1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি ও বাংলাদেশে এর প্রভাব

মোহাম্মদ তানজীম উদ্দিন খান
১৩ অক্টোবর ২০২৩

জো বাইডেনের নেতৃত্বে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ২০২১ সালে ক্ষমতায় আসার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার মোটা দাগে পররাষ্ট্রনীতির মূল্যবোধগত দুই ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে সামনে এসেছে৷

https://p.dw.com/p/4XWD7
WASHINGTON D C District of Columbia USA 06 May 2019 world tourists visitin white house view fro
ছবি: Dean Pictures/IMAGO

বিশেষ করে, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চীন এবং রাশিয়ার মত কর্তৃত্ববাদী বা অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নেতৃত্বস্থানীয় হয়ে উঠা এবং তাদের সমর্থিত রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে মোটা দাগে পশ্চিমা বিরোধী একটা প্রভাব বলয়ের উত্থানের মধ্যে কৌশলী অবস্থান নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র৷

এমন সম্ভাবনার প্রেক্ষাপটে তাদের জাতীয় স্বার্থ তথা পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নে ভিসা নিষিদ্ধকরণ নীতির ক্রমবর্ধমান ব্যবহার দূতাবাসীয় পরিষেবা বা কনস্যুলার সার্ভিসকে দৃশ্যত এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করেছে৷

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পণ্ডিতদের কেউ কেউ এটাকে অভিহিত করেছেন ‘ভিসা কূটনীতি' (Visa Diplomacy) হিসেবে৷ ইতিমধ্যে নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, উগান্ডা, লাইবেরিয়া, গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস, এল সালভাদর, নিকারাগুয়া, হাইতি, বেলারুশ এবং বাংলাদেশসহ আরও অনেক রাষ্ট্রকে এই নীতির আওতায় এনেছে যুক্তরাষ্ট্র৷

এছাড়াও চীন, হংকং, কম্বোডিয়া, মিয়ানমার, জিম্বাবুয়ে, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, ইরিত্রিয়া, ইথিওপিয়া, মালি, লাইবেরিয়া, রাশিয়া, মলদোভা, সাউথ সুদান, ইউক্রেন, ভেনিজুয়েলা, ইরাকের কিছু সংখ্যক ব্যক্তিকেও ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে৷

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র দুই পর্যায়ে এই নীতি প্রয়োগ করেছে৷ প্রথম পর্যায়ে, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আর্থিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত সংস্থা ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র‍্যাব এবং সংস্থাটির বর্তমান এবং সাবেক সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়৷ তাদের বিরুদ্ধে গুম এবং বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মত অপরাধ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়৷

একই সঙ্গে এই সাতজনের মধ্যে আরও দুই কর্মকর্তাকে  যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টও একই রকম নিষেধাজ্ঞার আওতাভূক্ত করে৷ সরকারের এই দুই ডিপার্টেমেন্টের নিষেধাজ্ঞার দুই ধরনের তাৎপর্য রয়েছে৷ ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের নিষেধাজ্ঞা মানে হলো–কোন ধরনের আর্থিক, পণ্যগত বা সেবাগত লেনদেন বা এই ধরনের লেনদেনের উপকারভোগী হতে পারবে না নিষেধাজ্ঞাভুক্ত ব্যক্তি বা সংস্থা বা সংগঠন৷

আর স্টেট ডিপার্টমেন্টের নিষেধাজ্ঞা মূলত আর্থিক নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে সঙ্গে ভিসা নিষেধাজ্ঞাও যুক্ত হয়৷ নিষেধাজ্ঞা রাজনীতির দ্বিতীয় পর্যায়ে স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনি প্রক্রিয়া ব্যহত করার সঙ্গে জড়িত যে কোনো ব্যক্তি এবং তার পরিবারের সদস্যদের ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের নীতি গ্রহণ করে এই বছরের সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে৷

সবকিছু মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা কূটনীতি নীতি বাংলাদেশের জনপরিসরে দুটি আলাপকে সামনে নিয়ে এসেছে৷ বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের নীতি নির্ধারক বা তাদের সমর্থকেরা মনে করছেন ভিসা কূটনীতি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক, গ্রহণযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারবে না৷

আবার সরকার বিরোধীরা ঠিক বিপরীতটাই ভাবছে৷ অন্য কথায়, তারা মনে করছে  ভিসা কূটনীতি ক্ষমতাসীন দলকে তাদের নির্বাচন সংক্রান্ত রাজনৈতিক দাবি বাস্তবায়নে কার্যকরী হবে৷ এই দুই ভাবনার মধ্যে কোন ভাবনাটি শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য বেশি প্রযোজ্য হতে পারে, সেটাই বিশ্লেষণ করতে চাই৷

বিশ্লেষণটিকে চারভাগে ভাগ করা যায়৷ প্রথমত, ভিসা কূটনীতির ব্যবহারের ধরন এবং এর প্রয়োগ৷ দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের মত প্রভাবশালী রাষ্ট্রের ভিসা কূটনীতির কার্যকারিতা নিয়ে গবেষকদের ভাবনা৷ তৃতীয়ত, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা কতটুকু কার্যকর হতে পারে৷ চতুর্থত, ভিসা নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতার সফল উদাহরণ৷

২০০৬ সালে নেদারল্যান্ডস ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস ক্লিংগেনডেল প্রকাশিত ‘দ্য ভিসা ডাইমেনশন অব ডিপ্লোমেসি' নামের প্রবন্ধটিতে ভিসা কূটনীতি ব্যবহার ব্যাখ্যায় দুটি উদ্দেশ্যকে সামনে এনেছেন লেখক কেভিন ডি স্ট্রিংগার৷ প্রথমটি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃ্তি এবং কূটনৈতিক সহযোগিতা৷ আর দ্বিতীয়টি, কোনো বিষয় নিশ্চিত করতে জবরদস্তি এবং আপত্তি বা অসম্মতি৷

প্রথম উদ্দেশ্যটি হাসিলে সাধারণত কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকার পরেও অথবা কোনো ব্যক্তি, রাজনৈতিক বা অন্য কোনো নেতা বা সরকার বা রাষ্ট্র প্রধানের ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা থাকার পরেও অতিথি গ্রহণকারী রাষ্ট্র ভিসা দিয়ে থাকে৷

দুটি উদাহরণ এক্ষেত্রে সর্বজনবিদিত৷ ১৯৯৪ এবং ১৯৯৫ সালে আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির (আইআরএ) কূটনৈতিকভাবে নিষিদ্ধ নেতা সিন ফেনকে যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ এবং চাঁদা সংগ্রহের জন্য ভিসা দিয়েছিল৷ ব্রিটিশ সরকার এবং খোদ  প্রশাসনের অনেকের বিরোধিতার পরেও বিল ক্লিানটনের নির্বাচনি প্রতিজ্ঞা বাস্তবায়নে তাকে ভ্রমণের অনুমতি দেয়া হয়েছিল৷ যদিও এর আগের ২০ বছরে সাত বার সিন ফেনের  ভিসা প্রত্যাখান করা হয়েছিল৷

Bangladesch | Mohammad Tanzimuddin Khan
মোহাম্মদ তানজীম উদ্দিন খান, অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ছবি: Privat

ভিসা ইস্যুতে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট লি তেং হুই এর ক্ষেত্রেও একই প্রবণতা দেখা যায়৷ ১৯৯৫ সালে প্রেসিডেন্ট লি তেং হুইকে তার সাবেক উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্নেল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ভ্রমণ ভিসা দেয় যুক্তরাষ্ট্র৷ যদিও  যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে চীনের অংশ হিসেবেই আনুষ্ঠানিকভাবেই মেনে নিয়েছিল জিমি কার্টারের সময় ১৯৭৯ সালে৷ এতে তাইওয়ানের সঙ্গে  যুক্তরাষ্ট্রের অনানুষ্ঠানিক কূটনৈতিক  সম্পর্কের সূচনা হয়৷

আবার অন্যদিকে, জবরদস্তি বা অসম্মতিমূলক ভিসা কূটনীতির ক্ষেত্রে দেখা যায় রাষ্ট্রগুলো ভিসা দেয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে৷ নিজেদের জাতীয় স্বার্থ আদায় সহজসাধ্য না হলে এই ধরনের বন্ধুত্বহীনমূলক কিন্তু তাদের নিজস্ব আইনসম্মত ব্যবস্থা অন্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নেয়া হয়৷

১৯৯৮ সালে পারমাণবিক পরীক্ষা চালানোর প্রতিক্রিয়ায় ভারতের উপর  যুক্তরাষ্ট্র সরকারি লেনেদেনের ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া করে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে৷ জাপান, ব্রিটেন তাদের কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়ায় ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের কর্মকর্তা, নেতৃস্থানীয় কতিপয় বিজ্ঞানীদের ভিসা দিতে অস্বীকৃতি জানায়৷ এদের অনুসরণ করে যুক্তরাষ্ট্রও ইণ্ডিয়ান অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের সেই সময়কার চেয়ারম্যানকে ভিসা দিতে অস্বীকৃ্তি জানায়৷

তবে ভিসা দেয়ার এই নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য ছিল শুধু ভারতের পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের ওপর৷ আবার, রাষ্ট্র পর্যায়ে সম্পর্কের অবনতির প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রে ইরান আর কিউবা থেকে আগত অভিবাসীদের ভিসা করে দিয়েছিল৷

তবে সাম্প্রতিক সময়ে মানবাধিকার এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের উপর যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া ভিসাসহ অন্যান্য নিষেধাজ্ঞাকে বৃহৎ অর্থে গণতান্ত্রিক নিষেধাজ্ঞা (Democratic Sanctions) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে৷ আবার কেউ কেউ এটাকে বলছে ‘রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা' (Political Sanctions)৷

ক্রিস্টিয়ান ভন সয়েস্ট এবং মাইকেল ওয়াহম্যান তাদের লজিস্টিক রিগ্রেশনভিত্তিক গবেষণা প্রবন্ধ "নট অল ডিক্টেটরস আর ইক্যুয়াল: ক্যুস, ফ্রডুলেন্ট ইলেকশনস, অ্যান্ড দ্য সিলেক্টিভ টার্গেটিং অব ডেমোক্র্যাটিক স্যাংশনস'' বিশ্লেষণ করে মোটা দাগে তিনটি সিদ্ধান্ত পৌঁছেছেন৷

১৷ যদি অন্য কোনো রাষ্ট্রের সরকার হঠাৎ করে ক্যু এর শিকার হয়, তখন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মত প্রভাবশালী রাষ্ট্র এবং পশ্চিমা মিত্র জোট নিষেধাজ্ঞা আরোপে আগ্রহী হয়৷ এটা অবশ্য নির্ধারিত হয় নিষেধাজ্ঞা আরোপে আন্তর্জাতিক চাপ কতোচা জোরালো৷ নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষেত্রে ভূরাজনীতিই একমাত্র নিয়ামক, এরকম সনাতনী চিন্তাকে প্রতিষ্ঠিত করে না৷ তবে বিতর্কিত নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপের সম্ভাবনাও বেড়ে যায়৷ রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত জনতা এবং ভেঙ্গে পড়া আর্থিক অবস্থার কারণে নড়বড়ে এবং অস্থিতিশীল সরকার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নের সম্ভাবনা বেশি জোরালো হয়৷       

২৷  স্নায়ুযুদ্ধোত্তর বিশ্ব ব্যবস্থায় কর্তৃ্ত্ববাদী অনাচারী সরকারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের আন্তর্জাতিক চাপ সাধারণভাবেই এখন অনেক বেশি৷ তবে এক্ষেত্রে  যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো অর্থনৈতিক জোট নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে গণতন্ত্রে সংস্কারের আনার ক্ষেত্রে তাদের নিজেদের জাতীয় স্বার্থকে বিবেচনায় নেয় এবং সেক্ষেত্রে একটা ভারসাম্য আনার দিকে মনোযোগ থাকে৷ আবার, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন এজেন্ডা বাস্তবায়নে কোনো কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র যদি পশ্চিমাদের সঙ্গে একই বলয়ে অবস্থান করে বা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে থাকে তাহলে নিষেধাজ্ঞার রাজনীতি সেই রাষ্ট্রের জন্য আর প্রযোজ্য হয় না৷

৩৷ গণতান্ত্রিক নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দেয়া রাষ্ট্র তার অর্থনৈতিক এবং আর্থিক স্বার্থের হিসেব-নিকেষকে বিবেচনায় নেয়

এখন প্রশ্ন হলো গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্তগুলো বাংলাদেশের জন্য কীভাবে প্রাসঙ্গিক?

প্রথম সিদ্ধান্তটি বিবেচনা করলে এটা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অভিবাসীদের সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রে খুব বেশী নয়, যদিও গত দুই দশকে এই সংখ্যা ২৬৩% বেড়েছে৷ পিউ রিসার্চের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত অভিবাসী  নাগরিকের বা বাংলাদেশী অ্যামেরিকানদের সংখ্যা ছিলো ২০ হাজার ৮০০, যা দেশটির মোট জনসংখ্যার মাত্র .০৬৮%৷

এদের প্রায় অর্ধেকেরই বসবাস শুধু নিউ ইয়র্কে৷ আবার, বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত অভিবাসী নাগরিকদের একটা বড় অংশ (১৯%) দারিদ্র্ সীমার মধ্যে বসবাস করছে৷ সংখ্যাটি জাতীয় পর্যায়ের দারিদ্র সীমায় জীবন যাপন করা  নাগরিকদের চাইতে ৬% বেশি৷

ইংরেজিতে দক্ষ জনসংখ্যাও বাংলাদেশী অ্যামেরিকানদের (৫৫%) মধ্যে কম, এবং অন্য এশিয়ান অভিবাসীদের (৭২%) তুলনাতেও পিছিয়ে৷ পরিবার পিছু আয়ের ক্ষেত্রেও একই রকম৷ যেখানে অন্যান্য এশিয়ান অ্যামেরিকানদের গড় আয় ৮৫ হাজার ৮০০ ডলার, সেখানে বাংলাদেশি অ্যামেরিকানদের আয় ৫৯ হাজার ৫০০ ডলার৷

সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশি অ্যামেরিকানরা সেভাবে  যুক্তরাষ্ট্রে তাদের রাজনৈতিক প্রভাব বলয় তৈরি করতে এখনো সক্ষম হয়নি৷ তাই বাংলাদেশের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপে  সরকারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বিবেচনায় খুব বেশি খেসারত দিতে হয় না৷ তবে স্থানীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিউ ইয়র্ক এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম৷

অন্যদিকে, সরকারি হিসেব অনুযায়ী, ৮২ জন সচিবের মধ্যে শুধু প্রশাসনের ২৯ সচিবের ৪৩ জন সন্তান  যুক্তরাষ্ট্র, ক্যানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, পোল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ও ভারতে বসবাস করছেন৷ শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই আছে ১৮ সচিবের ২৫জন সন্তান৷ এই হিসেব তো আরো বড় হবে যদি পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, প্রভাবশালী মন্ত্রী, সাংসদ, রাজনীতিবিদদের সন্তানদের সংখ্যাটা যদি জানা যেত৷

এ সবকিছুর মানে হলো,  বা পশ্চিমাদের ভিসা বা অন্য কোনো নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের জন্য বরং অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ৷ এতে আমাদের জবরদস্তিমূলক বা আপত্তিমূলক কূটনীতির কাছে নতি স্বীকারের সম্ভাবনাটাও অনেক জোরালো৷

আবার দ্বিতীয় সিদ্ধান্তের দিকে যদি চোখ ফেরাই তাহলে একটা ব্যাপার গুরুত্বপূর্ণ আর তা হলো জাতীয় স্বার্থ নির্ধারণ বা এর গতিবিধি ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা দ্বারা মোটা দাগে প্রভাবিত হয়৷ তাই যেমনটা যুক্তরাষ্ট্র ২০২২ সালে প্রকাশিত ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্ট্র্যাটেজি নামের দলিলটিতে নিশ্চিত করেছে যে, তারা বাছবিচারহীনভাবে গণতান্ত্রিক সংস্কারে যাবেনা৷

এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, "আমরা ( যুক্তরাষ্ট্র) বিশ্বাস করিনা যে, আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য দুনিয়ার সব সরকার, সমাজকে আমাদের মত আদলে পুনর্নির্মাণ করতে হবে৷''

সেজন্যই বোধয় তাদের জাতীয় স্বার্থের জন্য কর্তৃত্ববাদী সৌদি আরবের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণতান্ত্রিক সংস্কার তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ থাকে না৷ এমনকি থমাস ক্যারোথার্স ও বেনজামিন প্রেস অব দি কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস গত বছর ২০০৫ সালের পর থেকে গণতন্ত্রে পিছিয়ে থাকা রাষ্ট্র হিসেবে মিশর, জর্জিয়া, হাঙ্গেরি, ভারত, ফিলিপাইন, পোল্যান্ড, তানজানিয়া, থাইল্যান্ড, এবং টার্কিসহ ২৭টি রাষ্ট্রকে চিহ্নিত করেছে৷ কিন্ত তাদের ক্ষেত্রে নিশ্চুপ৷ কেননা, ভারত, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, তানজানিয়াকে প্রয়োজন চীনকে ঠেকাতে, পোল্যান্ডকে রাশিয়ার আগ্রাসন থামাতে, টার্কিকে দরকার সুইডেনের প্রতি সমর্থনের জন্য যেন তারা ন্যাটোর সদস্য হতে পারে৷

তবে বাংলাদেশ ক্ষেত্রে বাস্তবটা উল্টো৷ ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধকে ঘিরে বিশ্বরাজনীতির চীন-রাশিয়া-ভারত বনাম পশ্চিমা রাষ্ট্র মেরুকরণ এবং দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ভারতের চিরশত্রু চীনবিরোধী অবস্থান, রোহিঙ্গা সংকট, বাংলাদেশে রাশিয়া এবং ভারতের সহযোগিতায় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ  যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোকে এক নতুন জটিল বাস্তবতায় ঠেলে দিয়েছে৷

সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশের নির্বাচনকে ঘিরে চীন এবং রাশিয়ার ক্ষমতাসীন সরকারকে পক্ষে অবস্থান আমাদের পশ্চিমাদের কাছে সন্দেহজনক রাষ্ট্রে পরিণত করেছে৷ সবকিছু ছাপিয়ে তো রয়েছে  যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বে ইন্দোপ্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (আইপিএস) এবং চীনের প্রভাববলয় বিস্তৃতির বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ৷

আর আমরা চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে আমাদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করলেও আইপিএস নিয়ে আমরা কোন স্পষ্টতা প্রকাশ করতে পারিনি, যা পশ্চিমা স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক৷ সবকিছু মিলিয়ে আমরা এখন বিশ্বরাজনীতির নতুন যে বাস্তবতা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বনাম কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র, সেই বাস্তবতায় আমরা আমাদের রাষ্ট্রের বর্তমান বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় পরের দলেই পড়ে যাই৷ তাই গণতান্ত্রিক নিষেধাজ্ঞা আমাদের জন্য কার্যকরী  হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল৷ 

তৃতীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আমাদের রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস শিল্পের মূল বাজার ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্র৷ তার উপর নির্ভর করছে রেমিটেন্সের বড় উৎস৷ এ সব কিছু বিবেচনা করলে তাদের উপর আমাদের নির্ভরতা কম নয়৷ আমরা অনেক ঝুঁকিতে আছি৷ সেজন্যই ইউরোপিয়ান সংসদে আমাদের বিরদ্ধে নিষেধাজ্ঞার সতর্কতা দেওয়া হয় মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগে৷ অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিও কোনো সুসংবাদ দিতে পারছে না৷ মুদ্রাস্ফীতির লাগামও টেনে ধরা যাচ্ছে না৷ জনরোষের প্রেক্ষাপট উপস্থিত৷

শেষ কথা

বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যে বিতর্ক এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিকাশ আন্তর্জাতিক রাজনীতির নতুন জটিলতা পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর জন্য একটা মওকা এনে দিয়েছে বাংলাদেশের উপর গণতান্ত্রিক নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে তাদের জাতীয় স্বার্থ নিশ্চিত করা৷

গণতান্ত্রিক নিষেধাজ্ঞা কার্যকরী হওয়ার সব উপাদানও কমবেশি উপস্থিত৷ শেষ পর্যন্ত আমরা কোথায় পৌঁছাবো সেটা নির্ভর করবে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব – ক্ষমতাসীন বা ক্ষমতাহীন, কীভাবে আন্তর্জাতিক রাজনীতির নতুন জটিলতা বা বাস্তবতা কীভাবে অধ্যয়ন করছে৷ এটার ভুল অধ্যয়ন আমাদেরকে বিপদগ্রস্তই করে রাখবে, অন্য কিছু নয়৷

মোহাম্মদ তানজীম উদ্দিন খান অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য