1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মেলা ছাড়া বাণিজ্য চলে না

অরুণ শঙ্কর চৌধুরী
১৬ অক্টোবর ২০১৭

ট্রেড ফেয়ার বা বাণিজ্য মেলার ক্ষেত্রে বিশ্বের প্রথম ঠিকানা হলো জার্মানি৷ তার অনেক পরে আসে মিউনিখের অক্টোবরফেস্ট বা কোলন কার্নিভালের মতো বিনোদন মেলা৷ আর রয়েছে বড়দিনের বাজারের মতো সুপ্রাচীন, লোকজ মেলা৷

https://p.dw.com/p/2lpW4
Anuga 2015 Köln Lebensmittelmesse Meerjungfrau Krabbenchips
ছবি: Nastasja Shtrauchler

কোলনে আনুগা নাম দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় খাদ্য ও পানীয়ের মেলা হয়ে গেল৷ সেই মেলায় এবার অতিথি দেশ ছিল ভারত৷ ওদিকে ফ্রাংকফুর্টে শেষ হলো আন্তর্জাতিক বইমেলা৷ সেখানে সহযোগী দেশ ছিল ফ্রান্স৷ মনে রাখতে হবে, এই বইমেলাও মূলত একটি বাণিজ্য মেলা, যার প্রথম তিন দিন শুধুমাত্র ‘বাণিজ্যিক অতিথিদের' জন্য, আপামর জনতার জন্য শুধু শেষের দু'টো দিন৷

বাণিজ্য মেলায় প্রধানত সংশ্লিষ্ট শিল্প বা বাণিজ্য পণ্যের পাইকারি কেনাবেচা হয়৷ দূর দূর থেকে প্রদর্শকরা আসেন তাদের পণ্য দেখাতে ও ক্রেতা সংগ্রহ করতে৷ মেলার পর প্রতিবার ঘোষণা করা হয়, কত কোটি ইউরোর কেনাবেচা হয়েছে৷ হাজার হোক, প্রদর্শকরা দেশ-বিদেশ থেকে এসে, স্টল ভাড়া করে, সেখানে পণ্যের নমুনা সাজিয়ে, প্রতিনিধি রেখে তাদের পণ্য বিক্রি করার আয়োজন করেছেন – সব মিলিয়ে যার খরচ কিছু কম নয়! কাজেই শেষমেষ ব্যবসা ভালো না হলে, তারা কি আর আবার মেলায় আসার উৎসাহ পাবেন? 

আনুগার বুকে এক টুকরো বাংলাদেশ

আলব্রেশ্ট ড্যুরার-এর মতো চিত্রকরদের ছবি দেখলেই বোঝা যায়, মধ্যযুগে সব বাজারঘাট বা কেনাবেচার এলাকাই ছিল মেলার মতো৷ মানুষজন পণ্য নিয়ে সেখানে আসত খদ্দের ধরার আশায়; খদ্দেররাও জানতেন, পছন্দের জিনিস পাওয়ার সম্ভাবনা এই বাজার কিংবা মেলাতেই বেশি৷ সে আমলে দূরদূরান্ত থেকে এসে ঘণ্টা দুয়েক পরে গাড়ি নিয়ে তো আর বাড়ি ফেরা যেতো না; কাজেই ঐ বাজারেই খাওয়া-দাওয়া, ভাঁড় কি জাদুকরের খেলা দেখা; মল্লযুদ্ধ কিংবা তীর ছোঁড়ার প্রতিযোগিতা; একটু সন্ধ্যে হলে কোনো সরাইখানায় গিয়ে এক পাত্র – অর্থাৎ মধ্যযুগে কেল্লার মধ্যেই হোক আর নীচের চত্বরেই হোক, প্রায়ই মেলা বা বাজার বসত আর মানুষজন সেখানে গিয়ে বাণিজ্য থেকে বিনোদন, সব কিছু সাঙ্গ করতে পারতেন৷

আর আজ? বিশ্বের মুখ্য বাণিজ্য মেলাগুলির দুই-তৃতীয়াংশের স্থান হল এই জার্মানিতে৷ প্রতিবছর এখানে ১৫০টি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা ও প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়; সেখানে পসরা দেখান প্রায় ১,৭০,০০০ প্রদর্শক আর সেই পসরা দেখতে ও কিনতে আসেন প্রায় এক কোটি দর্শক৷ প্রত্যেক পাঁচজন দর্শক বা অতিথির একজন আসেন বিদেশ, মানে জার্মানির বাইরে থেকে৷ জার্মানির বড় বড় শহর মিলিয়ে মোট ২২টি স্থায়ী মেলা প্রাঙ্গণ রয়েছে, যেখানকার হলগুলিতে ২৭ লাখ বর্গমিটার প্রদর্শনীর জায়গা রয়েছে৷ প্রদর্শক আর দর্শকরা মিলে প্রতিবছর জার্মানির বাণিজ্য মেলাগুলিতে ১,২০০ কোটি ইউরো খরচ করেন; অপরদিকে ট্রেড ফেয়ারগুলির কল্যাণে জার্মানির জিডিপি বাড়ে বছরে ২,৩৫০ কোটি ইউরো৷ 

মোটর গাড়িতে যেমন পেট্রোল ছাড়া লাগে মোটর অয়েল, সেরকম বিশ্ববাণিজ্য আজ শুধু উদ্ভাবন ও উৎপাদনই নয়, পণ্য প্রদর্শন, পরিবেশন ও সেই পণ্যের ফরমায়েশও বটে – যা ঘটে এই বাণিজ্য মেলাগুলিতে৷ এক কথায়, বাণিজ্য মেলা হল বিশ্ববাণিজ্যের মোটর ওয়েল, বিশেষ করে এই বিশ্বায়িত বিশ্বে৷

বিনোদন, মনোরঞ্জন

সেজন্য জার্মানিতে রয়েছে অ্যামিউজমেন্ট পার্ক বা থিম পার্ক, বিভিন্ন মরশুমে বিভিন্ন শহরের কার্নিভাল, সকলের প্রিয় প্রথাগত বড়দিনের বাজার, অক্টোবরফেস্টের মতো শুধুই মোচ্ছব এবং – ঐ এবংটা আমার বিশেষ প্রিয়: কোনো কেল্লায় কিংবা শহরের প্রাচীন কেন্দ্রে মধ্যযুগীয় বাজার৷ খেয়াল রাখবেন, মধ্যযুগের বাজার নয়, মধ্যযুগীয় বাজার৷ ইউরোপের মানুষ একদিকে যেমন আধুনিক যন্ত্রসভ্যতার কোনো সুযোগসুবিধাই বাদ দেয় না, অপরদিকে তারা তাদের অতীতকেও বাঁচিয়ে রাখতে সচেষ্ট – আমি বলব, অতীত না হলেও অতীতের আমেজ৷

Deutsche Welle DW Arun Chowdhury
অরুণ শঙ্কর চৌধুরী, ডয়চে ভেলেছবি: DW/P. Henriksen

তাই হঠাৎ যখন দেখি কাঠের বা তেরপলের সব দোকান সাজিয়ে সেখানে মধ্যযুগের সাজপোশাক পরে দোকানিরা সুপ্রাচীন হাতের কাজের নমুনা দেখাচ্ছেন ও বিক্রি করছেন; কোথাও হয়তো কামার গরম আগুনে শলাকা ঢুকিয়ে পরে হাতুড়ি পিটিয়ে ফলা তৈরি করছে; কোথাও নানা ধরণের চামড়ার ব্যাগ ইত্যাদি বিক্রি হচ্ছে; মেলা প্রাঙ্গণের একদিকে মধ্যযুগীয় ‘নাইট'-দের অসিযুদ্ধ চলেছে, এমনকি ঘোড়ার পিঠে চড়ে কাঠের ভোঁতা বর্শা হাতে টুর্নামেন্টও অসম্ভব নয়; কোথাও মধ্যযুগের ‘মিন্স্ট্রেল' বা বাউল তার বীণা বাজিয়ে সে আমলের গান গাইছে আর তারই মধ্যে ধড়াস করে কোথায় যেন তোপ পড়ল, ঢং ঢং করে গির্জার ঘণ্টা বাজতে শুরু করল – তখন যেন আবার সেই হারানো ইউরোপে ফিরে যাই, যেখানে বাজার ছিল মেলা, আর বাণিজ্য ছিল জীবিকা, আর সব কিছুর কেন্দ্রে ছিল ব্যবসা নয়, জীবন, মানুষের জীবন৷

আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷