1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মোদীর দোলনা-কূটনীতি কি ব্যর্থ হলো

গৌতম হোড় নতুন দিল্লি
১৯ জুন ২০২০

চীন নিয়ে ভারতের কূটনৈতিক তৎপরতা কি প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না? বিরোধী নেতা থেকে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতীয় কূটনীতির চেনা ধারটা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না।

https://p.dw.com/p/3e2SC
ছবি: Reuters/K. Kyung-Hoon

২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বিভিন্ন মঞ্চে মোট ১৮ বার তাঁর সঙ্গে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর কথা হয়েছে। গত ছয় বছরে প্রধানমন্ত্রী মোদী একাধিকবারচীনগেছেন। শি জিনপিং ভারতে এসেছেন। গুজরাটে সবরমতী নদীর ধারে দুই নেতার দোলনায় বসে আলোচনার ছবি ভাইরাল হয়েছে। তাকে বলা হয়েছে দোলনা-কূটনীতি। তামিলনাড়ুতে সমুদ্রের ধারে হেরিটেজ মন্দিরের পাশেও মোদী ও শি জিনপিং আলোচনা করেছেন। 

এমনকী দুই দেশের শীর্ষনেতা কোনও রকম নির্ধারিত আলোচ্যসূচি ছাড়াই বৈঠক করেছেন। সাধারণত, দুই দেশের শীর্ষনেতা মিলিত হলে তার আগে কূটনীতিকরা প্রচুর পরিশ্রম করে আলোচ্য বিষয় ঠিক করেন। সেই আলোচনার একটা দিশা থাকে। কিন্তু সেই প্রথাও ভেঙেছেন মোদী। চীনের ছবির মতো সুন্দর জায়গায় তাঁরা আলোচ্যসূচি ছাড়াই কথা বলেছেন। তখন সুষমা স্বরাজ বিদেশমন্ত্রী ছিলেন। ওই বৈঠকের পর  লোকসভায় তিনি প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছিলেন ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগকে। বলেছিলেন, সব কিছু ধরাবাঁধা ছকে ফেলা যায় না। এই ভাবে আলোচনা করলে এক দেশের অন্য দেশের প্রতি আস্থা বাড়ে।

কূটনীতির ক্ষেত্রেও যে ছক ভাঙা যাবে না এমন কোনও মাথার দিব্যি নেই। দুই নেতা একমত হলে ভাঙা যেতেই পারে। মোদী এর আগেও প্রথা ভেঙে নওয়াজ শরিফকে জন্মদিনের অভিনন্দন জানাবার জন্য বিদেশ থেকে ফেরার পথে সোজা পাকিস্তানে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। তখনও তাঁর এই ছকভাঙা নীতির যেমন প্রশংসা হয়েছিল, তেমনই বিরোধীদের সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছিল। কিন্তু বলা হচ্ছিল, কূটনীতিতে নতুন হাওয়া নিয়ে এসেছে মোদীর নীতি।

দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বিদেশমন্ত্রী হিসাবে মোদী নিয়ে এসেছেন জয়শঙ্করকে। প্রাক্তন কূটনীতিক। বিশাল অভিজ্ঞতা। ফলে সংকটের সময়ে কী করতে হবে তা তাঁর ভালো করেই জানা।

কিন্তু এ বার ভারত-চীন সীমান্ত সমস্যা ও সংঘর্ষের পর ভারতের কূটনীতি নিয়ে প্রচুর প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। বিরোধীরা তুলছেন। বিশেষজ্ঞরা তুলছেন। আসলে তাঁদের এই প্রশ্ন তোলার সুযোগটা এসেছে প্রথমে চীন ভারতের জমিদখল করেছে এই অভিযোগ ওঠার পর এবং তারপর গালওয়ানে রক্তাক্ত সংঘর্ষের পর ভারতের কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া নিয়ে। বিরোধীরা যেটাকে বলছেন নিষ্ক্রিয়তা। শুরুটা করেছিলেন সোনিয়া গান্ধী। ২০ জন সেনার মৃত্যুর পর তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, কেন এতজন ভারতীয় সেনাকে প্রাণ দিতে হলো? চীন ভারতের কতটা জমি দখল করে বসে আছে প্রধানমন্ত্রী জানান। রাহুল গান্ধীর প্রশ্ন ছিল, প্রধানমন্ত্রী দুই দিন পরে টুইট করলেন, তারপর কেন তাতে চীনের নাম পর্যন্ত নিলেন না। এটা ভারতীয় সেনার অপমান।

বিরোধী নেতারা এই ধরনের প্রশ্ন তুলবেন। বিজেপি যখন বিরোধী আসনে ছিল, তখন আরও বেশি করে তুলতো। এখন অন্যরা তুলছেন। এই যেমন ডয়চে ভেলেকে রাজ্যসভায় তৃণমূলের চিফ হুইপ সুখেন্দু শেখর রায় বলেছেন, ''প্রধানমন্ত্রী বা প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া জানানোর সময় চীনের নাম পর্যন্ত নিলেন না। বিষয়টা আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ে গিয়ে সরকারের বোঝানো উচিত ছিল, কীভাবে আমাদের সেনাদের মারা হয়েছে। তা হলে কি আমরা পলিসি প্যারালিসিসে ভুগছি, এই প্রশ্নটা উঠতেই পারে।''

কিন্তু এর থেকেও আরও বড় একটা প্রশ্ন বিশেষজ্ঞরা করছেন। সেটা হলো, দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা চলছিল। একটা সমঝোতা হয়েছিল। দুই দেশের সেনা পিছনে চলে যাবে। চীনের সেনা যদি কোথাও না পিছোয়, তা হলে তা সন্ধ্যার সময় দেখতে যাওয়ার কী দরকার ছিল? আলোচনা যখন চলছে, তখন এটা নিয়ে আলোচনা করা যেত। আরও চাপ দেওয়া যেত। আজকাল তো উপগ্রহের ছবিই সবকিছু দেখিয়ে দেয়। আগে যদি চীন সেনারা ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকে পড়ে, তা হলে তখনই কেন প্রতিবাদ করা হলো না? পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর বলেছেন, সেনারা বন্দুক নিয়ে গেছিলেন, তা হলে আক্রান্ত হওয়ার পরও কেন গুলি চালানো হলো না? জয়শঙ্করই বলেছেন, চীনের সঙ্গে দুইটি চুক্তি অনুযায়ী প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় কেউ গুলি চালায় না। নিঃসন্দেহে ভালো চুক্তি। তাতে বিরোধটা চরম জায়গায় পৌঁছয় না। তা হলে ওই উত্তেজনার মধ্যে সেনাদের এভাবে পাঠানোর কারণ কী?

গালওয়ানের ঘটনার পরে সেনা স্তরে আলোচনা হচ্ছে। সেটা দরকার। কিন্তু চীন প্রথমেই বার্তা দিয়ে দিয়েছে, ভারতই না কি তাঁদের সীমান্তে ঢুকেছিল। তাই এই সংঘর্ষ হয়েছে। তার পাল্টা কূটনৈতিক বার্তা ভারতের তরফে দেওয়া হয়নি। বিশ্বের কাছে চীনের বার্তাই গেছে। বিষয়টি নিয়ে বিশ্ব জনমত নিজেদের দিকে টানার চেষ্টা থেকেও বিরত থেকেছে ভারত। তাঁদের  প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে খুবই সাবধানী মনে হয়েছে।  

Goutam Hore
ছবি: privat

মোদী তো প্রথম থেকে আলোচনার নীতি নিয়েই চলছিলেন। বিভিন্ন ফোরামে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল। কিছুদিনের মধ্যে আরআইসি অর্থাৎ রশিয়া, ইন্ডিয়া, চীনের ফোরামেও আলোচনা হওয়ার কথা। সেই আলোচনার আবহেই তো সমস্যা মেটার সব চেয়ে ভালো সম্ভাবনা। ডোকলাম তো সেভাবেই মিটেছিল।

বৈদেশিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ প্রবীণ সাংবাদিক প্রণয় শর্মা ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ''আমাদের লক্ষ্য যেটা সেখানে যেতে হবে। এই মুহূর্তে দুই দেশকে শান্তিপূর্ণভাবে বিরোধ মেটাতে হবে। দুই দেশ একে অপরের ওপর অনেক ক্ষেত্রে নির্ভরশীল। একসঙ্গে বিভিন্ন ফোরামে কাজ করতে হবে। সীমান্ত নিয়ে আমাদের দুই দেশের দুই ধরনের মত আছে। তা সত্ত্বেও দুই দেশের সহযোগিতার ভিত্তিতে যাতে চলতে পারে সেটাই কূটনীতির লক্ষ্য হওয়া উচিত।''   

অটল বিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় খুব দামী কথা বলেছিলেন। প্রতিবেশীকে বদলানো যায় না। তাই তাঁদের সঙ্গে নিয়ে চলতে হয়। আর এই প্রতিবেশীদের মধ্যে চীন ও ভারতের সম্পর্ক সব চেয়ে জটিল, বহুমাত্রিক, প্রতিদ্বন্দ্বিতাময় এবং সেই সম্পর্কের মধ্যে সন্দেহের বীজও আছে। তা সত্ত্বেও ভয়ঙ্কর বিরোধ হলে, উত্তেজনার পারদ বাড়তে থাকলে মেটানোর রাস্তা তো দুইটি। হয় আলোচনা, নয় যুদ্ধ। যুদ্ধ মানে শুধু ধ্বংস। সাধারণ মানুষের মধ্যে ইচ্ছে করলেই লড়কে লেঙ্গে মনোভাব তৈরি করা যায়। কিন্তু তাতে উত্তেজনার পারদ বাড়া ছাড়া কোনও লাভ হয় না। তাতে দেশের অন্দরে রাজনৈতিক লাভ বা ক্ষতি হতে পারে। আসল সমস্যা মেটে না। আলোচনা হোক। সেই সঙ্গে বাকি বিশ্বকে পাশে পাওয়ার চেষ্টা হোক। সেই কূটনীতিই এখন প্রয়োজন।

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি গৌতম হোড়৷
গৌতম হোড় ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি৷