তমনা ব্লগার ও সিলেট গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক অনন্ত বিজয় দাসকে৷ আর এ হত্যাযজ্ঞের সর্বশেষ শিকার নিলয় নীল৷
ব্লগার হত্যা অবশ্য শুরু হয়েছিল ২০১৩ সালে ১৫ই ফেব্রুয়ারি ঢাকায় গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ব্লগার রাজীব হায়দারকে হত্যার মধ্য দিয়ে৷ শুধুমাত্র রাজীব হায়দার হত্যার ঘটনাতেই এখন পর্যন্ত পুলিশ মূল আসামিদের গ্রেপ্তার এবং আদালতে চার্জশিট দিতে পেরেছে৷
ব্লগার অভিজিৎ হত্যায় সরাসরি জড়িত কাউকে এখনও পর্যন্ত গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ৷ হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগে শফিউর রহমান ফারাবি নামে একজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও, তার কাছ থেকে কোনো তথ্যই পাওয়া যায়নি৷ আদালতেও কোনো স্বীকারোক্তি দেয়নি ফারাবি৷
তবে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম ডয়চে ভেলের কাছে দাবি করেন যে, তারা হত্যাকাণ্ডে জড়িত সাতজনকে চিহ্নিত করেছেন, গ্রেপ্তারেরএ চেষ্টা চলছে৷ তিনি বলেন, ‘‘অভিজিৎ হত্যার দিন সেই এলাকায় থাকা পুলিশের ভিডিও ফুটেজ দেখে সাতজনকে শনাক্ত করে তাদের ছবি সংগ্রহ করা হয়েছে৷''
ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যার পর পর জনতার হাতে জিকরুল্লাহ ও আরিফুল নামে দুই মাদ্রাসা ছাত্র ধরা পড়লেও, পুলিশ তাদের কাছ থেকে বাড়তি কোনো তথ্য আদায় করতে ব্যর্থ হয়৷ ওই দু'জনের সঙ্গে থাকা পলাতক আবু তাহের ও মাসুমকেও গ্রেপ্তার করা যায়নি৷
এছাড়া সিলেটে ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস হত্যার ঘটনায় ইদ্রিস আলী (২৪) নামে এক আলোকচিত্র সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করে সাতদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও, অপরাধীদের চিহ্নিত বা আটকের কোনো খবর নেই৷ প্রসঙ্গত, ইদ্রিস আলী হত্যাকাণ্ডের সময় ঘটনাস্থলের কাছ থেকে ছবি তোলায় তাঁকে আটক করা হয়৷
সর্বশেষ নিলয় নীল হত্যাকাণ্ডের ঘটনার তদন্তভার গোয়েন্দা বিভাগকে দেয়া হয়েছে৷ যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘‘নিলয় হত্যাকাণ্ডও একই জঙ্গি গ্রুপ আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের কাজ বলে মনে হচ্ছে৷ এ ব্যাপরে দু'জন সন্দেহভাজনকে আমরা চিহ্নিত করতে পেরেছি, তাদেরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে৷''
কিন্তু এতদিনেও ব্লগার হত্যায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করা যায়নি কেন? প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘‘এই উগ্রবাদীরা ছোট ছোট গ্রুপে অসংখ্য গ্রুপে বিভক্ত৷ তারা নানাভাবে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সক্রিয় থেকে দ্রুত স্থান পরিবর্তন করে৷ তাই তাদের অবস্থান চিহ্নিত করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে৷ তবুও আমরা চেষ্টা করছি৷''
এর জবাবে ইমরান এইচ সরকার বলেন, ‘‘পুলিশ চাইলেই পারে৷ আমরা দেখেছি কোনো কোনো ঘটনায় পুলিশ অপরাধীদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আটক করে ফেলে৷ শুধু ব্লগার হত্যার ঘটনায় ব্যতিক্রম৷ দেখেশুনে মনে হচ্ছে সরকার ব্লগার হত্যাকারীদের কোনো এক অদৃশ্য কারণে ঘাটাতে চায় না৷''
সর্বশেষ নিহত ব্লগার নিলয়ের বাবা তারাপদ চট্টোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি আমার সন্তান হত্যার বিচার চাই৷ সরকার চাইলে, পুলিশ চাইলে অপরাধীদের অবশ্যই গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব৷''
অন্যদিকে রবিবার পুলিশের আইজি এ কে এম শহিদুল হক পুলিশ সদর দপ্তরে আবারো ব্লগার হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের আশ্বাস দিলেও, তাঁর কথায়, ‘‘ব্লগারদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, আপনারা কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করবেন না৷ লিখতে গিয়ে সীমা লঙ্ঘন করবেন না৷''